ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি দ্বীপ ভাসান চর। সেখানে সাজ সাজ রব চলছে বেশ কিছুদিন থেকে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করতে চোখে ঘুম নেই। একটি জনবহুল দেশের জন্য বাড়তি এই জনগোষ্ঠী সত্যি এক বোঝা হয়ে আছে। তবু তাদের মাথাগোঁজার ঠাই হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই ভাসানচর। 

গত ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে প্রথম দফায় স্থানান্তরিত করে পুনর্বাসন করা হয়েছে। যেহেতু রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই বাংলাদেশ সরকার তাদের ভাসানচরে আপাতত থাকার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে এক লাখ শরণার্থী থাকার অবকাঠামো তৈরি করেছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে ১ হাজার ৬৪২ জনকে সেখানে নেওয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ১২০টি গুচ্ছগ্রাম। তাতে ঘরের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪০টি। প্রতি ঘরে কক্ষ ১৬টি এবং প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে কক্ষ নির্ধারন করা হয়েছে। ৮টি পরিবারের জন্য একটি করে মোট ৮টি চুলা নির্ধারন করা হয়েছে। নির্মান করা হয়েছে হাসপাতাল। রয়েছে রেশনিং ব্যবস্থা। ২২টি এনজিও সাহায্য-সামগ্রী সেখানে পৌছে দিয়েছে।

২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মায়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যা অভিযান শুরু করলে তারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ভৌগলিক দিক থেকে আকারে ছোট, অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয়। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যে সমস্যায় পড়ে, তা ইতিমধ্যে এ দেশের মানুষ অনুমান করতে পেরেছে। তাৎক্ষণিক থাকার জন্য কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে বসতি দেওয়া হয়। এই শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য নিশ্চিতভাবে বড় ধরণের একটা বোঝা। এটা অনস্বীকার্য যে রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ও সার্বিক নিরাপত্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে, যে পরিমানে সাহায্য বা ত্রানের কথা, তা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই সীমিত। যা প্রয়োজনীয় অর্থের ৫ শতাংশও নয়। স্বল্প মেয়াদে অর্থনীতির বিশ্লেষণে ১১ লাখ রোহিঙ্গা হয়তো শতকরা হিসাবে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করলে এটি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরণের হুমকি। গত ৪ বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে জন্মের হার ছিল উল্লেখযোগ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী জন্মের এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছরে তাদের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে অর্ধকোটি। যা বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য সংখ্যালঘুদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। এরই মধ্যে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী সংখ্যালঘু উপজাতি কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ঘটনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির হিসাবে প্রাথমিক ভাবে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দুপাশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে এই অঞ্চলের বন আর পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছে। বন বিভাগের হিসাব অনুয়ায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের বসতি করা হয়েছে। প্রাথমিক অনেক সাহায্য সহযোগিতা দিতে অনেক দেশী-বিদেশী এনজিও ছুটে এসেছে। তবে তাদের জ্বালানী হিসাবে কোন ধরণের সাহায্য আসেনি। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১১ লক্ষ মানুষের রান্নার কাজে জ্বালানী হিসাবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই জ্বালানীর যোগান হিসাবে উখিয়া টেকনাফের জঙ্গলের গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন বনভুমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বনভুমির যার পর নাই ক্ষতি হবে। 

যেহেতু তারা নিজেদের বসতি নিজেরাই স্থাপন করেছেন, তাই অপরিকল্পিত ভাবে বন এবং পাহাড় কাটা হয়েছে। ফলে, এ অঞ্চলের পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করার পর হয়তো নতুন করে গাছ লাগিয়ে এখানে বনায়ন করা সম্ভব কিন্তু পাহাড় কেটে যে ক্ষতি করা হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগকে বলা হয় সাগর-পাহাড়ের মিতালীস্থল। এই পাহাড়গুলো প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি বছরের পুরানো। যুগ যুগ ধরে এগুলো আমাদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। পাহাড় কাটার ফলে এর মধ্যে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করবে। ফলে কোন এক সময় ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসাবে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের জন্য বছরে ব্যয় ৭৭কোটি ডলার। যেহেতু বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের বৈধ কোন আয় নেই। তাই বড় অঙ্কের এই অর্থনৈতিক ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাড়তি নিরাপত্তা দিতে সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি সহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে। এই বাড়তি ব্যয় পুরণ করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে। যদি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়া হতো তাহলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারতো।

২০১৯ সালের ২২ আগস্ট তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্নের পরও একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। বরং তারা আট দফা দাবি তুলেছিল প্রত্যাবাসনের শর্ত হিসাবে। কিন্তু তাদেরও দেওয়া শর্ত মানতে রাজি হয়নি মায়ানমার সরকার। তাই তাদের আর ফেরত যাওয়া হয়নি। আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ইতিমধ্যে কারণে অকারণে এ দেশের সাধারণ নাগরিক স্রােতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু শরণার্থীকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আটক করা হয়েছে। কেউ কেউ অবৈধভাবে এ দেশের নাগরিক পরিচয়পত্র তৈরি করেছে। এমনকি পাসপোর্ট পর্যন্ত তৈরি করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তবে কথা থেকে যায়, যারা ধরা পড়েছে, তাদের কথাই প্রশাসনের নজরে এসেছে। এমনকি হয়নি, যারা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে এ দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেছে। কেউবা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

অনেক আগে থেকেই মায়ানমার থেকে সীমান্ত পথে বাংলাদেশে অবৈধ নেশা পন্য আসতো। রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার ফলে সেই সুযোগ আরো বেড়ে গেছে। যার ফলে পরিসংখ্যান মতে বিগত বছরগুলিতে বাংলাদেশে সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়তে দেখা গেছে। আশ্রয় নেওয়া অনেক রোহিঙ্গা তাদের পুরানো ব্যবসা সচল রেখেছে মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তারা এই কাজে বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়োগ করছে। ফলে দেশে পূর্বের তুলনায় মাদক চোরাচালন এবং অবৈধ অস্ত্র বেড়ে গেছে। নেশা পণ্য চোরাচালানের মতো অপরাধের সাথে জড়িত কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা ও স্থানীয় লোক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ক্রস-ফায়ারে নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা গেছে। 

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ৯৭ জন এইচআইভি পজেটিভ পাওয়া গেছে। ফলে এই অঞ্চল এইডস ঝুঁকিপূর্ন। কক্সবাজার সিভিল সার্জন কর্তৃক জানা যায়, এ অঞ্চলে দিন দিন এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই এইডস-এ আক্রান্ত তিন-চারজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এইচআইভি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিভেন দুজারিচ বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে আমরা রিপোর্ট পেয়েছি যে, শরনার্থীদের কেউ কেউ ভাসানচরে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাই তাদের কক্সবাজার ক্যাম্পে থাকতে দেওয়া উচিত’। এই প্রতিনিধিদের অবগতির জন্য বলছি, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। এ দেশে শত শত বেকার রয়েছে। সংসারের স্বচ্ছলতার জন্য অবৈধ পথে পাড়ি দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে অথবা মনিবের অত্যাচারে প্রতিবছর অনেক মানুষ লাশ হয়ে ফিরে আসে। আবার মধ্যপ্রদেশে কাজের আশায় পাড়ি দেওয়া অসংখ্য নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কেউ কেউ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করছে। বন্যা, সাইক্লন, জলচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটানোর খবর নেহাৎ কম নয়। শীতের মৌসুমে গরম কাপড়ের অভাবে মারা যায় অনেক লোক। সেই দেশে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের ৪ বছর ধরে আশ্রয় দেয়া দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়।

বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হিসাবে ভাসানচরে বসতি দেওয়া হয়েছে। তবে তা কতদিনের জন্য? বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে তাদের পরিচয় কি হবে? আদৌ কি রোহিঙ্গা নাগরিক এ দেশ থেকে নিজ দেশে ফিরে যাবে? এতগুলো প্রশ্ন ঘিরে প্রতিদিন বাংলাদেশের মানুষের জনজীবন শুরু হয়। যেখানে নিজেদের অভাব, অনটন, চাওয়া-পাওয়ার সীমাবদ্ধতা রয়েছে তার উপর এতগুলি মানুষ বাড়তি চাহিদা পূরণ সহজ বিষয় নয়। ১১ লক্ষ মানুষ ১ কোটিতে পরিণত হবে খুব বেশি সময় নেবে না। তাছাড়া নিজেদের জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি তো রয়েছেই। কক্সবাজারের উখিয়ায় জায়গা সংকটের কারণে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ভাসানচরে যখন স্থান সংকট হবে তখন কোন চরে স্থানান্তর করা হবে, সেটা ঠিক করা হয়েছে কি? বিগত চারবছরের যে সমস্যার সমাধান হয়নি, আগামীতেও কি তার সুষ্ঠু সমাধান হবে বলে মনে হয়! 

পাশ্ববর্তী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আশ্রয় ভূমি। একথা মেনে নিলাম। তবে বিশ্বের সকল সভ্য এবং সুশীল দেশের উচিৎ এই কঠিন কঠোর সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। বার বার বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি উপস্থাপন করেও কোন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক। অনন্যোপায় না পেয়ে ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কি এই স্থানান্তর রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী বসবাসের জন্য নাকি সাময়িক। বিষয়টি বোধগম্য নয়।

(www.theoffnews.com - Bangladesh Bhasanchar Mayanmar Rohinga)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours