ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

উচ্চতর গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের জঙ্গলে আনা হলো। মূল ক্যাম্প থেকে ১০/১২ মাইল উত্তরে একটি জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে নিয়ে আসা হলো ট্রাকে করে। এতদিন যে সমস্ত পাহাড়ে আমরা বাস করেছি সেগুলো মোটামুটি বাসযোগ্য ছিল। এই পাহাড়টা নানা ধরণের কাঁটা আর ঝাড়-জঙ্গলে ঘেরা। বড় বড় গাছ-গাছালিও অনেক। মোট কথা জায়গাটা বসবাসের অযোগ্য। সারাক্ষণ ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তিনদিন আমরা একবারের জন্য সূর্যের মুখ দেখিনি। কখনও কখনও ঝুমাঝুম বৃষ্টি। আবার কখনও গুড়ি গুড়ি। ঝুমাঝুম বৃষ্টির সময় আমরা পলিথিন মাথায় দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করি। ওখানে যাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম জায়গাটা ভীষণ বিপজ্জনক। সেকেন্ডে সেকেন্ডে জোঁক এসে আমাদের আক্রমণ শুরু করলো। জোঁকগুলো নিজের শরীরে অদ্ভুত ভাবে ঢেউ খেলে সামনে এগুতে থাকে। দেশ-গ্রামে এই জোঁককে আমরা বলি চীনা জোঁক। আকারে ছোট কিন্তু শরীর এমন ভাবে কামড়ে ধরে মুহূর্তে কঠিন ঝিল্কানি শুরু হয়ে যায়। বেশি ভয় কোনভাবে এই জোঁক যদি শরীরের গোপন জায়গায় ঢুকে পেটে গিয়ে নাড়িভুঁড়ি আক্রান্ত করে। একজন সহযোদ্ধা দারুন একটি সিস্টেম শেখাল। আমরা সবাই তার শেখানো সিস্টেম ফলো করতে লাগলাম। প্রথমে জাঙ্গিয়া পরি। তারউপর লুঙ্গিতে মালকোঁচা মারি। তারউপর আবার জাঙ্গিয়া। তারউপর ফুলপ্যান্ট। প্যান্টের নিচের অংশ মোজার ভেতর ঢুকিয়ে রশি দিয়ে মোজা বেঁধে রাখি। যাতে জোঁক গোপন অঙ্গে প্রবেশ করতে না পারে।        

নিরাপত্তার জন্য আমাদের সবই দেওয়া হলো। শুধু খাদ্য বাদে। শাবল, বেলচা, মোটা দড়ি, পলিথিন এবং রাইফেল দেওয়া হলো। রাইফেলের গুলি দেওয়া হলো, সেগুলো ডামি গুলি। মোটা দড়ি কেন দেওয়া হলো সেটা তখন বুঝিনি, বুঝলাম পরে।

পলিথিন দিয়ে আমরা অনেকগুলো কুঁড়েঘর তৈরি করলাম। পলিথিনের শেষাংশ মাটির নিচে কাদা দিয়ে লেপে দিলাম যাতে জোঁক কুঁড়েঘরে প্রবেশ করতে না পারে। সেই কুঁড়েঘরে আমরা ৪/৫ জন গাদাগাদি করে রাতে শুয়ে থাকতাম। নির্ঘুম কাটতো রাতগুলো। শুধু নিরুদ্বিগ্নে সময় পার করা। 

গাছের ডালে রশি ঝুলিয়ে আমরা দোলনা বানালাম। দিনের বেলা জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে আমরা দোলনায় ঝুলতাম। দোলনা তৈরি করার সময় আমরা বুঝতে পারলাম মোটা মোটা রশি কেন দেওয়া হয়েছিল। 

প্রাথমিক কাজগুলো সাড়ার পর তীব্র ক্ষুধা অনুভব হলো। আকাশ গোমড়া থাকায় সময় বোঝা যাচ্ছিল না। একজনকে সময় জিজ্ঞেস করতে ঘড়ি দেখে বললো চারটে বাজে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় সাড়ে চারটে। ক্ষুধা লাগার কারণ বোঝা গেল। সকালের দুই পরোটা এতক্ষণ পেটের মধ্যে থাকার কথা নয়। কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আমরা কয়েকজন খাদ্য অন্বশনে বের হলাম। ঝোড়জঙ্গল পেরিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আমরা পাহাড়ের ঢালুতে দেখতে পেলাম অনেক গুলো পেয়ারা গাছ। ততক্ষণে কাঁটার আঁচড়ে আমাদের শরীর রক্তাক্ত। তারপরও অজস্র পাকা পেয়ারা দেখে আমাদের মন আনন্দে উতফুল্ল হয়ে উঠলো। গাছে চড়ে ছোটবেলার মতো গান গাইতে গাইতে পেয়ারা খেতে থাকলাম। অপূর্ব স্বাদ সেই পাহাড়ি পেয়ারার। যা মনে থাকবে আজীবন। স্বাদটা ক্ষুধার কারণে কিনা বুঝতে পারলাম না। খেতে খেতে একবন্ধুর আনন্দ চিৎকার। ইউরেকা। সে আঙ্গুল তুলে দেখালো অদূরে অনেকগুলো কলার কাধি। গাছেই পেকে গোলাপি বর্ণ হয়ে আছে। পেয়ারা খাওয়ার পর আমরা গপাগপ কয়েকটি কলাও খেয়ে ফেললাম। একজন বললো, বেশি খাওয়ার দরকার নেই। পেটের মধ্যে গড়বড় হতে পারে। বাকি কলার কাধি আমরা ঘাড়ে করে আমাদের বন্ধুদের জন্য নিয়ে এলাম। পাকা কলা দেখে বন্ধুরা আনন্দে হৈহৈ করে উঠলো। সবাই খুব মজা করে খেতে লাগলো। 

কম্যান্ডার পান্না ভাই বললেন, ‘রাতের জন্য আরও কলা এবং পেয়ারা সংগ্রহ করে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে দেখতে হবে আরও কোন ফল পাওয়া যায় কিনা।’ খুঁজতে খুঁজতে আমরা নাশপাতি এবং গাবের মতো কিছু ফল পেলাম। ফলটা যেহেতু আমাদের কাছে অচেনা অপরিচিত, তাই কেউ খেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমাদের মধ্যে একজন পর্যটক ছিল যে অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। পাহাড়েও ঘুরেছে, সে বললো, ‘এটা গাব প্রজাতির ফল। পাহাড়ি গাব বলতে পারিস। খেয়ে দেখ খুব মজা। খুব উপকারি।’ এই বলে সে খাওয়া শুরু করলে ওর দেখদেখি আমরাও শুরু করলাম খাওয়া। সত্যি ভীষণ মিষ্টি। টেস্টটা গাবের মতো নয়। অন্যরকম। তবে গাবের মতো বিচি আছে ভেতরে। আরও একটি ফলগাছ দেখলাম। অজস্র ফল ধরে আছে থোকায় থোকায়।  মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফলটিকে আমরা গ্রামের ভাষায় বলি আতা ফল। ভেতরে বিচি আছে। গ্রামের আতা ফল খেয়ে আমি মজা পেতাম না। কেমন ঘষি ঘষি লাগতো। কিন্তু পাহাড়ের আতা ফল খেয়ে আমি ভীষণ অভিভূত। দুইয়ের মধ্যে এতো পার্থক্য আমাকে রীতিমত অবাক করে দেয়। হয়তো মাটির কারণে এই পার্থক্য। আমাদের অঞ্চলের  আম একরকম। আবার সেই আম চাপাই নবাবগঞ্জে হলে অন্য স্বাদ। 

সন্ধ্যার পর আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। অদ্ভুত ধরণের ট্রেনিং। আমরা যে পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছি দূরে আরও একটি পাহাড়ে আমাদের সহযোদ্ধাদের একটি দল সেখানে অবস্থান নিয়েছে। আমরা তাদের পাকআর্মি মনে করবো। ওরাও আমাদের পাকআর্মি মনে করবে। অর্থাৎ আমরা পরস্পরের শত্রু। ওই ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। এয়াম্বুশ করে কৌশলে ওদের বন্দি করতে হবে। কেউ কাউকে আঘাত করতে পারবে না। রাইফেলে শুধু ডামি গুলি থাকবে। সেটাও ব্যবহার করা যাবে না। পাহাড়ি জঙ্গল মাড়িয়ে রাতের অন্ধকারে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কি যে ভয়ংকর দুর্গম পথ সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। অধিকাংশ জঙ্গলা গাছ কাঁটা সম্বলিত। গায়ে আঁচড় লেগে ছুলে যাচ্ছে। কেউ কেউ পথ ভুল করে জঙ্গলে আটকে যাচ্ছে। ওই পাহাড়ে কাছে গিয়ে আমরা এয়াম্বুশ করলাম। ওরাও আমাদের ধরতে বেরিয়ে পড়েছিল। অদের ছোট্ট একটি দল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা তাদের বন্দি করে আমাদের অবস্থানে নিয়ে আসি। কিছুক্ষণ তাদের বন্দিদশায় রেখে তারপর ফল খেতে দিয়ে ওদের বিদায় করি। আমাদের আরেকটি দল ওদের একজনকে বন্দি করে নিয়ে আসে। কিন্তু তাঁকে বন্দি করেই রেখে দেয়। মশা আর জোঁকের কামড়ে সকালে তাঁকে আমরা জ্ঞানহীন অবস্থায় উদ্ধার করি। তাঁকে সেবা শুশ্রসা করে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলি। তারপর তাকে আমরা সসম্মানে বিদায় দেই। 

আমাদের রাত কাটে নির্ঘুম। বৃষ্টি ভেজা পরিবেশে কিভাবে ঘুম আসে? দোলনায় দোল খেতে খেতে একদিন খেয়ালের বশে মোটা একটি গাছের উঁচু কাণ্ডে চাকু দিয়ে গাছের ছাল বাকল কেটে খোদাই করে নিজের নাম লিখলাম। আবার যদি কোনদিন এখানে আসার সুযোগ হয় তখন দেখবো নামটি আছে না নেই। কিন্তু সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আর কি হবে তেমন সুযোগ? পুরনো সেই জায়গা গুলোতে আবার ঘুরে ফিরে দেখতে মন আকুলি বিকুলি করে। শুধু জানতে ইচ্ছে হয়, কিশোর বয়সে যে জায়গাগুলো আমাদের আশ্রয় দিয়ে আপন করে নিয়েছিল, জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেই জায়গাগুলো এখন কিভাবে আমাদের গ্রহণ করে? 

অবশেষে তিনদিন কাটলো। তিনদিন নয় যেন তিন বছর। এই তিনদিন আমরা ঘুমাতে পারিনি। পেটে ভাত তরকারি জোটেনি। গোসল করা হয়নি। বলা যায়, আধুনিক গুহামানব হিসেবে ছিলাম আমরা। তিনদিন পর যখন আমরা ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম যেন বুকের উপর থেকে ভারী পাথর নেমে গেল। আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারো মুখের দিকেই তাকানো যাচ্ছিল না। সবার চেহারাই বিধ্বস্ত। মনের আনন্দে আমরা পথ চলছি। সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। আসার সময় আমাদের নিয়ে এসেছিল ট্রাকে করে। এখন যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। পায়ে হেঁটেই নাকি আমাদের মূল ক্যাম্পে ফিরতে হবে। আমাদের সঙ্গে আমাদের ওস্তাদরা এবং বাঙালি ক্যাপ্টেন বাবুও আছেন। 

কি আর করা। হেঁটেই যেতে হবে। কাধে রাইফেল। নিজেদের ব্যাগে কাপড়চোপড় সব মিলিয়ে ১০/১৫ সের ওজনের জিনিস নিয়ে আমরা হাঁটছি। ক্ষুধায় কাতর। সকালে পেটে কিছু জোটেনি। ১০/১২ মাইল মাত্র পথ কিন্তু মনে হচ্ছে ১০ হাজার মাইল। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা। জন মনুষ্য শূন্য। মাঝে মাঝে ভারতীয় আর্মির ট্রাক ছুটে যায়। যেতে যেতে তারা আমাদের দেখে জয়বাংলা বলে সম্ভাষণ করে। আমরাও গলা ফাটিয়ে দুপাশের পাহাড় কাঁপিয়ে জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে উঠি। একটু পর আবার সব সুনসান নিরবতা। 

দুপুরের দিকে তিন রাস্তার মোহনায় খোলা জায়গায় বিশ্রামের জন্য আমাদের থামানো হলো। একটি ট্রাক এসে থামলো আমাদের সামনে। আমাদের জন্য খাওয়া নিয়ে এসেছে। সবার হাতে একটি পারুটি ধরিয়ে দেওয়া হলো। ক্ষুধার পেটে শুকনো সেই পারুটি অমৃত মনে হচ্ছিল। পারুটি খেয়ে ঝর্ণার টলটলে জল পান করলাম গলা পর্যন্ত। যেন সহসা খিধে আর না লাগে। পেট ভরে পানি খাওয়ার পর শরীর একেবারে ছেড়ে দিল। ক্লান্তি চেপে ধরলো মুচড়িয়ে। ক্লান্ত হয়ে সবাই গাছের ছায়ায় বসে গা এলিয়ে দিয়েছে। এইসময় ওস্তাদের বাঁশি। তারমানে আমাদের আবার হাঁটতে হবে। চলতে হবে সামনে। থামলে চলবে না। ওস্তাদের দ্বিতীয় বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেকশন কমান্ডার আশরাফ ভাই হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন, ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা। পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো বলো কবে শীতল হবো, কতদূর আর কতদূর বলো মা।'

পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে গানটা এমনভাবে মিলে গেল যে আমরা তন্ময় হয়ে গানের মধ্যে ডুবে গেলাম। পরে জেনেছি এবং দেখেছি এটা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ সিনেমায় হেমন্ত মুখপাধ্যায় গাওয়া একটি গান। সিনেমায় একদল তীর্থযাত্রী মরুভূমি পেরিয়ে যাওয়ার সময় একজন এই গানটি গাইতে থাকেন। সঙ্গিরা গানের সঙ্গে পো ধরেন, ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা।’ 

ক্লান্ত শরীরে হাঁটতে হাঁটতে আমারও কেবলি মনে হচ্ছিল, ‘কতদূর আর কতদূর’ বলো মা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও আমার মনে হয়, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো বলো কবে শীতল হবো, কতদূর আর কতদূর বলো মা।’ [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours