প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:

বেশ জাঁকিয়ে শীতটা পড়েছিল। শীত শীত ভাব রূপসী বাংলা জুড়ে। 

সন্ধ্যা থেকেই গ্রাম বাংলার পথ ঘাট ঘন কুয়াশার আচ্ছাদনে আবৃত হয়ে পড়ছে। ভোর হতে না হতেই খেঁজুর রসে জ্বাল পড়ছে নলেন গুড় তৈরির জন্য।  

সদ্যজাত সারমেয় শাবকের দল একে অপরের গায়ে উঠে উষ্ণতার আস্বাদন নিচ্ছে। 

সেদিন ২২সে ডিসেম্বর, ২০২০। 

 সন্ধ্যায় আর বেশিক্ষণ খোলা আকাশের নিচে থাকতে মন চাইছে না। হিমেল বাতাস তিরতির করে বয়ে চলায় বেশ শীত  অনুভব করছি। দুচাকার ইঞ্জিন যানে উঠতেই ক্রিং ক্রিং ডাক। 

কে আবার এই অসময়ে ফোন করল?

পকেটে হাত দিয়ে মুঠো ফোন বার করে দেখি অনির্বানের ডাক। ভাবছি ফোনটা না ধরলেই নয়। অনির্বান আমার বিশেষ প্রিয় মানুষ। মুঠোফোনের বোতামে হাত দিয়ে কথা বলা শুরু করতেই কিছুক্ষন আলাপচারিতার পরই বললে পিকনিকের কথা। জানতে চাওয়ায় বললে আগামী কাল ওরা বাগুরান-জলপাই যাচ্ছে পিকনিক করতে। আমাকেও ওদের সাথে যেতে হবে। অফবিট গন্তব্য। 

বাগুরান-জলপাই পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার একটি স্বল্প পরিচিত সমুদ্র সৈকত। কলকাতার লোকজনদের অনেকের কাছেই অপরিচিত জায়গা। বিচের কাছাকাছি একটি মাত্র রিসর্ট গড়ে উঠেছে। গ্রাম্য সহজ সরলতা এখনো মানুষের চোখে মুখে। দিগন্ত বিস্তৃত ঝাউবন আর বালিয়াড়িতে একটা দিন ভালোই কেটে গেলো। জলপাইয়ের মূল আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। 

পকেটে ফোন রেখে বাড়ি ফিরে ইউ টিউব চ্যানেলে দেখতে লাগলাম বাগুরাই-জলপাইয়ের দর্শনীয় স্থানগুলি। কোথাও ভ্রমণে যাবার আগে খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জেনে নেওয়া আমার এক আদিম অভ্যাস। যাই হোক পরের দিন ডিউটি সেরে কালনা থেকে বিকাল ৫ টার ট্রেন ধরে বেরিয়ে পড়লাম বন্ধু অনির্বানের বাড়ি হরিপালের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকেই সেদিন আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। 

অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়নি। অল্পক্ষণের ভ্রমন তবুও সেইদিন সন্ধ্যা থেকেই এক অব্যক্ত আনন্দ অনুভব করছিলাম। তাছাড়া হরিপাল জায়গাটাও আমার কাছে অচেনা। অনির্বান দীর্ঘদিনের বন্ধু হলেও ওদের বাড়িতে আগে কখনোই আসা হয়নি।  ইচ্ছা আছে হরিপাল ও আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো একটু দেখে নেওয়ার। যাই হোক, কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালটা ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে যন্ত্রণার বছর। ইচ্ছা থাকলেও কোভিড আতঙ্কে আমরা অনেকেই বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারিনি।  নয়ত এবছর ভালোই ঠান্ডা পড়েছে, পরিস্থিতি ভালো থাকলে নিশ্চয় অনেকেই হয়ত এই ডিসেম্বরে পাহাড় অথবা মরুমুখী হতেন। 

রাত্রি ১০ টার মধ্যেই বন্ধু পত্নী জয়শ্রীর হাতের রান্না খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। এরপর অনির্বানের ডাকে ঘুম ভাঙতেই রাত্রি ১২ টা নাগাদ শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে আমরা রওনা দিলাম হরিপাল চৌধুরীপাড়া ক্লাবের সন্নিকটে। এখান থেকেই বাসে করে আমরা রওনা দেব কাঁথির বাগুরাই সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। বাসের কাছে পৌঁছে দেখি অন্যান্য সহযাত্রীরা ততক্ষনে আনন্দে মেতে উঠেছেন। অনেকে আবার পিকনিকের সরঞ্জাম বাসের ছাদে তুলতে ব্যস্ত। সকলেই উপস্থিত, বুঝলাম আমাদের জন্যই একটু দেরি হলো। রাত্রি ১২.৩০ নাগাদ আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কিছুক্ষন বাস চলার মধ্যেই চোখ বুজে এলো। কোলাঘাটে এসে ঘুম ভাঙলো। এ পথে কোলাঘাটে প্রায় সব ভ্রমনার্থীই কিছুক্ষন বিশ্রাম নেন। একের পর এক দূরপাল্লার বাস ও ট্যাক্সিগুলি এসে দাঁড়াচ্ছে বিভিন্ন ধাবায়। এখানে এসে সকলেরই ঘুম চোখে চায়ে চুমুক দিতে বেশ লাগে। আমাদের বন্ধুরা কেউ কেউ রুটি, তড়কাও খেলেন। তবে এত রাতে আমরা কয়েকজন খাওয়া দাওয়া পর্বের মধ্যে ঢুকিনি। রাত্রে ভ্রমনের ক্ষেত্রে পেট দেবতাকে উপোষ দেওয়ারই পক্ষপাতী আমি। 

কিছুক্ষন পরই বাস রওনা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ঘন অন্ধকারে ঘুম ঘুম চোখে বাস ঘন পিচের রাস্তা দিয়ে ছুটছে। কুয়াশাচ্ছন্ন পথ, অতি সতর্কতা অবলম্বন করে সারথি চললেন আমাদের নিয়ে সেই পথে। ১৫ -২০ মিটার দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে আমার আবার চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ভোর ৫টা নাগাদ যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি ড্রাইভার সাহেব একজন স্থানীয় বাসিন্দার নিকট পথ নির্দেশিকা জানছেন। বুঝলাম আমরা প্রায় গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। স্থানীয়রা অনেকেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মাঠে যাচ্ছেন। তাদেরই একজনের নির্দেশে  কাঁথির মোড় থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম কিছুটা অখ্যাত বাগুরান-জলপাই সমুদ্র তীরের কাছাকাছি।

একেবারে অফবিট গন্তব্য। সরু মোরামের পথ ধরে কিছুটা হেঁটে আমরা পৌঁছলাম বাগুরান-জলপাই সমুদ্র তীরে। তখনও সমুদ্র তট ফাঁকা, জনমানব শূন্য। কিছুটা বালিয়ারির মধ্য দিয়ে হেঁটে ঝাউবনের মধ্যে আমাদের ত্রিপল খাটিয়ে তাঁবু তৈরি করা হলো। সকাল ১০ টার পর একে একে আরো কয়েকটি দল এসে উপস্থিত হলো বনভোজন করার জন্য। বেশ মনোরম পরিবেশ। শহুরে কোলাহল বর্জিত একান্ত এই সি-বিচ আমার তো বেশ ভালো লেগেছে। তবে ভাটার সময় এখানে সমুদ্রের জল অনেকটাই দূরে চলে যায়। দিঘা, মন্দারমনির সমুদ্র সৈকতের থেকে বেশ আলাদা। বাগুরানে মূল আকর্ষণ লাল কাঁকড়া। ভীষন লাজুক স্বভাবের। একটু শব্দ পেলেই এরা গর্তের গভীরে মুখ লোকায়। তবে দূর থেকে এই সি-বিচের কাঁকড়াগুলিকে দেখতে ভীষন ভালো লাগে। পলাশ গাছের তলায় ঝরে পরা পলাশ ফুলের সৌন্দর্যের সাথে অবশ্যই তুলনা করা যায় এই অঞ্চলের লাল কাঁকড়াগুলিকে। 

এসব দেখতে দেখতেই অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেললাম। এদিকে সকালের খাবার খাওয়ার ডাক পড়েছে। মুড়ি, কেক ও ল্যাংচা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর সাথে গরম গরম বেগুনি ভেজে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা সকলে পৌঁছালাম সমুদ্র স্নানে। বেশ খানিকটা হেঁটে একটু জল পাওয়া গেল। সেখানেই সমুদ্র স্নানের আনন্দ নেওয়া। তবে বলে রাখি এখানে জোয়ারের সময় ছাড়া সমুদ্র স্নানের মজা উপভোগ করা একপ্রকার প্রায় অসম্ভব । কোলাহল বর্জিত সমুদ্র সৈকত হওয়ায় স্নান করে বেশ মজাই পেয়েছি। তবে ঠান্ডার কারনে বেশিক্ষন জলে থাকা যায়নি। 

সমুদ্র স্নান করে আবার ফিরে এলাম আমাদের অস্থায়ী তাঁবুতে। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে কিছুটা ঢলে পড়েছে। ঝাউবনের পাতাগুলি নিজের খেয়ালে নড়তে নড়তে এক একটি করে ঝড়ে পড়ছে পড়ন্ত দুপুরে। আজই আমাদের ফিরতে হবে বাড়ি। তাই বেশিক্ষন দেরি না করে সকলে একসাথে লাঞ্চ সারতে শুরু করলাম। এদিকে পাশের কয়েকটি দল বনভোজন সেরে উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেছে। বুঝলাম খুব বেশিক্ষন থাকা আর নিরাপদ নয়। কারন মাঝেসাঝেই বনভোজনের আনন্দের মধ্যেই তারা রাজনৈতিক শ্লোগান দিচ্ছেন, যা অনভিপ্রেত। তাই আর বেশি দেরি না করে বাড়ি ফিরে আসার তোড়জোড় শুরু করতে বাধ্য হলাম। 

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। আমাদের বাস ছাড়ল। ভাবলাম একরাত্রি এখানে থাকলেও মন্দ হয় না। ফাঁকা আকাশের নিচে তাঁবুতে।  এখনও সেভাবে হোটেল ব্যবসা এখানে গজিয়ে ওঠেনি। আপাতত একটি মাত্র হোটেল "সাগর নিরালা"। 

শহরের কোলাহল থেকে বাঁচতে দুই এক রাত্রি এখানে থেকে গেলে আমাদের মত শহুরে মানুষরা একটু নির্জনতার আভাস পায় সাথে প্রকৃতির সাথে মেলামেশার আনন্দ। তবে দিনের দিন সকাল সকাল বেরিয়েও এই সৈকতে সারাদিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরাও সম্ভব।

কিভাবে যাবেন :-হাওড়া থেকে ট্রেনে বা বাসে কাঁথিতে নামতে হবে। কাঁথি বাসস্ট্যান্ড থেকে অটো বা টোটো রিকশায় এই সমুদ্র সৈকতে পৌঁছানো যাবে।

(www.theoffnews.com - Sea beach Baguran Jalpai)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours