সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

তারিখটা ৬ ডিসেম্বর চলতি বছরের। স্থান যে কল্যাণীর বিদ্যাসাগর মঞ্চ। অনুষ্ঠান বলতে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীসভা। দলের এই সভাস্থলের মধ্যমনি হলেন দলেরই সাংসদ মহুয়া মৈত্র। হাজার হোক তৃণমূলের সভা বলে কথা। এতো আর সিপিএমের পরিচালিত সুশৃংখল মিটিং নয়। সুতরাং হুলুস্থুলু হুজ্জতি যে অধিকাংশ ঘাসফুল সভায় মোটামুটি ভাবে ঘটবেই এটা অতি বড় মূর্খ ব্যক্তিও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা মেনে সেখানে ঘটলও তাই। আর ঠিক এই বিষয়টা চোখের সামনে সংগঠিত হতে দেখলে উপস্থিত সাংবাদিকদের নিজস্ব পেশার স্বার্থে কি করা উচিৎ? নিজের দায়িত্বে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তা কভার করাটাই যে সাংবাদিকতার কর্তব্য ও বাঞ্ছনীয়। আর সেটাই তো করছিলেন উপস্থিত সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকেরা। ব্যাস আর যায় কোথায়। তাতেই মেজাজ হারিয়ে ফেললেন তৃণমূলী সাংসদ তথা অনেকের মতে গ্ল্যামার গার্ল মহুয়া মৈত্র। দলের হৈ হুল্লোর তাঁর উপস্থিতিতে সাংবাদিকেরা কভারাপ করবে সেটা মহুয়া মৈত্রের যে একদম না-পছন্দ। তাই তিনি বলেই ফেললেন, "কে এই দু'পয়সার প্রেসকে এখানে ডাকে। সরাও প্রেসকে এখান থেকে।"

এই বৃত্তান্ত এই কারণেই এতক্ষণ দিলাম যে আপনার রুচিবোধ ও ধৃষ্টতা দেখে আমি সত্যি চমকে গেছি। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, ৩৮ বছর যাবৎ আমি সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। এই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে মনে পড়ে না কখনও বিক্রি হয়েছি বলে। কখনও স্মরণে আসে না একটা শব্দ অনৈতিক ভাবে লিখেছি বলে। আমার চ্যালেঞ্জ রইলো আপনাকে। আমার মন্তব্য ভুল প্রমাণ করার জন্য। হ্যাঁ ম্যাডাম এটা ঠিকই, আমার পেটে খিদে থাকে প্রায়শই। আমার পকেট শূণ্য থাকে হামেশাই। কিন্তু সাংবাদিক সত্ত্বার সঙ্গে আমার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমার জীবনের অভিধানে আপোষ বলে কোনও শব্দ লেখা নেই এযাবৎ। দুই পয়সা তো অনেক বেশি। একটা কানাকড়িও বহু সময় আমার কাছে বিশ্বাস করুন থাকে না। আবার অ্যাডজাস্ট বা উপঢৌকনের প্রস্তাব যে মাঝে মধ্যে পাই না এমন মিথ্যে কথা বলি কি করে? কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করার মতো মেরুদন্ডটা কিন্তু এই সাড়ে ছাপান্নো বছর বয়সেও আমার যথেষ্ট সোজা ও দৃঢ়।

ম্যাডাম আরও একটা কথা। আপনার দল অর্থাৎ রাজ্যের শাসক দল বহু তথাকথিত মিডিয়া হাউসকে পোষ্য ক্রীতদাস বানিয়ে নিরন্তর পুষে চলেছে, এটা আমার লজ্জা হলেও আমি সততার প্রশ্নে তা মানতে বাধ্য। বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির লোভ সম্বরণ সব হাউস উপেক্ষা করতে পারে না তা অন্তত সবাই বোঝে। আবার বহুল চর্চিত কিছু সাংবাদিক পুজো গিফট বা অন্য উপঢৌকন পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে আপনাদের পা চেটে প্রতিদিন চলেছে এমন উদাহরণও বহুল আছে এই বাংলাতেই।

কিন্তু মহুয়া মৈত্র, এই পরিসংখ্যানের আত্মতৃপ্তিতেই কি আপনি বা আপনারা বাংলার সমগ্র সাংবাদিক কুলের আত্মমর্যাদাকে নিজেদের দলের অনুশাসনে বন্দি করতে চাইছেন? কি মনে করেন আপনি নিজেকে? শুনে রাখুন, বাংলার সিংহভাগ সাংবাদিক এখনও মনে প্রাণে সৎ। তাঁরা আদর্শবান। তাঁরা স্বভিমানী। তাঁরা বিক্রি হতে শেখেননি। তাঁরা দুস্থ কিন্তু তাঁরা কর্তব্যপরায়ণ। তাঁরা ক্ষুদার্থ তবু তাঁরা কর্মে নিষ্ঠাবান। তাঁরা চালচুলোহীন অথচ তাঁরা সৎ কলমচি। হ্যাঁ এটা কোনও আবেগের কথা নয়। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েই এটা বলছি। আমি এঁদের অনেককেই নিবিড় ভাবেই চিনি। আমি এই সখ্যতায় গর্বিত। বাংলার প্রতিটি মহল্লায় আপনি এঁদের খুঁজে পাবেন। এঁদের ঘরের জীর্ণ দেওয়ালে কান পাতলে শুনতে পাবেন, দুই পয়সার জন্য পরিবারের কি হাহাকারের নিত্য গঞ্জনা। অথচ আপনাদের কভার করার সময় তাঁদের মুখে সেই গঞ্জনা ছাপ কোথায় যেন উড়ে যায় নিমেষে? একরাশ হাসি মুখে তখন যে তাঁরা আপনাদের খবর করতেই ব্যস্ত থাকেন। সেটা কি বোধগম্য হয় আপনাদের? 

আপনি হয়তো জানেনই না, যে শাড়িটা আপনি পরছেন তার যা মূল্য তা বহু সাংবাদিকের মাসিক আয়ও সমপরিমান নয়। আমি এটা মানি। আপনি যে প্রসাধন ব্যবহার করেন তার মূল্যও অনেক বেশি বহু সাংবাদিকের সামগ্রিক মাসিক সংস্থান থেকে। আমি এটাও জানি। আমি আবার এটাও বুঝি, তাঁরা আপোষহীন। তাঁরা ভালোবেসে প্রকৃত সাংবাদিকতাটা করেন হৃদয়ের একটা অঘোম আকর্ষণ থেকে।

আর আপনি কিনা বলছেন, দু'পয়সার প্রেসকে এখানে কে ডাকলো। আপনার এই কথাটা বলতে লজ্জা করলো না একবারও? শুনেছি আপনি নাকি যথেষ্ট শিক্ষিতা ও আধুনিকা ও আপডেটেড। এটাই কি আপনার রুচিগত আপডেটেডের সাম্প্রতিকতম নমুনা? আপনার ভাষা ও সম্ভাষণ শুনে তো মনে হল নর্দমার কীটের নিজস্ব পরিভাষাও যথেষ্ট সংযমী আপনার শব্দ চয়নের তুলনায়। দু'পয়সার প্রেস বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন শুনি? মনে রাখবেন আপনার ব্যাঙ্গাত্মক কথার অর্থ আমরা খুব ভালো ভাবেই বুঝি। বার্বি ডলের অনুকরণে মুখে ফেস পাউডার লাগিয়ে ত্বকের গ্ল্যামার দশ পয়সার সমমূল্যের বাড়াতেই পারেন। কি করবেন সেটা আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাই বলে এই দু'পয়সার প্রেসকে তাচ্ছিল্য করার অধিকারটা আপনাকে কে দিয়েছে শুনি? এটাও কি আপনার ব্যক্তিগত প্রসাধনী স্বাধীনতার আওতায় পড়ে নাকি? ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন না। মুখ সামলে কথা বলতে শিখুন। আমরা আপনার কাছে সম্মান পাওয়াটা মোটেও আশা করি না। কিন্তু আমাদের অসম্মান করার অধিকারও আপনাকে আমরা দিইনি।

আপনি যখন রাজনীতিটা করছেন তখন এই দু'পয়সার প্রেসকে আপনার আবার দরকার হবে ঠিকই। আবার এটাও জানবেন একই সঙ্গে, এই দু'পয়সার প্রেসদের তাই বলে দশ পয়সা মার্কা বার্বি ডলের আদৌ সত্যি কোনও প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস করুন। কারণ সময় যত গড়াবে দু'পয়সার প্রেসের মূল্যায়ন কিন্তু একই থাকবে। কিন্তু সময় ফুরোতে থাকলে দশ পয়সা বার্বি ডলের বাজার দড় কিন্তু পড়তেই থাকবে। হাহাহা। কি করবেন বলুন? ঠিক হ্যায় ম্যাডাম, জরুর ফির মিলেঙ্গে, লেকিন হিস্সা বরাবর হোনা চাহিয়ে।

(www.theoffnews.com - Mahua Moitra press politics) 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours