চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:
কবিগুরুর দীর্ঘ জীবন (১৮৬১-১৯৪১)। কিন্তু কাজের অনুপাতে তা একটুক্ষণ। ওনাকে নিয়ে লেখা বা আলোচনা করা আমার কাছে স্পর্ধা, তবু খুব সঙ্গত কারনেই আমার মনে প্রচুর জিজ্ঞাসা এবং অপরিসীম অনুসন্ধিৎসা জন্মায়, যখন টুকরো টুকরো ভাবেই তাঁর সান্নিধ্য লাভে সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতীদের লেখা পড়ি। তাঁর গান, গল্প, ছবি, অভিনয়, উপন্যাস, নাটক, পত্রসাহিত্য এসব নিয়ে কিছু বলছি না, বা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমি অভিভূত, যখন জানতে পারছি তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিভাবে নিজেকে সৃষ্টির কাজে নিযুক্ত রেখেছেন আরো গভীর ভাবে। একে একে অনেক প্রিয়জনকে মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে। যেদিন দুপুরে তাঁর মেজো মেয়ে রানি মারা গেছে, সেদিনই তাঁর বৈঠকখানায় বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আলোচনা বসেছে, যা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। জীবন তাঁর কাছ থেকে যত ছিনিয়ে নিয়েছে, তিনি তত জীবনকে ভালবাসার কঠিন ক্ষমতা ও তপস্যা নিয়ে, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে জীবনের সাধনা করে গেছেন। জীবনযাপন, সাজগোজ, পোশাক, লেখালেখি নিয়েও কম অপমান সহ্য করেননি, কিন্তু তাঁর একটাই আত্মজিজ্ঞাসা ছিল, কেমন ভাবে বাঁচবো? থেমে থাকা নয়, আনন্দ নিয়ে এগিয়ে চলাই তো জীবনের মূলমন্ত্র।
মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা থেকে জানা যায় ভোর পাঁচটার সময় উঠে চা খেয়ে সাড়ে নটা পর্যন্ত লেখালেখি করতেন, দশটার মধ্যেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে সংস্কৃত আর ইংরাজি ডিক্সনারী পড়তেন, তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত লেখালেখি। দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যাস কোনদিনও ছিল না। শরীর খারাপ ও তাঁকে তাঁর সাধনার থেকে আলাদা করতে পারতো না।
১৮৮২ তে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই "সন্ধ্যাসঙ্গীত।" ১৮৮৩ তে প্রথম উপন্যাস "বউঠাকুরানির হাট", ১৮৮৪ তে প্রথম নাটক "প্রকৃতির প্রতিশোধ"। প্রথম দিকের লেখায় ছিল এক তরুণ প্রেমিকের অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছাস যা, অবশ্যই খুব স্বাভাবিক। ১৮৮৪, ১৯ এপ্রিল অকালে মারা গেলেন তাঁর স্নেহের বৌঠান কাদম্বরী দেবী। সেই বছরেই তাঁর ওপর পড়লো জমিদারি দেখার গুরু দায়িত্ব।
প্রিয় সখী বৌঠানের অভাববোধ, জীবনকে আরো আরো মূল্যবান করে তোলে। ১৮৮৮ তে "মায়ার খেলা", ১৮৯০ তে "মানসী"।
১৯০১ সালে বোলপুরে ব্রহ্ম চর্যাশ্রম নামে আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা, ১৯২১ এ বিশ্বভারতী নামে পরিচিত হয়। এই ১৯০১ থেকে ১৯০৩ এর মধ্যে কিন্তু স্ত্রী ও কন্যাকে হারান। ১৯০৭ এ তাঁর ছোট ছেলে মারা যান।
এতো আঘাত পেতে পেতে তাঁর অরূপের প্রতি আগ্রহ আরো বেশি করে মেশে জীবনদর্শনে। ১৯১০ এ গীতাঞ্জলি। যার ইংরাজি অনুবাদ নিজেই করেন অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯১২ তে। ১৯১৩ তে নোবেল। যা আমরা খুইয়েছি।
আসলে খুইয়েছি অনেক দিন আগেই, তাঁকে। রবীন্দ্রনাথ মানে এখন আমাদের কাছে গবেষণার মুখস্থ বিদ্যা, বাড়ির নামকরণ, সমবায় সংস্থার নাম, বৈঠকখানার শোভা, পঁচিশে বৈশাখের শোভাযাত্রা, বাইশে শ্রাবণের "তোমার অসীমে", ফেসবুকে চমকপ্রদ কোট ইত্যাদি ইত্যাদি এই সমস্ত সহজপাচ্য জিনিস।
সহজপাচ্য খেতে খেতে হজমশক্তি ভীষণ দুর্বল। তাঁর জীবনদর্শন ও চেতনার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগই নেই।
বরং যোগাযোগটা আছে সংখ্যায়।
দেড়শো বছর... হাততালি,
দুশো বছর... হাততালি,
তিনশো বছর...
(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours