পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

প্রায় দু যুগ আগে যখন সাংবাদিকতায় এসেছিলাম তখন কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে এমন কুম্ভমেলার দশা ছিল না। অর্থাৎ পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে সংবাদ মাধ্যমের দফতর বা সাংবাদিক মিলত না। প্রায় ছ মাস ধরে লাগাতার প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল আমাদের। সেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন সংবাদ মাধ্যমের সেই আমলের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা, শুধু তাই নয় শিক্ষা, রাজনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন সব বিভাগেই খুঁটিনাটি জানাতে এসেছিলেন সেই জগতের বিখ্যাতরা। সেই প্রশিক্ষণেই আমাদের শেখানো হয়েছিল কাউকে স্যার না বলতে। না উপযুক্ত সম্মান দিতে বারণ করা হয়নি, কিন্তু স্যার অর্থাৎ প্রভু, সাংবাদিকেরা কেন একজন আমলা, মন্ত্রী বা বিখ্যাতকে স্যার বলবেন? অন্যরা কে কি করেছে আমি জানি না, আমি সারা জীবন সেই নির্দেশ মেনে এসেছি। একমাত্র শিক্ষক বা সমমর্যাদার কাউকে ছাড়া অন্যদের কখনও স্যার বলে ডাকিনি। এমনকি প্রণববাবু যখন রাষ্ট্রপতি তখনও তাকে স্যার বলিনি, বলতে হয়নি। 

কিন্তু এখন বহু সাংবাদিককেই শুনি স্যার বলতে। বড় আমলা, মন্ত্রী তো ছেড়েই দিন পঞ্চায়েত প্রধানকেও স্যার বলে ডাকতে শুনেছি অনেক সাংবাদিককে। অর্থাৎ প্রথম থেকেই যেন বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া। এর দুটি কারণ হতে পারে, প্রথমত সেই সাংবাদিকের নিজের প্রতি আস্থাহীনতা, দ্বিতীয়ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব যা তার মেরুদণ্ডকে সুদৃঢ় করতে সহায়ক হয়নি। আমাদের কর্মজীবনের প্রথম দিকে এক যুগেরও বেশি সময় ছিল বাম জমানা, সেই জমানায় বহু সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, কিন্তু কোনও বাম নেতাকে শুনিনি সাংবাদিকদের তুই তোকারি করে সম্বোধন করছেন। আমার আগে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা শুনেছি আরও ভাল। অর্থাৎ সাংবাদিকতার পেশার যে একটা ন্যুনতম সম্মান প্রাপ্য সেটা অন্তত সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতারা বুঝতেন। 

বাম জমানা বদলের পর এসেছে সবুজ বিপ্লব। আমাদের পরিচিত বহু বিরোধী নেতারাই এখন প্রতিষ্ঠিত মন্ত্রী বা পদাধিকারী। লক্ষ্য করলাম কয়েক বছর পরই তাদের সম্বোধন বদলে গিয়েছে। আমাদের তো বটেই, তারা এখনকার প্রায় সব সাংবাদিকদেরই তুই তোকারি করেই সম্বোধন করেন। এই অভিজ্ঞতা আমারও। পুরনো কাজের ক্ষেত্র দুর্গাপুরে যে তৃণমূল নেতা আমায় তুমি করেই সম্বোধন করে এসেছেন, বেশ কয়েক বছর পরে তিনি যখন বড় পদে তখন দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন “বল্ ভাই, কেমন আছিস”। নিতে পারিনি, মুখের উপরে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের সম্পর্ক তুমিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করা দরকার। রামকৃষ্ণের কথা মত ছোবল না মারলেও ফোঁস তো করাই যায়। সেটা করতেই ভুলে গিয়েছে আজকের সাংবাদিক কুল। এই পেশায় মাইনে নেই বললেই চলে, নেই কাজের কোনও সময়সীমা। তার উপরে আছে এখনকার অধিকাংশ বসের খারাপ ব্যবহার। সব মিলিয়ে সাংবাদিকদের অবস্থা সরকারি জিপ গাড়ির ন্যুব্জ অকাল বুড়ো চালকদের মত। কোনও রকমে ভাঙাচোরা গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকা। সারা জীবন অন্যের দাবিদাওয়া, বঞ্চনা নিয়ে খবর করে গিয়েছেন, নিজেদের কোনও দাবিই আজ পর্যন্ত আদায় করে উঠতে পারেননি। নিজেদের মধ্যে কোনও একতা নেই। আজ হাজার হাজার কৃষক তাদের দাবি নিয়ে পথে বসেছে। কিন্তু কোনও বা কয়েকজন সাংবাদিক ন্যায্য কোনও দাবিতে পথে বসলে সঙ্গে অন্য কোনও সাংবাদিককে পাবেন কি? না, অন্যরা বরং সমালোচনা করবেন, এড়িয়ে যাবেন। সারা দেশ দেখছে, দেখবে একমাত্র সাংবাদিকদের মধ্যেই কোনও একতা নেই।

আর একটা জিনিস খুব দরকার, পড়াশোনা। কথাবার্তা বা আচরণে শিক্ষার ছাপ থাকলে সামনের মানুষটি কিন্তু সমীহ করতে বাধ্য। এর মানে আমি কখনই বলছি না শিক্ষাগত যোগ্যতার বিরাট ডিগ্রি প্রয়োজন। আমি বলছি পড়াশোনার কথা। নানান বিষয়ে একজন সাংবাদিকের স্বচ্ছ চিন্তাধারা থাকা দরকার। এটা দিতে পারে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা। এই পড়াশোনাটারই বড় অভাব এখন। জেলার দিকে তো বটেই, শহরেও অধিকাংশ সাংবাদিকেরা পড়াশোনাকে খুব গুরুত্ব দেন বলে তাদের কথা বার্তা শুনে মনে হয় না। এই সুযোগে কিন্তু তাদের উপরে জমিয়ে বসেন রাজনৈতিক নেতারা। রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষা সব ক্ষেত্রে বেশি তা বলছি না, কিন্তু তাদের প্রাজ্ঞতা, বহু মানুষকে বশ করবার স্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে তারা বুঝে যান সামনের মানুষটির জ্ঞানের উত্তাপ।  

কথায় বলে ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। সাংবাদিকদের অবস্থাও তাই, অন্যের চাকরি গেলে উন্নাসিক হই আমরা। অন্যরা অপদস্থ হলে মুচকি হাসি আমরা। আমাদের বিপদ এলে একই জিনিস করে অন্য সাংবাদিকেরা। এসব তো কাছ থেকেই দেখছেন অন্য মানুষ, রাজনৈতিক নেতারা। তাই তাদের আচরণেও সেই অসম্মানটাই প্রকাশ পাচ্ছে। এখনকার রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের কথাবার্তা এমনিতেই রীতিমত অভব্য। তারা কাউকেই সেভাবে সম্মান করতে জানেন বলে মনে হয় না। যে জনতার ভোটে জিতে তারা এত সাহস দেখাচ্ছেন সেই জনতাকেও অপমান করতে ছাড়েন না রাজনীতিকেরা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীতা পছন্দ করেন না, তার বিরুদ্ধে যারা লেখে তাদের তিনি সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন পর্যন্ত করবার সুযোগ দেন না। আজকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই মুখ্যমন্ত্রীর দলের এক পরিযায়ী রাজনৈতিক নেত্রী সাংবাদিক কুলকে “দু পয়সার সাংবাদিক” বলবার সাহস দেখাতে পারেন। কারন উনি জানেন এর পরেও সাংবাদিকেরা তাকে বা তার দলকে বয়কট করবার সাহস দেখাতে পারবে না। এই দু পয়সার সাংবাদিকেরা সামান্য প্রতিবাদ করবে ওই ফেসবুক ট্যুইটারে। তার পরে তাদের মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা হয়ে যাবে, ফের ওই দু পয়সার সাংবাদিককেই যেতে হবে ওই নেত্রীর কোনও রক্তদান শিবিরের খবর করতে। এটাই বাস্তব। 

অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতও তো সাংবাদিকদের অপমান করে, তাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন তার কোনও সাংবাদিককে দরকার নেই, সংবাদ মাধ্যমের একটি সংগঠন তাকে বয়কট করবার ডাকও দিয়েছিল। কিন্তু বাংলার কোনও মিডিয়াকে দেখিনি তাতে সামিল হতে, পরদিনই বাংলা কাগজে কঙ্গনার নতুন ছবির খবর ছিল। কারণ ওই একই, “আমাদের তো অপমান করেনি”। আজ একজন সাংসদ বলেছেন। আগামী কাল পঞ্চায়েত সদস্যও একই সুরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করবার সাহস দেখাবেন। আর সাংবাদিকেরা, মুচকি হেসে “আমাকে তো বলেনি” বলে ফের চলে যাবেন সেই নেতা–নেত্রীর কাছে। এখনও সময় আছে, মেরুদণ্ড সোজা না করলে, ব্যক্তিত্ব মজবুত না করলে কিন্তু আগামী দিনে আরও কুকথা শুনতে হবে, সহ্য করতে হবে আরও অপমান।

(www.theoffnews.com - Mahua Moitra Editorial)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. সঠিক ও সময়োচিত নিবন্ধ। ধন্যবাদ সাংবাদিক পলাশ মুখোপাধ্যায়কে।
    - সুদিন গোলদার।

    ReplyDelete