ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট বাংলাদেশ:

বাহাদুরাবাদ ঘাট পেছনে ফেলে আমাদের নৌকা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আমরা টের পাইনি। মাঝিদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার শব্দে আমরা সচকিত হলাম। গত দুইদিন মাঝিদের সাড়া শব্দ ছিল না। নিজেরা কথা বলেছে ফিস-ফিসিয়ে। হঠাৎ তাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার মাজেজা কি? ব্যাপারটা বোঝার জন্য নৌকার পেছনের দিকের যে ছই, সেই ছইয়ের দরোজা খুলে হালের মাঝিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চাচা, খবর কি? মনে এত ফুর্তি ভাব ক্যা’? চাচা একগাল হেসে বললেন, ‘আপনারা বাইরে আসতে পারেন। ফাড়া কাইটা গেছে’। এ কথার পর আর আমাদের পায় কে? লাফিয়ে ঝাপিয়ে আমরা বাইরে এলাম। 

ফাড়া কাটা মানে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে এসেছি। বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাক আর্মির বড় ঘাঁটি। গান বোট নিয়ে ব্যাটারা নদী পাহারা দেয়। এর আগে কয়েকটি নৌকা থেকে যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করে যমুনায় ভাসিয়ে দিয়েছে। তারাও আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে যাচ্ছিল। এই জন্যে আমাদের আগেই মাঝিরা সতর্ক করেছিল। বলেছিল, বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হওয়ার আগে আমরা যেন কোনভাবেই ছইয়ের বাইরে না বেরোই। 

ফাড়া কেটে গেছে মানে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়েছি।

ছইয়ের বাইরে এসে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দেখে আমার মন প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠলো। আনন্দে ভরে উঠলো মন। মনে হচ্ছিল কতদিন দিনের বাংলাদেশ দেখি না। এমন হৃদয় খোলা পরিবেশে যে কারো কণ্ঠে গান নেচে উঠবে। আমারও কণ্ঠে গান নেচে উঠলো। গলা ছেড়ে প্রিয় গানটি অবচেতন ভাবে কণ্ঠে সুর তুললো। আমি গাইলাম পরম মমতায়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’।

আমার মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। হঠাৎ দেশমাতৃকা এসে ভর করলো আমার বুকে। বললাম, ‘হে জননী জন্মভুমি, তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি। তুমি কি আবার আমাদের তোমার কোলে আশ্রয় দেবে? 

হঠাৎ পাশ থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো। 

‘দেবে। অবশ্যই আশ্রয় দেবে। আমরা দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফিরলে দেশ অবশ্যই আমাদের কোলে তুলে নেবে’। তাকিয়ে দেখি বন্ধু আসগর। আমার পাশে বসতে বসতে কথাগুলো বললো। আমার কাছের বন্ধু সে। সব সময় সে আমাকে সাহস যোগাতো। আমি কখনও হতাশা প্রকাশ করলে তুড়ি মেরে আমার হতাশা উড়িয়ে দিত। ৭০ সালে আমরা একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পাকিস্তানের লাস্ট ব্যাচ আমরা। আবার দেশের টানে একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়েছি। 

সুঠাম দেহি হালের মাঝি এক হাতে হালের বৈঠা ধরে অন্যহাতে হুঁকো টানছে। কষে দম দিয়ে তারপর কয়লার ইঞ্জিনের মতো ধুয়ো ছাড়ছেন মুখ দিয়ে। এই হুঁকোর চল আমাদের বাড়িতেও আছে। আমাদের বাড়ির কামলারা হুঁকো টানে। তাদের জন্য অনেকদিন আমি বাজার থেকে তামাক এনে দিয়েছি। কৃষকগঞ্জ বাজ্যারের মাঝামাঝি স্থানে বিখ্যাত ‘কুদ্দুসের তামাকের দোকান’। তাঁর তামাক ডলা দেখার মতো। নিপুন হাতে তিনি তামাক এবং খামুরে দিয়ে ডলে তামাক তৈরি করতেন। দোকানে সারাক্ষণ একটি কল্কিতে তামাক জ্বালানো থাকতো। অনেকেই বিনে পয়সায় সেই তামাকে টান দিয়ে নেশা মিটিয়ে নিতো। সেখানকার একটি মজার দৃশ্য আজও আমার চোখে লেগে আছে। একজন কল্কি টানছে সঙ্গে কয়েকটি হাত কল্কি ধরে আছে। তার টানা শেষ হলে আরেকজন টানবে। কিন্তু কল্কি ধরা হাত কমছে না। বিস্ময়ভরা চোখে আমি এই দৃশ্য উপভোগ করতাম।

আমাদের নৌকার হালের মাঝি আয়েশে হুঁকো টেনে যাচ্ছেন। তার কাশফুলের মতো সাদা ধবধবে দাড়ি এবং চুল বাতাসে উড়ছে। তার পেটা শরীর। যৌবনে আরও তাকত ছিল বোঝা যায়। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘চাচা, আমি কি আপনার হুঁকোয় একটু দম দিতে পারি’?       

বললেন, ‘অভ্যেস আছে? পারবেন’?

বললাম, ‘পারবো’। 

প্রাইমারি থেকে বিড়ি খাই। হুঁকোও খেয়েছি ঠেকায় পড়ে। না পাড়ার কিছু নেই। হুঁকো নিয়ে কষে দম দিলাম। হালের মাঝি আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। হেসে বললেন, ‘আগে কখনও খাইছেন অক্কা’? বললাম, 'অনেক খেয়েছি। আমাদের বাড়িতে দুজন কামলা আছে। তারা হুঁকা খায়। তাদের সঙ্গে খেয়েছি’। মাঝি চাচা হে হে করে হাসলেন। তার পান খাওয়া লালচে দাঁত পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোতে ঝলমল করে উঠলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, আপনার বয়স কত’? চাচা একগাল হেসে বললেন, ‘বয়সের হিসাব কে রাখে? হবে তিন চার কুড়ি’। 

আমার ধারণা চার কুড়ি হবে না। তবে তিন কুড়ির বেশি। আমি মজা করে বললাম, আপনাকে দেখেতো মনে হয় আপনার বয়স দুই কুড়ি’। আমার এই কথায় চাচার সে কি হাসি। সেই প্রাণখোলা হাসি যমুনার ঘোলা জলে ভেসে ভেসে বার বার কানে এসে বাজতে লাগলো। 

নৌকা বেশ জোরে চলছে। কিভাবে এত জোরে চলছে? মুহূর্তে আমার ভাবনা কেটে গেল। এতক্ষণ একবারও খেয়াল হয়নি। নৌকা চলছে পালে। যমুনা নদীর বুক জুড়ে রঙ-বেরঙের পাল তোলা নৌকা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। যমুনার বিশাল বুক জুড়ে নানা বর্ণের শুধু পালের নৌকা। যেন সরোবরে নানা জাতের অসংখ্য রঙিন ফুল। আমাদের নৌকায় উড়ছে তিন পাল। একটার উপর আরেকটা। এইভাবে তিন পাল। মাঝের পালটি লাল বর্ণের। মনে হচ্ছে জাতির রক্তাক্ত পতাকা। এমন মনোলোভা দৃশ্য এখনও মনে গেঁথে আছে। জনম জনম মনে থাকবে। 

আমাদের আরও একটি নৌকা, যে নৌকায় সুকুর মামু - জহুরুল মোস্তফা এবং রাজ্জাক আছে। সে নৌকাও তিন পালে চলছে। সেটা আমাদের পেছনে পেছনে আসছে। দেখলাম নৌকার আগা গলুইতে চাদর গায়ে মোস্তফা শুয়ে শুয়ে গলা ছেড়ে লালনগীতি গাচ্ছে। পানির উপর বাতাসে ভেসে আসা মোস্তফার বেসুরো লালনগীতি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।                   

একটু পেছনের নৌকায় হৈচৈ। মাঝিরা পাল গুটিয়ে ফেলছে। আমরা আতংকিত মুখে চেঁচিয়ে ‘কি হয়েছে’ জানতে চাচ্ছি। জহুরুল চেঁচিয়ে বললো, ‘মোস্তফা নৌকা থেকে যমুনায় পড়ে গেছে’। 

শুনে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো। যমুনার এত স্রোতে ভেসে না জানি কোথায় চলে গেছে। সত্যি মোস্তফাকে উদ্ধার করা যাবে কি? আকংকে আমাদের কথা আসছে না মুখে। দ্রুত আমাদের নৌকার পালও গুটিয়ে ফেলা হলো।[চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours