ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:
রউমারি থানা সদরের প্রশাসনিক অফিস একদম ভারতের পেটের ভেতর। থানা সদর, শিক্ষা অফিস, স্বাস্থ্য অফিস, এক কথায় প্রশাসনিক সব অফিসই ভারত সীমান্তের ভেতরে। যে কারণে এখানে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প করা সহজ হয়েছে এবং সম্ভব হয়েছে। থানা কম্পাউন্দের মধ্যে অনেকখানি জায়গা। বড় একটি খেলার মাঠ। সেই মাঠে আমাদের প্রাথমিক ট্রেনিং হয় সকাল বিকেল। প্রাথমিক ট্রেনিং মানে শরীর গঠন। লেফট রাইট করি। আর লাঠি হাতে যুদ্ধের ট্রেনিং। কয়েকজন ইপিয়ার জোয়ান আমাদের ট্রেনিং করান। কারও কারও হাতে রাইফেল। সবার হাতে রাইফেল দেওয়ার মতো অতগুলো রাইফেল তখন ক্যাম্পে ছিল না।
নদীর নামে আমাদের কোম্পানির নাম। আমাদের কোম্পানির নাম যমুনা কোম্পানি। আরও আছে পদ্মা কোম্পানি, মেঘনা কোম্পানি, সুরমা কোম্পানি। প্রতিটি কোম্পানির আলাদা-আলাদা লাইন। ট্রেনিংয়ে আলাদা লাইন, খাওয়ার সময় আলাদা লাইন। এখানে ক্যাম্প শুরুর কোম্পানির নাম মেঘনা। পুরনো হিসেবে তারা একটু বেশি সুবিধে পেয়ে থাকে। আমাদের কোম্পানি নতুন, তাই আমাদের একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই বৈষম্য আমার ভাল লাগতো না।
প্রথমদিন সকালে নাস্তার জন্য লাইন ধরতে বলা হলো, আগে মেঘনা কোম্পানির সিরিয়াল হবে। আমরা লাইনের শেষে। নাস্তা বলতে দুই মুঠ চিড়া আর আধা মুঠ চিনি। এই খাওয়া খেয়ে কতক্ষণ থাকা যায়। দুপুরের খাওয়ার জন্য তাই ব্যস্ত হয়ে লাইনে এসে দাঁড়ালাম। দুপুরের খাওয়া মানে অখাদ্য খিচুড়ি। এতো বাজে রান্না যে, মুখেই তোলা যায় না। খিচুড়ির মধ্যে বড় বড় পোড়া কয়লা। কামড় দেওয়ার পর যখন মুখের মধ্যে মড় মড় শব্দ হতো তখন অস্বস্তিতে গা গুলাতে থাকতো। প্রথমদিন খেয়েই বুঝলাম এমন খাওয়া খেয়ে বাঁচা যাবে না। যুদ্ধতো আরও পরের ব্যাপার।
চারপাশে দেখতাম অনেকেই চোখমুখ বুজে নাকে-মুখে খাচ্ছে। আমিও জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সমস্যা হতো কয়লায় কামড় লাগলে। আর খেতে ইচ্ছে করতো না। গা গুলাতে থাকতো। অনেক গবেষণার পর আবিস্কার করা গেল খিচুড়িতে পোড়া কয়লা আসে কিভাবে? অনুসন্ধানে জানা গেল আনাড়ি বাবুর্চিদের ভুল কাজের ফল। তখন রান্নার জন্য অভিজ্ঞ বাবুর্চি কোথায় পাওয়া যাবে? নিজেদের রান্না নিজেদেরই করতে হয় চেলাকাঠ পুড়িয়ে রান্না করার সময় পোড়া কয়লা রান্নার ডেকচিতে কোন ফাঁকে পড়ে যেত সেটা আনাড়ি বাবুর্চিরা বুঝতে পারতো না। সেটা বোঝা যেতো খাওয়ার সময়। প্রায়ই আমি আমার খিচুড়ি অর্ধেক খেয়ে বন্ধু আসগর অথবা রাজ্জাককে দিয়ে দিতাম। দুজনই পেটুক ছিল। দুজনেরই শরীর স্বাস্থ্য ছিল গাট্টা-গোট্টা। অনেক খাবার লাগতো তাদের। বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার জন্য তারা ওই অখাদ্য খেয়ে নিতো। বাকি আমরা মোটামুটি বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু খাওয়া দরকার ততটুকু খেয়ে নিতাম। সমস্যা বাঁধলো সুকুর মামুকে নিয়ে। সে আবার অতীব ভদ্রলোক। এসব খাওয়া সে দু’এক লোকমা খেয়ে পরে অন্যত্র চালান করে দিত। ছোটবেলা থেকে তার জীবন কেটেছে আয়েশি ভাবে। অবস্থাপন্ন পিতার ঘরে বেড়ে উঠেছেন। অভাব কি জিনিস কোনদিন চোখে দেখেননি। ক্ষুধার কষ্ট কোনদিন বুঝতে হয়নি। মানুষ হয়েছেন প্রাচুর্যের মধ্যে, বিভিন্ন শহরে। বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর। তার বদলির চাকরির কারণে তার পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বাস করেছেন।
সেই পরিবারের অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে তিনি একদমই ব্যতিক্রম। ছুটি-ছাটায় গ্রামে এলে খুঁজে খুঁজে তিনি আমাদের বের করতেন। তারপর নানা ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। অত্যন্ত রসিক স্বভাবের মানুষ তিনি। ভাল গান গাইতে পারেন। দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারেন। সারাদেশের নাট্যাঙ্গনের মানুষেরা ‘রফিকুল আলম’ নামে একডাকে চেনে। তিনি আমার লেখা একটি মঞ্চনাটক ‘ঢেউয়ের দোলা’ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেটা স্বাধীনতার পর আমাদের গ্রামে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চস্থ হয়। সেই নাটকে তিনি একটি চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। ঢাকার মিরপুরে ‘সংলাপ’ নামে একটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। তাঁর রচনা এবং নির্দেশনায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে অনেক মঞ্চসফল নাটক উপহার দিয়েছে ‘সংলাপ’ গ্রুপ থিয়েটার।
রফিকুল আলম গ্রাম্য সম্পর্কে আমার মামা। মুলত আমি মামা। সে ভাগ্নে। সিনিয়রকে ভাগ্নে না বলে মামা বলেই সম্বোধন করে সবাই। আমিও তাই করি। তার ডাক নাম সুকুর। এই নামেই আমি তাঁকে সুকুর মামু বলে ডাকি। আমাদের মধ্যে তিনি সবার সিনিয়র। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ পর্বের ছাত্র থাকাকালীন, সেইসময় শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। আমরা তাঁকে পেয়ে হাতে চাঁদ পেলাম। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে যোগ দিলাম মুক্তিযুদ্ধে।
রউমারি ট্রেনিং ক্যাম্পে তাঁর খাওয়া নিয়ে জটিল সমস্যায় সবাই চিন্তিত। এইসময় আমরা আবিস্কার করলাম থানার অদূরে একটি বাজার। বেশ বড় ধরণের বাজার। অনেকগুলো দোকান আছে বাজারে। সব দোকানে কলা পাওয়া যায়। কাধি-কাধি চাপা কলা। প্রচুর এবং দামেও সস্তা। শুরু হলো আমাদের নতুন মিশন। সকাল বিকাল আমরা কলা আর মুড়ি খাই। তারপর চা। সুকুর মামুর চায়ের নেশা প্রবল। বলা যায় চায়ে তাঁর না নেই।
আপাতত ভালই কাটছিল সময়। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে আমরা সবাই হতভম্ব। শাজাহানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চারদিকে খোঁজা হলো। কোথাও নেই। মহা ভাবনায় পড়া গেল। এই দুর্যোগকালীন সময়ে কোথায় যেতে পারে। কত মানুষ বেঘোরে মারা যাচ্ছে। কোন হিসেব নেই। কোন বাদ-প্রতিবাদও নেই। সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। সুকুর মামু বললেন, ‘এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলে চলবে?’
‘কি করবো? খোকন বলে।
সুকুর মামু বলে, ‘খুঁজে দেখতে হবে।’
‘কোথায় খুঁজবো সুকুর ভাই?’
‘আশে পাশে। বাজারে...’ সুকুর মামুর কথা শেষ হয় না। থেমে যায়। জহুরুল বললো, ‘বাজারে যদি একা যেতে পারে তাহলে একা সে ফিরেও আসতে পারবে। তার জন্যে আমাদের অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, ‘আমি বুঝতে পারছি না, সে সকাল সকাল বাজারে যাবে কেন?’
‘হয়তো নাস্তা করতে গেছে।’ সুকুর মামু বললো।
বললাম, ‘নাস্তা খেতে যাবে, টাকা পাবে কোথায়?তার কাছেতো কোন টাকা পয়সা নেই।’
সবাই মৌনবৎ সমর্থন করলো আমার কথা। তারপরও বাজারে গিয়ে শাজাহানকে খুঁজলাম আমরা। না, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। সারাদিন ভীষণ উৎকণ্ঠায় কাটলো আমাদের।
আমরা নিয়ম বেঁধে দুইবেলা বাজারে গিয়ে মুড়ি আর কলা খাই। এই ধরণের খাওয়া-খাওয়ি করতে গিয়ে আমাদের অবশিষ্ট টাকা শেষ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আবার আমরা অখাদ্য খিচুড়ির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। বরাবরের মতো আমাদের যমুনা কোম্পানির সিরিয়াল পরে। আমাদের বন্ধু মোটা রাজ্জাক অতি খুধায় লাইন ভেঙ্গে মেঘনা কোম্পানির লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে ধরা পড়ে যায়। শাস্তিস্বরূপ তাকে থালা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে রাখা হয়। আমাদের সেই সরল বন্ধুটি মন খারাপ করে থালা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্য দেখে আমরা বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে থাকি। খুব মায়া হয়। কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না। সৈনিকের শৃঙ্খলা মানতে হয়। শৃঙ্খলা মানা একজন সৈনিকের জন্য একান্ত ফরজ।
লাইনে যখন আমাদের যমুনা কোম্পানির ডাক পড়ে তখন রাজ্জাকের শাস্তি শেষ হয়। তাকে আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়-কিন্তু সবার শেষে। সব মিলিয়ে বড় ধরণের শাস্তির মধ্যে পড়ে যায় আমাদের সহজ সরল বন্ধুটি।
এইভাবে লাঠি ট্রেনিং করে দিন দশেক কেটে যাবার পর আমাদের মধ্যে হতাশা আঁকড়ে ধরে। যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধের কোন নমুনা দেখতে পাচ্ছিলাম না আমরা। এই সময় একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের দেখা হয় ক্যাম্পে। তার নাম আলী ঈমাম তৌহিদ। আমরা তাঁকে তৌহিদ ভাই বলে চিনি। সুকুর মামুর বিশেষ পরিচিত। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে আমাদের গ্রামে সুকুর মামুর সঙ্গে দেখেছিলাম। তিনি শাহজাদপুর থেকে হেঁটে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছিলেন আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ সুকুর মামুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। খবর পেয়ে আমরাও ছুটে যাই তার কাছে। সুকুর মামু তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আরও বললেন, সে যুদ্ধ করার জন্য নিজেই একটি কামান তৈরি করেছেন। এই কথা শুনে তার প্রতি আমাদের সমীয় ভাব বেড়ে যায়। দেখতে অতি সুদর্শন। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। ফর্সা মায়াভরা মুখ। সুকুর মামুর বয়সী। তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তৌহিদ কথা বলেন নিচু গলায়, মিষ্টি ভাষায়।
বেশিক্ষণ আমাদের গ্রামে তিনি অবস্থান করলেন না। তাড়া আছে বলে চলে গেলেন। তাঁর হাতে একটি চটের ব্যাগ। সেটা নিয়ে আমাদের দেওয়া পথের নিশানা ধরে তিনি চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পর সুকুর মামু বললেন, ‘তার থলের মধ্যে কি ছিল জানিস?’
‘কি?’
সুকুর মামু বললেন, ‘থলের মধ্যে গ্রেনেড ছিল।’
আমরা তখনও গ্রেনেড কি জিনিস ভাল করে জানি না। শুধু নাম শুনেছি। আমরা আফসোস করতে লাগলাম, ‘ইস, আগে বললে আমরা জিনিসটা দেখতে পেতাম।’
ক্যাম্পে তৌহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সুকুর মামু তার সঙ্গে উচ্চতর ট্রেনিং, যুদ্ধ এইসব নিয়ে কথা বলেন। রাতে সুকুর মামু আমাদের বললেন, তৌহিদ বললো, তারা উচ্চতর ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আরও নাকি সময় লাগবে। শুনে আমাদের সবারই মন খারাপ। এখানে আমরা অযথা সময় নষ্ট করছি। পাকিস্তানিরা বাঙালি মেরে সাফ করে ফেললো আর আমরা যুদ্ধে এসে এখনও লাঠি ট্রেনিং করছি। আমাদের ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে অদ্ভুত একটি প্রস্তাব করে বসলেন সুকুর মামু। জহুরুলকে বললেন, ‘জহুরুল, তুই গ্রামে ফিরে যা। গিয়ে সবার বাবা মাকে বলে আরও কিছু টাকা নিয়ে আয়। ক্যাম্পের খাওয়া খেলে আমরা বেশিদিন টিকতে পারবো না।’
এই অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। বলে কি সে? এটা কিভাবে সম্ভব? এই ধরণের বিপদসংকুল পথ পারি দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যাওয়া কি সোজা কথা।
সুকুর মামু জহুরুলকে বললেন, ‘কিরে যেতে পারবি না?’
জহুরুল বললো, ‘আপনি বললে অবশ্যই পারব।’
জহুরুলের জবাব শুনে আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। আমরা জানি, তারা অসম বয়সী হলেও তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। দুজনের গলায় গলায় ভাব। অগ্রজের প্রতি কতটা বিশ্বস্ত হলে এমন কঠিন প্রস্তাবে রাজি হওয়া সম্ভব। আমি বা অন্য যে কেউ এমন প্রস্তাবে রাজি হবে না।
ঠিক হলো পরদিন জহুরুল গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আমরা সবাই বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে টাকা চেয়ে চিঠি লিখলাম। লিখলাম, আমরা ভাল আছি। আমাদের নিয়ে চিন্তা করো না। আমরা দেশ স্বাধীন করে তবে ঘরে ফিরবো।
পরদিন জহুরুলকে বিদায় জানাতে মাইনকারচর এলাম সবাই। ফিরতি নৌকায় জহুরুলকে তুলে দিয়ে অশ্রুসজল নয়নে তাকে বিদায় জানালাম আমরা। [চলবে]
(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)
(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours