সুমিত তালুকদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, নৈহাটি, উত্তর ২৪পরগনা:
শারীরিক নির্যাতনের নাকি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মাঝরাতে গোপনে দাউদাউ আগুনে পুড়ে খাক হল তবে কার দেহ? প্রশাসন চেয়েছিল নানাভাবে মিথ্যা কেস সাজিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার। প্রয়োজনে নির্যাতিতার পরিবারের বয়ানেরও পরিবর্তন করে দিয়েছিল। গণতান্ত্রিক দেশে স্বাভাবিক ভাবে তাই সেদিন প্রশ্ন উঠেছিল, তবে এ কার মৃতদেহ, কেন অজ্ঞাতসারে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, কেন এত গোপনীয়তা? কোন সদুত্তর ছিল না। আসলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ও গোপন দাহকার্যে আগুনে পোড়া শরীরটার মতোই উত্তরপ্রদেশ সরকারের মুখ পুড়েছিল হাথরস ধর্ষণ কাণ্ডে। সুতরাং অগ্নিদগ্ধ মুখ নিয়ে জনতার দরবারে অপ্রিয় সত্য বলার সৎসাহস ছিল না। অবাধ্য ছাত্রের মতো শিক্ষাও নেয়নি দেশ জুড়ে ঘটে চলা একের পর এক নারকীয় নারী নির্যাতনের ঘটনা থেকে। উন্নাও থেকে নির্ভয়া -- কলকাতার পার্কস্ট্রিট কান্ড থেকে , হায়দ্রাবাদের প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি হত্যাকাণ্ড ও এনকাউন্টার থেকে, সিঙ্গুরের তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ডের থেকে কোনো শিক্ষাই স্বচ্ছ ভারতের রূপকারেরা গ্রহণ করেনি। ফলত করোনা বছরে হাথরসের নৃশংস গণ শ্লীলতাহানির ঘটনার সাক্ষী থাকল গোটা দেশ।
কেন হাথরসের তরুণীকে পাশবিক নির্যাতন, শরীরে রক্তাক্ত ক্ষত নিয়ে অসহায়ভাবে মরতে হলো? নারী বলে কি? নাকি দলিত শ্রেণীর বলে? বিতর্ক পিছু ছাড়ছিল না। প্রশ্ন উঠেছিল জাতপাতের, উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের শ্রেণী সংঘাতের যা উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির বীজ গণিত, পাটি গণিতের হিসেবনিকেশ। কেন বারবার দলিত সংখ্যালঘু শ্রেণীর উপর আক্রমণ—রোহিত ভেমুলা থেকে চুনি কোটাল? গণ শ্লীলতাহানির শিকার হাথরসের তরুণীও ছিল দলিত শ্রেণীর। জাতপাতের রাজনীতি বাদ দিলেও সাধারণভাবে বলা যায় আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা, মেয়েরা, আমাদের মা বোনেরা কত অসহায় এবং সহজলভ্য শিকার। মেয়ে হয়ে জন্মানোই তার অপরাধ। কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকে নাবালিকা বিবাহ, গার্হস্থ্য হিংসা, পণ প্রথার বলি থেকে নারী পাচার, শ্লীলতাহানি সর্বত্র নারীরা আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত, অত্যাচারিত। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ‘কন্যাশ্রী‘–রা তাদের নূন্যতম প্রাপ্য সম্মান, অধিকার, সম্ভ্রম রক্ষা ও সুরক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত। ২০১৫ সালে চালু হয়েছিল “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও“ আন্দোলন ও প্রকল্প। কিন্তু কতজন বেটিকে আমরা বাঁচাতে পেরেছি? কতজন কন্যা সন্তানের সুরক্ষা দিতে পেরেছি? শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পেরেছি? গালভরা স্লোগানসর্বস্ব হয়েই থেকেছে, বাস্তব প্রযোগে তেমন সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
আজও তাই উন্নাও, নির্ভয়া, হাথরসের মতো নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে চলেছে। দু একটি বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রে চরম শাস্তির মতো ফাঁসি অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘিত এনকাউন্টার করেও কোনো সুরাহা হয়নি। বরং করোনা ভয়ে লকডাউনের ফলে অপরাধ করার প্রবণতা সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু আনলক পর্বে অপরাধের ধারাবাহিকতা আবার পূর্বের ন্যায় বজায় থেকেছে। যদিও সংগঠিত অপরাধের আবার লক আনলক। যাহোক দৃষ্টান্তমূলক হাথরসের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল স্বচ্ছ ভারতে নারীরা আজও কত বিপন্ন ও অরক্ষিত। “ন্যাশনাল ক্রাইমস রেকর্ডস ব্যুরো- র তথ্য অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে গত বছর ২০১৯ এ নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল ৫৯ হাজার ৮৫২ টি। গোটা দেশের মধ্যে এক নম্বর।“ (নারী নির্যাতনে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, আজকাল, ৭/১০/২০) হাথরসের ঘটনা গেরুয়া শাসিত রাজ্যের নারী নির্যাতন রোধে চূড়ান্ত ব্যর্থতাই আরও একবার প্রমাণ করল। সরকার বারবার অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ‘স্বচ্ছ‘ থাকার দাবি করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নারী নির্যাতন রোধে আরও স্বচ্ছতা, সুরক্ষা ও সুবিচার প্রয়োজন নতুবা হাথরস কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে। পাশাপাশি যথারীতি লোক দেখানো তদন্ত হবে আর বহুরূপী বুদ্ধিজীবীদের মোমবাতি হাতে মিছিল চলতে থাকবে। মানবাধিকার কর্মী ও নারীবাদী আন্দোলনকারীরাও চুপ করে বসে থাকবে না। নেতারাও রাজনীতির রঙ চড়াবে।
(www.theoffnews.com Indian politics rape)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours