শৌভিক রায়, লেখক ও শিক্ষক, কোচবিহার:

সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বাঙালি জীবনেও ২৫ শে ডিসেম্বরের বড়দিনের উৎসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। যীশুর জন্মদিন পালনের এই রীতি দীর্ঘদিন থেকে চলে এলেও মজার কথা এটাই যে, বাইবেলে যীশুর জন্মদিন বলে, কোনো নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা হয় নি। ক্যালেন্ডার ধরে হিসেবে করেও শূন্য দশককে যীশুর জন্মবর্ষ বলা যায় না, কেননা খ্রীস্টাব্দ শুরুই হচ্ছে এক থেকে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, যীশু জন্মেছিলেন চার খ্রীস্ট পূর্বে। 

আসলে খ্রীস্টমাস পালনের ঐতিহ্য শুরু হয় ৩৩৬ খ্রীষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইনের সময় থেকে। তিনিই প্রথম রোমান সম্রাট যিনি এই দিনটিকে পালনের নির্দেশ দেন। আরও কয়েক বছর পর পোপ জুলিয়াস ১ আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যীশুর জন্মদিন ঘোষণা করলে, বড়দিনের অনুষ্ঠানটি ধর্মীয় তকমা পায়।

ডিসেম্বর মাসের নির্দিষ্ট এই তারিখটিকে বেছে নেওয়ার পেছনে কিন্তু বেশ কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। সূর্যের পরিক্রমা অনুসারে বছরকে ভাগ করলে দেখা যাচ্ছে যে, ডিসেম্বর মাসের এই সময়টিতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধ্যে ফারাক সবচেয়ে কম। প্যাগানদের বিশ্বাস ছিল যে, এই সময়েই শীতের শেষ ও বসন্তের শুরু। শীতের জড়তা কাটিয়ে নতুন উদ্যমে বসন্তের আলো ঝলমলে যাত্রা শুরুকে স্বাগত জানাতে শুরু হয়েছিল এই জন্মদিন পালন কেননা যীশু মানেই নবজীবন ও আলোর প্রতীক। অন্যদিকে খ্রীস্টানদের বিশ্বাস মা মেরি ২৫ শে মার্চ জানতে পারেন যে, পৃথিবীতে যীশু আসতে চলেছেন। সেই হিসেবে নয় মাস পরের তারিখটি হয় ২৫ শে ডিসেম্বর। খ্রীস্টধর্মে ২৫ শে মার্চের আরও তাৎপর্য আছে। এই দিনটিকে পৃথিবী সৃষ্টির দিন মনে করবার পাশাপাশি যীশুর মৃত্যুদিন বলেও মনে করা হয়। 

অতীত ইতিহাস বলছে যে, একটা সময় ৬ই জানুয়ারি যীশুর জন্মদিন হিসেবে পালিত হত। এই সময়েই 'এপিফানি' অর্থাৎ যীশুকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে চিনতে পেরে তাঁর ব্যাপ্টিজম পালনের রীতি ছিল। আজকের দিনে এপিফানি বলতে কিন্তু ম্যাজাইদের যীশুকে দেখতে আসাকে বোঝায়। চার্চের কাছে যীশুর জন্মদিনের চাইতে 'ব্যাপ্টিজম' বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের চাপে আলাদা করে যীশুর জন্মদিন পালনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৮৫২ সালের আগে অবধি জুলিয়াস ক্যালেন্ডারের হিসেবে বছর গোনা হত। কিন্তু, ওই বছর জুলিয়াস থেকে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহারে আসতে গিয়ে হারিয়ে যায় দশটি দিন। ফলে, ৬ই জানুয়ারি পিছিয়ে যায়। এখনও কিন্তু পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় পুরোনো নিয়মে জানুয়ারির ৬ তারিখে খ্রীস্টমাস পালন করা হয়।

আবার ইহুদিদের আলোর উৎসব হানুক্কাহ শুরু হয় ২৫ ডিসেম্বরে। ইহুদিদের আলোর এই উৎসবকে, চার্চের যীশুর জন্মদিন হিসেবে উদযাপন করবার তাৎপর্য বুঝতে কিন্তু বেগ পেতে হয় না। অন্যদিকে আলোর দেবতা সূর্যকে বন্দনা করে রোমান উৎসব স্যাটার্নলিয়ার শুরুও এই তারিখেই। ঘুরেফিরে যীশুর জন্মদিন পালনের সঙ্গে আলোর সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, যীশু মানেই আলোর প্রতীক। তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষকে কুসংস্কার, অজ্ঞানতার, লোভের ও হিংসার অন্ধকার থেকে আলোর পথে, অমৃতের পথে নিয়ে যেতে। যীশুর জন্মদিন নিয়ে যত বিতর্কই থাক না কেন, এই বিষয়ে সকলেই একমত যে, ঈশ্বরপুত্র যীশু স্বয়ং ছিলেন আলোর প্রতীক। 

খ্রীস্টমাস কথাটিরও তাৎপর্য লক্ষণীয়। 'মাস সার্ভিস` মানে সম্মিলিতভাবে উপাসনা। এই উপাসনার মূলে রয়েছে অতি সত্য একটি তথ্য যে, ঈশ্বরপুত্র যীশু আমাদের সকলের জন্য যেমন জন্মেছিলেন, তেমনি আমাদের সকলের জন্যই তিনি মারা যান। তাই সবাই মিলে একসঙ্গে হয়ে তাঁকে মনে করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। দেখা যাচ্ছে যে, এই 'মাস সার্ভিস'-এর জন্য বেছে নেওয়া হয় মাঝরাত। এখানেও অত্যন্ত বুদ্ধি করে সময়টিকে ঠিক করা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টায় একমাত্র এই সময়টিতেই সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায়। তাই সূর্যাস্তের পরে ও সূর্যোদয়ের আগে 'মাস সার্ভিস' অনুষ্ঠিত হয়। বছরের এই সময়টিকে এক্সমাস বলবার পেছনেও নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রিক ভাষায় 'X' দেখতে বর্ণটি আসলে 'CHI', যার উচ্চারণ 'খইই'। খ্রীস্ট শব্দটির প্রথম গ্রিক বর্ণ হল X। একটা সময় চার্চ গ্রিক বর্ণের CHI ও RHO ব্যবহার করত খ্রীস্ট বোঝাতে। এর থেকেই এসেছে 'এক্স' এবং সেখান থেকে 'এক্সমাস'। 

খ্রীস্টধর্মের প্রাচীনত্ব ও ব্যাপ্তি এতটাই বিশাল যে, বিভিন্ন যুগে তার মধ্যে বহু প্রক্ষিপ্ত ব্যাপার প্রবেশ করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কখনও চার্চ বা পোপ নিজে কিংবা সম্রাটের নিজেদের সুবিধে মতো ধর্মটিকে ব্যবহার করেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে চলেছে রাজ্য বিজয় বা লুণ্ঠন পর্যন্ত। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে, ধর্মবিস্তারের জন্য হোক বা অন্য কোন কারণে, এই ধর্মের মানুষেরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, নতুন নতুন আবিষ্কার করেছিলেন। লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন জনপদ ও সেখানকার ব্রাত্য মানুষেরা তাদের জন্যই আধুনিকতার আলো দেখেছেন। ধর্মপ্রচার মূল লক্ষ্য হলেও নিজেদের জানা বা অজানায় এই ধর্মের মানুষেরা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পেরেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থবির না থেকে প্রয়োজনীয় বদলও এই ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। 

তাই এই ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সকলেই ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখটিকে তাঁর জন্মদিন বলে মেনে নিয়েছে। যীশু মানেই প্রেমের ও ভালোবাসার প্রতীক। আজকের অস্থির সময়ে তাঁর জন্মদিন অন্য মাত্রা এনে দিচ্ছে একটাই কারণে যে, যেভাবে প্রতিনিয়ত মানুষে মানুষে হানাহানি বাড়ছে, বিভেদ ছড়াচ্ছে, বিশ্বাসভঙ্গ হচ্ছে, তাতে তাঁর বাণী ও আদর্শ আমাদের নতুন করে পথ দেখাতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যীশুই ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ যিনি মানুষের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। জন্মেও ছিলেন মানুষের জন্য। তাই ২৫ শে ডিসেম্বর একটি তারিখ মাত্র। আসলে তাঁর জন্মদিন উদযাপন মানে মানবতার জয়গান, প্রেমের অঙ্গীকার ও ভালবাসার বন্ধনে সবাইকে একত্রিত করা আর মানুষের সেবা করা।  

(প্রতিবেদক হলেন উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা 'মুজনাই'এর সম্পাদক)

(www.theoffnews.com - Jesus Christ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours