শৌভিক রায়, লেখক ও শিক্ষক, কোচবিহার:

উৎসবপ্রিয় বাঙালির জীবনে বইমেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ভারতের আর কোনও প্রদেশে বই এবং বইমেলা নিয়ে এরকম হইচই দেখা যায় না। কিন্তু করোনা আবহাওয়ায়, এই বছর, অনেককিছুর মতোই বইমেলা ব্যাপারটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। তবে সরকারি নির্দেশাবলে জেলায় জেলায় ছোট আকারে হলেও বইমেলা হচ্ছে। বিগত এক বছরে প্রায় সব উৎসব থেকে দূরে থাকা বাঙালির খানিকটা হলেও তৃষ্ণা মিটেছে। বিগত বছরের শেষে ও নতুন বছরের শুরুতে হয়ে চলা এই মেলাগুলি করোনা সংক্রমণে কোনরকম ভূমিকা নেবে কিনা সে প্রশ্ন দূরে সরিয়ে রেখে বলা যায় যে, মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে বইমেলার আজও কোনও বিকল্প নেই। যদিও অনেকসময় বইমেলায় আমাদের দেখনদারি বিরক্তির সৃষ্টি করে, তবু বইমেলা সবসময়েই স্বাগত।     

১৪৫৪ সালে জার্মানির গুটেনবার্গ মুদ্রণের জগতে যখন বিপ্লব আনলেন, বইমেলার বীজটি বোধহয় তখনই বপন করা হয়েছিল। সে আমলের জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে মুদ্রিত বই প্রকাশের বহু আগে থেকেই পাণ্ডুলিপি বেচাকেনার জন্য বাণিজ্যমেলা বসত। গুটেনবার্গের পর মূলত জোহান ফাউস্ট ও পিটার স্কোফারের উদ্যোগে মুদ্রিত বইয়ের মেলা বসতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন উদ্দেশ্য হলেও, অজান্তেই এই মেলা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। কেননা এখনও অবধি প্রাপ্ত তথ্য বলছে যে, এই মেলাটিই বিশ্বের প্রাচীনতম বইমেলা। নবজাগরণের হাত ধরে এই বইমেলার আঙ্গিকে নানা পরিবর্তন আসে, কেননা নবজাগরণের সময়কাল সভ্যতাকে এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। জ্ঞান আহরণের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তি দিয়ে বিচার ও বৌদ্ধিক ভাবনা ছিল নবজাগরণের মূল বৈশিষ্ট্য। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় তাই ব্যবসা একমাত্র লক্ষ্য রইল না। বরং নতুন বইতে পন্ডিতেরা কী লিখলেন সেটা জানবার আগ্রহ বাড়ল। কেননা জ্ঞান ও যুক্তির চর্চার জন্য বইয়ের বিকল্প কোনো যুগেই ছিল না।দীর্ঘদিন অবধি অপ্রতিদ্বন্দী ছিল এই বইমেলা। অষ্টদশ শতকে লিপজিগের বইমেলা বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে। এই মেলাটি ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বলে মান্যতা পেয়েছে। এই মেলাটি দ্রুত পরিচিতি লাভ করেছিল, কেননা এই সময়টি ছিল নবজাগরণের পরবর্তীকালের এমন একটি সময় যখন আলোকিত পাঠক ঝুঁকতে শুরু করেছিলেন দর্শনের দিকে। আর এই বইমেলায় প্রাধান্য পেত দর্শন ও তার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়। সমৃদ্ধ ও প্রাচীন দুটি বইমেলা ছিল ইউরোপের দান। আরও নির্দিষ্ট করে বললে জার্মানির নাম উল্লেখ করতে হয়। আসলে, মোটামুটিভাবে মানবসভ্যতার সমৃদ্ধির ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি সবচেয়ে বড় অবদান ইউরোপের। আর সেই ইতিহাসে জার্মানির ভূমিকা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বোঝে কার সাধ্য! তাই এই জার্মানির কোনো এক শ্বৈরাচারী শাসকের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমৃদ্ধির ইতিহাসের ব্যাটনটি চলে গেল আমেরিকার হাতে। যাহোক, সেকথা আলাদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা প্রতি বছর হয়ে আসছে। বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত এই বইমেলায় একযোগে দেখা যায় লেখক, শিল্পী, পাঠক, প্রকাশক, বিক্রেতা, ছবি-নির্মাতা থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষকে। এই মেলায় যোগ দেন সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের পুস্তকবিক্রেতা, তাদের এজেন্টরা। শুধুমাত্র বইকে ঘিরে এরকম আয়োজন চোখে না দেখলে কল্পনা করা যায় না। 

আজ বিশ্বের বহু জায়গায় বইমেলা অনুষ্ঠিত হলেও, বিশ্বের প্রথম বইমেলার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বইকে ঘিরে মেলার ধারণাটি মানবজাতির উর্বর উদ্ভাবনের একটি উদাহরণ। এইসময় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বইমেলা, লিটিল ম্যাগাজিন মেলা ইত্যাদির আয়োজনের পেছনেও কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার পরোক্ষ অবদান রয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল যে, পশ্চিমবঙ্গের বইমেলার শুরুটা মসৃণ ছিল না। ১৯৭৪ সালে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে বসে কিছু তরুণ প্রকাশক ফ্রাঙ্কফুর্টের ধাঁচে বইমেলা শুরু কথা ভাবলেও তুলনায় বয়সে প্রবীণ প্রকাশকেরা তা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। হয়ত সেটা শাপে বর হয়েছিল। জেদ চেপেছিল তাঁদের মনে, আর সেই জেদ থেকেই ১৯৭৫ সালে তৈরী হয়েছিল পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড। ১৯৭৬ সালের ৫ই মার্চ শুরু হয়েছিল প্রথম কলকাতা বইমেলা। তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়ের উদ্বোধন করা সেই মেলায় ৩৪ জন প্রকাশক যোগ দেন। স্টল হয়েছিল মোট ৫৬টি। একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের উল্টোদিকে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই বইমেলা দেখে সেদিন কেউ বুঝতে পারেন নি যে, কালক্রমে এই মেলা বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক হয়ে উঠবে এবং এই মেলার অনুসরণে আগামীদিনে জেলাস্তর থেকে শুরু করে গ্রামীণ পর্যায়েও বইমেলা হয়ে উঠবে সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালির অন্যতম নয়নের মণি। যত দিন গেছে কলকাতা বইমেলার কলেবর তত বৃদ্ধি পেয়েছে, লেগেছে আন্তর্জাতিক ছোঁয়া। প্রতি বছর বিভিন্ন রাজ্যকে 'থিম' হিসেবে তুলে ধরার পর ১৯৯৭ সালে প্রথম 'ফ্রান্স`কে বেছে নেওয়া হয়, আর এই বছরই Montemarte-এর ধাঁচে শিল্পের স্পর্শ লাগে বইমেলার গায়ে, কেননা এই প্রথম শুরু হয় বইমেলায় বসে ছবি আঁকা। জ্যাক দেরিদাঁ ছিলেন এই বছরের বইমেলার উদ্বোধক। কালের সময় বেয়ে আজকের কলকাতা বইমেলার পরিচিতি সে নিজেই। সারা বছর কলকাতা তথা বাংলা তো বটেই বিশ্বের তাবড় প্রকাশক থেকে শুরু করে সাধারণ বইপ্রেমীরা কলকাতা বইমেলার অপেক্ষা করে থাকেন। যতদিন যাচ্ছে, কলকাতা বইমেলার জৌলুশ ও গুরুত্ব তত বাড়ছে। পিছিয়ে নেই  দিল্লির প্রগতি ময়দানের বিশ্ব বইমেলা। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ও ইন্ডিয়ান ট্রেড প্রমোশন অর্গানাইজেশন-এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই মেলাতেও সারা দেশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের নানা প্রান্তের লেখক, প্রকাশকেরা অংশ নেন। দেশের রাজধানী হওয়ার সুবাদে এমনিতেই দিল্লির বেশ কিছু সুবিধে রয়েছে। তার ওপর কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত এই শহরের বইমেলাটিও যে ভাল হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। সর্বোপরি মাথায় রাখতে হবে যে, দিল্লির বইমেলাতে ভারতের প্রতিটি ভাষা-সহ ইংরেজিতে ও বিশ্বের অন্যান্য ভাষার বই প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় বলে এই মেলাটি আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক স্তর স্পর্শ করতে পেরেছে। ব্যবসাও ভাল হয় বলে কলকাতা ও দিল্লির বইমেলা দুটির কদর আলাদা। 

বিখ্যাত বইমেলাগুলির সঙ্গে জেলা বইমেলাগুলির তুলনা করা নিতান্তই বোকামি। সেটি করা উচিতও নয়। কিন্তু জেলা বইমেলাগুলির গুরুত্ব স্থানীয় মানুষদের কাছে কম নয়। একই ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন  জায়গার কবি-লেখকরাও এই মেলাগুলি থেকে উপকৃত হন। অবশ্য আমাদের দেশের সবকিছুর মতোই জেলা বইমেলাগুলিতেও রাজনীতির স্পর্শ, বইমেলার চরিত্রকে দিনদিন নষ্ট করছে। এই মেলাগুলিতে পরস্পরের পিঠ চাপড়ে সর্বময় কর্তৃত্ব জাহির করবার মানুষও কম নেই। কম নেই অপাত্রে দান। বইমেলা নিয়ে রাজনীতির কুনাট্যেরও অভাব নেই। যাহোক, এসব নিয়েও দিনের শেষে বইমেলা ছাড়া নিজেদের ভাবতে কষ্ট হয়। এই শীতে তাই বইমেলা স্বাগত, বিপদের আশঙ্কা মাথায় রেখেও। বইমেলা হোক, মানুষের সচেতনতা বাড়ুক, বাড়ুক বই পড়ার অভ্যেস। কেননা যত পড়া তত শেখা আর যত শেখা ততই আত্মিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়া।  

(এই লেখার কিছু অংশ কোচবিহার জেলা বইমেলা ২০২০ সুভেনিয়ারে সালে প্রকাশিত এই লেখকেরই একটি লেখা থেকে নেওয়া। লেখকের অনুমতি নিয়েই লেখাটি প্রকাশিত হল।

লেখক পরিচিতি- কোচবিহার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, কবি, আলোকচিত্রী ও  মুজনাই সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক)

(www.theoffnews.com - book fair)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours