পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বছর চারেক আগেকার কথা। একটি নতুন টিভি চ্যানেলের ইটারভিউ বোর্ডে রয়েছি আমি। প্রথম দফার ইন্টারভিউ শেষ। এবার চুড়ান্ত দফার ইন্টারভিউ। অর্থাৎ মোটামুটি ভাবে বেছে নেওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের বেতন, পদ, দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, শেষে দুপক্ষের মত মিললে কাজে নেওয়ার নিশ্চিত ঘোষণা। একটি মেয়েকে তার সম্ভাব্য বেতন এবং পদের উল্লেখ করে জিজ্ঞাসা করা হল সে কবে থেকে যোগ দিতে পারে। কারন সে ইতিমধ্যেই একটি নিউজ চ্যানেলে কর্মরত। তাকে সেখানেও জানাতে হবে। নতুন চ্যানেলে যোগ দেওয়ার অঙ্গীকার করে কিছুদিন সময় চাইল মেয়েটি। সেই দিনই তাকে অফার লেটার দেওয়া হল। দিন দশেক পরে সেই মেয়েটি ফোন করল আমায়। ওই বেতনে সে নতুন চ্যানেলে যোগ দিতে পারছে না, আরও বেশ কয়েক হাজার টাকা বাড়ালে সে তবেই যোগ দেবে। নিজে একজন সাংবাদিক হওয়াতে কেমন খটকা লাগল। যে মেয়ে তার নতুন বেতন (যা তার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি) শুনে এত খুশি হয়ে গেল তারই সেই বেতন কয়েকদিনের মধ্যেই কম মনে হচ্ছে কেন? তখনই তাকে এ ব্যাপারে সম্মতি না দিয়ে খোঁজ লাগালাম। ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেই কঠিন ছিল না, কারন ওই মেয়েটির বর্তমান চ্যানেলে এক সময় আমিই একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম। জানা গেল আমাদের এই নতুন চ্যানেলের অফার লেটার দেখিয়ে সে দরাদরি করে ইতিমধ্যেই তার বর্তমান কর্মক্ষেত্রে নিজের বেতন কয়েক হাজার টাকা বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তাই এবার আমাদের সঙ্গে দরাদরি শুরু করেছে। না, তাকে আর নতুন চ্যানেলে বেশি বেতন দিয়ে নেওয়া হয়নি।

দিন কয়েক সংবাদ মাধ্যমে শতাব্দী রায়ের ”যাব কি যাব না” যাত্রাপালাটি দেখতে দেখতে উপরের এই ঘটনাটির কথা খুব মনে হচ্ছিল। বাংলা রাজনীতিতে এখন শুধু দর বাড়ানোর খেলা চলছে। এমন নাটক এখনই নতুন দেখা যাচ্ছে তা নয়। দলবদল তো যুগের পর যুগ ধরেই হচ্ছে। কিন্তু দলবদলের আগে এমন দর বদলের নাটক কিন্তু এবারে সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শুভেন্দু এই নাটকের প্রধান কুশীলব। দলবদলের আগে বেশ কিছুদিন ধরেই “যেতে পারি কিন্তু কেন যাব” গোছের নাটক করে জল মাপছিলেন। শেষমেশ তিনি গেলেন বটে, কিন্তু বাংলার বর্তমান রাজনীতিতে ছেড়ে গেলেন “এই যাব কি যাব না” ভাইরাসটি। এ দেখছি করোনার চেয়েও মারাত্মক। অধিকাংশ শাসক দলের কর্মীই এই নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত। 

দুচারটি উইকেট নতুন ভাইরাসে পড়তেই রীতিমত বিব্রত তৃণমূল। তারা আক্রান্তদের কাউকে আইসোলেশনে রাখছে, কাউকে সাময়িক কিছু ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। আবার হারানো স্বজনকে পচা জ্ঞানে দূর ছাই করে দিচ্ছে। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই নতুন “যাব কি যাব না” ভাইরাসের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারছে না কেউই। এই তালিকায় অনেকেই আক্রান্ত হলেও সদ্য আলোচিত দুইজন হলেন শতাব্দী এবং রাজীব। বেশ কিছুদিন ধরেই দুজনে গুন গুন করে যাচ্ছিলেন। শতাব্দীকে ধরে বেঁধে আপাতত কিছু ওষুধপত্র দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও কোয়ারিন্টাইনেই আছেন। ঝেড়ে কাশছেন না। তাকেও কেউ ছুঁতেও সাহস করছেন না। 

করোনার মত এ রোগেরও নানান রকমের উপসর্গ। ফেসবুক পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ, সভায় প্রকাশ্যে তেরছা কথা, দলীয় সভা বা বৈঠকে অনুপস্থিত থাকা, অন্য নেতাদের অসম্মান করা, দলবদলু নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। এমন নানাবিধ উপসর্গ নতুন এই ভাইরাস ঘটিত রাজনৈতিক রোগের। 

যেসব নেতারা এতদিন পাত্তা পেতেন না, সংবাদ মাধ্যমে নামও শোনা যেত না, নতুন এই ভাইরাসের কারনে তারাও এখন খবরের শিরোনামে। সকলেই খুশি। কেউ নতুন দল নতুন পদ পেয়ে, আবার কেউ পুরনো দলে ফের জামাই আদর পেয়ে। বিজেপি শুনছি এবার প্লাস্টিকের ফুলের মালা কিনে রাখছে। কারণ তৃণমূল থেকে নেতারা আসার সময় এত সময় নিচ্ছেন, দরাদরি করছেন যে আসল ফুলের মালা শুকিয়ে কাঠ। বিজেপি নেতারাও নতুন অতিথিকে বরণ করবার জন্য ফুল মালা সাজিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ক্লান্ত। তার মাঝে শতাব্দীর মত কেউ কেউ আশা জাগিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরেও যাচ্ছেন, ফলে দিনভর বা সপ্তাহভর পরিশ্রমটাই মাটি। 

করোনার যেমন কো-মর্বিডিটি আছে, সুগার, প্রেশার, হার্ট, লিভার বা কিডনির অসুখ থাকলে অসুস্থতা বাড়ে, প্রাণসংশয় হতে পারে, তেমনই এই ভাইরাসেরও কিন্তু কো-মর্বিডিটি রয়েছে। ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ, প্রতারণা, লালসা, কথা না রাখা প্রভৃতি অসুখ থাকলে নতুন ভাইরাসটি কার্যকরী হয়ে উঠছে ব্যপক ভাবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা দলে স্থিতি সংশয়ও ঘটাচ্ছে। করোনার প্রতিষেধক এসে গেলেও এই রোগের প্রতিষেধকের কোনও খোঁজ নেই। সম্ভবত তা কোনও দিন মিলবেও না। সুতরাং যারা দূরে থেকে যাত্রাপালা দেখায় উৎসাহী তাদের জন্য এটাই সেরা সময়। অভিজ্ঞদের মতে আগামী মাস চারেক ( নির্বাচনের আগে এবং পরে) এই ভাইরাস ছড়ানোর পিক টাইম। তার পরে কিছুটা কমে আসবে “যাব কি যাব না” ভাইরাসের দাপট। কমে আসবে, কিন্তু চলে যাবে না। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব যেমন বেশ কম তেমনই সাধারণ মানুষের উপরে এই ভাইরাসের প্রভাব নেই বললেই চলে। শুধু রাজনীতি থেকে গা বাঁচিয়ে (পড়ুন মাস্ক পরে) চললেই আপনি আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু শান্তি নেই রাজনীতির কারবারিদের। নতুন ভাইরাস ওদের জন্য ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে কিনা।

(www.theoffnews.com - West Bengal politics party change)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours