ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ: 

অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটলো। আমরা ‘বড়ইতলি’ নামের একটি গ্রামে আশ্রয় নিলাম। আমরা প্রায় একশজন মুক্তিযোদ্ধা একজন ধনী মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে এসে উঠলাম। তারা যে পাকিস্তানের সহযোগী এটা জেনেই আমরা ওই বাড়িতে উঠেছি। বলা যায় আমরা ইচ্ছা করেই ওই বাড়িতে শেল্টার নিয়েছি। বাড়ির লোকজনকে আমরা গৃহবন্দি করে রেখেছি। যেন তারা বের হয়ে তাদের বাপ পাকিস্তানিদের খবর দিতে না পারে। 

বিরাট লম্বা প্যাটার্নের বাড়ি। লম্বা উঠোন। সেই উঠোনে আমরা সকাল বিকাল অস্ত্রের মহড়া দেই। শরীর চর্চা করি। আর তাদের পুকুরের মাছ মেরে গ্রামবাসীদের দিয়ে রান্না করে আমরা আয়েশ করে খাই। কাজটা যদিও গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম বহির্ভূত এবং বিপদ সংকুল ছিল। তারপরও তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে কাজটি আমরা করেছি। প্রায় এক সপ্তাহখানেক আমরা ওই বাড়িতে থেকেছি। রাজাকার বাড়ির গরু জবাই করে গ্রামবাসীদের দিয়ে মাংস কেটে তাদের দিয়ে রান্না করিয়ে খেতাম। তখন আমাদের ভাবটা ছিল আমরা যুদ্ধে আসিনি। যেন পিকনিকে এসেছি। আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ছিলাম আমরা।                          

এটা ছিল আমাদের বিপজ্জনক মিশন। তবে সেখানে দলের সঙ্গে আমরা [আমি আসগর এবং মলয়] বেশিদিন থাকিনি। বড়ইতলি থেকে আমরা খবর পেলাম, আমাদের মূল দল বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারা অবস্থান করছে সিরাজগঞ্জ শররের কাছাকাছি ‘সাইতানতলি’ গ্রামে। সেখানে আমাদের রফিকুল আলম এবং জহুরুল খান আছে। তারা দুজনই আমাদের গ্রামের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে গ্রাম থেকে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেছিলাম। রফিকুল আলম আমাদের গুরু। তার নেতৃত্বেই আমরা যুদ্ধে এসেছি। হাতিবান্ধা যুদ্ধে থেকে রফিকুল আলম ক্যাম্পে না ফিরে অন্যদের সঙ্গে মাইনকারচর গিয়ে মরণটিলা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকেই তারা দেশে এসেছেন। রফিক মামু আসার সময় জহুরুলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। জহুরুল তখন রউমারিতে গ্রামের আর তিনজনের সঙ্গে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছিছিলেন। রফিক মামুর আহবান উপেক্ষা করতে পারেনি জহুরুল। 

আমি মলয় এবং আসগর পরামর্শ করে আমাদের মূলদলে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই। তারপর আমরা কমান্ডার আশরাফ ভাইয়ের কাছে অনুমতির জন্য যাই। আশরাফভাইকে ছেড়ে যেতে আমাদের খুব খারাপ লাগছিলো। অনুরূপভাবে আশরাফভাইয়েরও আমাদের দল ত্যাগের অনুমতি দিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সেটা তার মলিন মুখ দেখেই আমরা বুঝতে পারছিলাম। বিষণ্ণ মুখে তিনি আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু বিদায়ের সময় আমরা কেউই আবেগ অবদমন করতে পারলাম না। আশরাফভাই আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমরাও চোখের পানি সংবরণ করতে পারলাম না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানি না। সাবধানে থেক। আগে নিজের জীবন তারপর যুদ্ধ। আবেগে কিছু করতে যেও না।’ আশরাফভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ‘সাইতানতলি’ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আসগরের কাধে স্টেনগান, আমার কাধে এসএলআর, মলয়ের কাধে রাইফেল। সঙ্গে যার যার ব্যাগ।

পথ চলতে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা ছিল আমাদের মনে। অস্ত্র কাধে মাত্র তিনজন মানুষ প্রকাশ্যে চলাফেরা নিরাপত্তার জন্য বড় ধরণের হুমকি। ১০/১২ জনের রাজাকারের দল আমাদের তিনজনকে কিছু করতে পারবে না। আমাদের একটি স্টেনগানই ওদের আটকানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ওরা সংখ্যায় বেশি হলে বিপদ হতে পারে। আমাদের বেশি ভয় পথে কোন মুক্তিযোদ্ধা দলের হাতে পড়লে। আমাদের তখন কঠিন জেরার মুখে পড়তে হবে। আমরা যে মুক্তিযোদ্ধা সেটা প্রমাণ করা যদিও খুব বেশি কঠিন হবে না। তারপরও কখন কি হয়ে যায় বলা শক্ত। আমাদের স্টেনগান আর এসএলআর আমাদের বড় সাক্ষী। কারণ রাজাকারদের হাতে ভারতীয় অস্ত্র স্টেনগান এবং এসএলআর থাকার কথা নয়। 

আমরা সড়ক পথ ছেড়ে গ্রামের আল পথ এবং হালোট পথ ধরে হাঁটছি। দুপুর পেড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড খিধে লাগলেও করার কিছু ছিল না। পথ চলতেই হবে। 

চলতে চলতে একটি গ্রাম্য হাটের কাছে এসে পথ থেমে গেল। আশে পাশে খালবিল। একমাত্র পথ হাটের লাগোয়া সড়ক পথ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল হাটের নাম রতনকান্দি হাট। কি আর করা, হাটের পাশের রাস্তা ধরে আমরা চলতে থাকলাম। হাটের লোকজন গভীর কৌতূহলে আমাদের দেখে। কিছুদুর যাওয়ার পর একটি দৃশ্য আমাদের ভীষণ উত্তেজিত করে তুললো। দেখলাম ১০/১২ জনের একটি অস্ত্রধারি দল মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙ্গিয়ে হাটের দোকানিদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নিচ্ছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আমরা ওদের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। পরক্ষণে ওদের সদস্য সংখ্যা বেশি দেখে আমরা প্রচণ্ড মনকষ্ট নিয়ে প্রতিরোধের চিন্তা বাদ দিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু মনের খুঁত খুঁতি কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। আমরা দেশের মানুষকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে যুদ্ধ করছি। আর ওরা মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙ্গিয়ে জোর করে চাঁদাবাজি করছে। জানা গেল ওদের লিডারের নাম ইসমাইল। সিরাজগঞ্জ শহরতলি একটি গ্রামের বাসিন্দা। তারা নাকি সুযোগ বুঝে ডাকাতিও করে। এতো কিছু জানার পর তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা মনে মনে শপথ নেই। দলে ফিরে কমান্ডারকে এই তথ্য জানিয়ে এর একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। 

‘সাইতানতলি’ পৌছতে পৌছতে রাত হয়ে গেল। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছিল। কিন্তু প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। জহুরুলকে পেয়ে আমরা খুশিতে আত্মহারা। কারণ জহুরুল আমাদের দলে ছিল না। ও ছিল রাজ্জাক মোস্তফা এবং খোকনের সঙ্গে। আমি নিশ্চিত জহুরুল এসেছে রফিকুল আলম সুকুর মামুর কথায়। হ্যা আমার অনুমান সঠিক। জহুরুল সে কথা স্বীকার করলো। রফিকুল আলম সুকুর, আমার সুকুর মামু যে কিনা আমাদের প্রাণভ্রমরা। আমাদের আনন্দের একমাত্র উৎস। তাঁকে পেয়ে আমরা খুশিতে আটখানা। দেখামাত্র বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অবাক হলেন মলয়কে দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, মলয়কে আমরা কোথায় পেলাম? মলয়ের যুদ্ধে যোগ দেওয়া ওর প্রশিক্ষণ সবই বিস্তারিত বললাম। হঠাৎ দেখলাম জহুরুলের সঙ্গে মলয়ের মৃদু বচসা হচ্ছে। যুদ্ধে যাওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে রউমারি ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে জহুরুলকে আমরা টাকার জন্য সবার বাবা-মাকে চিঠি লিখে গ্রামে পাঠিয়েছিলাম। সেই বিপদসংকুল গল্প অনেক আগেই বর্ণনা করেছি। জহুরুল গ্রামে যাওয়ার পর মলয়ের সঙ্গে তার দেখা। জহুরুলের গ্রামে ফিরে আসার কারণ জেনে মলয় যুদ্ধে যাবার ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করে। নিজের কাপড়চোপড় একটি ব্যাগে ভরে গোপনে জহুরুলের কাছে দিয়ে রেখেছিল। পরেরদিন ঝারা হাতপা অবস্থায় মলয় জহুরুলের সঙ্গ নেবে। কিন্তু জহুরুল নিজের ব্যস্ততায় মলয়কে সঙ্গে নিতে পারেনি। যে কারণে ভারতে তার উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। অগত্যা আমাদের সঙ্গে এসে কোনরকমে জোড়াতালি প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। এটাই মলয়ের ক্ষোভের কারণ।

জহুরুল বললো, ‘তোরতো কৃষকবাজারে আসার কথা ছিল। আমি তোর জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। শেষপর্যন্ত তোর কোন খবর না পেয়ে আমি নৌকায় চড়ে সলপ স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। এখানে আমার দোষ কোথায়?’ 

মলয় বললো, ‘তুই ঠিক বলছিস না। কথা ছিল তুই আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসবি।’ 

জহুরুল বাঁধা দিয়ে বললো, ‘আমি ছিলাম নানান ভেজালে। বাজারে জয়নাল দেওয়ান টাকা দেবে বলেছিলেন। এইজন্যে তোকে আমি বাজারে থাকতে বলেছিলাম। আমি কিন্তু তোর জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। তারপর তোর কোন খবর না পেয়ে কি আর করবো, আমি বাধ্য হয়ে রওনা দিলাম।’

ওদের মৃদু বচসা থামালেন রফিক মামু। বললেন, ‘শেষপর্যন্ত আইসা পড়ছো। ব্যস ঘটনা শেষ। এই নিয়ে আর কথা কেন?’ 

থেমে গেল ওদের মৃদু বচসা। তর্ক বচসা যাই বলি না কেন, সবই হচ্ছিল আনন্দের অবগাহনে। অনেকদিন পর আমরা একত্রিত হয়েছি সেই আনন্দে আমরা আত্মহারা। 

খাওয়া-দাওয়ার পর কমান্ডার তৌহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রফিক মামুর কাছে জানলাম কমান্ডার বদলে গেছে। উচ্চতর প্রশিক্ষণের যাওয়ার আগে মাইনকাচর মরনটিলা ইয়ুথ ক্যাম্পে যখন ছিলাম তখন অলিখিত কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন এই তৌহিদভাই। পুরো নাম আলী ইমাম তৌহিদ। তার পিতা তৈয়ব আলী সিরাজগঞ্জ সরকারি বি এল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ভীষণ রাশভারী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ছাত্ররা তাঁকে ভীষণ ভয় পেত। তাঁর ছেলে তৌহিদ ছিল অমায়িক স্বভাবের সজ্জন মানুষ। কথা বলেন মিষ্টি ভাষায়। তাঁর মুখে কখনও বেফাঁস কথা শুনিনি। তাঁর একটি ভদ্রকথা শুনে আমরা খিল খিল করে হাসতাম। আমাদের পরিচিত একজন ছাত্রনেতা তার নাম হামিদ। সে কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করে পাতিলের মধ্যে রাখতো। ট্র্যাঙ্ক বা ভাল সুটকেস না থাকায় কাপড় রাখতো সে পাতিলের মধ্যে। তাইতো তার নাম হয়ে যায় ‘পাইল্লা হামিদ’। সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাতিলকে আঞ্চললিক ভাষায় ‘পাইল্লা’ বলে। সেই পাইল্লা নামেই সে পরিচিতি পেয়ে যায়। সবাই তাকে পাইল্লা হামিল বলে ডাকতো। তৌহিদ ভাই তার নাম বলতেন ‘পাতিল হামিদ’। তার মুখে এই পাতিল হামিদ উচ্চারণ আমরা ভীষণ এঞ্জয় করতাম। প্রচণ্ড হাসির খোরাক যোগাতো আমাদের।

ভারতের তুরা পাহাড়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণে গিয়ে কমান্ডার হলেন টি এইচ শামীম পান্না ভাই। হাতিবান্ধা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মাইনকাচর মরনটিলা পাহাড়ে ফিরে গেলে আবার কমান্ডার বদলে তৌহিদভাই আবার কমান্ডার হয়ে গেলেন। মরনটিলা ইয়ুথ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজগঞ্জের এমপি সৈয়দ হায়দার আলী। তিনি তৌহিদভাইকে ভীষণ পছন্দ করতেন। তাঁর পছন্দের কারণে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে তৌহিদভাই হয়ে গেলেন আমাদের নতুন কমান্ডার। [চলবে] 

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours