গতকাল পশ্চিম মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে বিজেপিতে শুভেন্দু বরণ পর্ব সুসম্পন্ন হল একেবারে মেগা শাহী ঘরানায়। সদ্য প্রাক্তন তৃণমূলী অধিকারী এই তরুন তুর্কির হাতে পদ্ম শোভিত দলের গৈরিক পতাকা তুলে দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি দলের অন্যতম বর্তমান স্থপতি অমিত শাহ। মঞ্চে কার্যত ঘাস বাগিচার তুমুল তুলোধুনা করলেন সর্বভারতীয় এই প্রাক্তন কমল সভাপতি। নব্য বিজেপি রাজ্য নেতা শুভেন্দু অধিকারী একেবারে চাঁচাছোলা ভাষায় দুই হাত উঁচিয়ে বললেন, "তোলাবাজ ভাইপো হঠাও।" ব্যাস রে রে করে তৃণমূল নেতৃত্বের নানা প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। এযাবৎ সবই তো ঠিকঠাক চলছিল বর্তমান বাংলার চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। নির্বাচনোত্তর দল বদল। তৃণমূল-বিজেপির টানটান মেঠো রাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ। পরস্পরের বিরুদ্ধে বাক নিশানা-সবই যেন গণতন্ত্রের মসৃণ পথে একটা দিক নির্দেশ করছিল রাজ্য রাজনীতিতে। আর রাজ্যবাসী শীতের শৈত্যতার মধ্য এই রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের উত্তাপে নিজেদের মনটাকে জমিয়ে সেঁকে নিচ্ছিল।
রাজ্যবাসী এটাও দেখল এক নতুন অচেনা শুভেন্দু অধিকারীকে। তিনি তৃণমূলের নেতা হিসেবে বা মন্ত্রী পদমর্যাদায় কতখানি সফল তা নিয়ে চর্চাতে যাচ্ছি না। রাজ্যবাসীর কাছে তাঁর অতীত ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। তিনি বিজেপির পতাকা ধরে ঠিক না ভুল করলেন, সেই তাত্ত্বিক চর্চাতেও মাথা ঘামাতে নারাজ। কারণ আগামী সময় সব প্রশ্নের জবাব মিলিয়ে দেবে। কিন্তু যে শুভেন্দুকে গত পাঁচ মাস ধরে সারা রাজ্য দেখল তা এক কথায় বিরলতম রাজনৈতিক দর্শন। এই পঞ্চমাসে গোটা রাজ্য রাজনীতির চুড়ান্ত ভড়কেন্দ্রের এভারেস্টে যেন তিনিই একমাত্র অবস্থান করেছেন। এমনকি স্বঘোষিত প্রচারমুখী রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও শুভেন্দু এহেন উচ্চতার নাগাল ছুঁতে পারেননি এই কয়েক মাসে। কি অগাধ সংযম, কি অসীম ধৈর্য, কি সুতীব্র গ্রহণযোগ্যতার দড়ি টানাটানি প্রতিযোগিতা পদ্ম-ঘাস শিবিরের অন্দরমহলে, প্রেসকে এড়িয়ে কি সুদীর্ঘ নীরবতা, কত গালমন্দের কি নিস্তব্ধ উপেক্ষা, কি অফুরন্ত রাজনৈতিক সৌজন্যতা-এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগুন বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলার রাজনীতিতে দেখা গেল এই প্রথম বলেই অনেকে মনে করেন। হ্যাঁ তিনি তাঁর পুরোনো দলের সমালোচনা রাজনৈতিক ভাবে করলেন ঠিকই। কিন্তু তা দলের জার্সি পরে নয়। গেরুয়া পার্টির সদস্য হয়ে অবশেষে তিনি বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার মা নন। আমার জন্মদাত্রী হলেন আমার মা। পূন্য ভারতভূমি হল আমার মা।"
শুভেন্দু অধিকারীর "তোলাবাজ ভাইপো হঠাও" ও "মা... " সম্পর্কিত বক্তব্য খন্ডন করতে গিয়ে তৃণমূল মুখপাত্র কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু যা বললেন সেটাও বাংলার বিগত পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়। এরাজ্যে আজ পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের মুখে 'মা' তুলে এমন কদর্য ভাষা সততই বিরলতম। তপসিয়ার তৃণমূল ভবনে আয়োজিত সাংবাদিক বৈঠকে গতকালকেই দলের মুখপাত্র কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দুকে নিশানা করে বলেন, "ওনার মায়ের নাম তো গায়েত্রী অধিকারী। মা শেখাননি যে যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করো তাঁর নামটা নিতে হবে।" গত চব্বিশ ঘন্টায় এহেন কল্যাণ কুবচন কিন্তু তৃণমূলের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি খন্ডন করা হয়নি অন্তত এখনও পর্যন্ত।
বাংলার রাজনীতিকরণে সৌজন্যতার উক্তি যুদ্ধ সারা দেশে পথিকৃৎ ছিল কিছু বছর আগেও। কিন্তু সেই ধারাবাহিক এই গর্বের দেওয়ালে সাম্প্রতিক কালে আঘাত করে বসেন সিপিএমের অনিল বসু, তৃণমূলের অনুব্রত মন্ডল ও বিজেপির দিলীপ ঘোষ। অনিল বসুকে সিপিএম প্রাপ্য শাস্তি থেকে রেয়াত না করলেও অনুব্রত মন্ডল ও দিলীপ ঘোষ তো এখনও বেলাগাম তুফানি ঘোড়া। এসবের মধ্যে আবার কুবচনের ময়দানে উঠতি তারকা হবার সুবাদে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় খুব কাছের বৃত্ত হয়ে উঠেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কল্যাণবাবু তো আবার তাঁর বচন ঔদার্যে তাঁর সব পূর্বসূরীদের পিছনে ফেলে দিয়েছেন এক ঝটকায়। উফ্ গুরু কি জোর কা ঝটকা দিলেন। একেবারে 'মা' তুলে। এক্কেবারে মায়ের নাম করে।
এমন 'মা' তুলে প্রতিপক্ষকে যদি চা দোকানের ঠেকের কোনও ফঁড়ে লোফার কাউকে আক্রমণ করে পাশাপাশি মানুষজন তার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এবেলায় তৃণমূল ভবণ স্পিকটি নট্। এমন গালমন্দ যদি কোনও লুম্পেন মাতাল নর্দমায় উল্টে বেহুঁশ অবস্থায় করতে থাকে, দেখবেন পথচারীরা এর বিরোধিতা করছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে কালিঘাট গলি যেন অদ্ভুত নির্বাক। এমনকি নিষিদ্ধ লালবাতি পল্লীতে কোনও দালাল যদি কোন বিরক্তিকর মহিলার মা তুলে এভাবে কথা বলতে যায় সেখানেও উপস্থিত মহিলারা সমস্বরে ঝাঁকিয়ে ওঠেন। তবু এখানে গোটা তৃণমূল নেতৃত্ব বোবা বনে গেছেন হঠাৎ।
আচ্ছা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি তো আবার তৃণমূলী আইনজীবী। তার মানে পড়াশোনা জানা এলিট ক্লাসের মানুষ আপনি, তাই না? আপনার মুখে শুভেন্দু অধিকারীর মাকে নিয়ে এই রাজনৈতিক কাটাছেঁড়া করা সত্যি কি মানায়? আপনি তো শিক্ষিত মানুষ? এটাই কি শিক্ষার নমুনা আপনার? গায়ের উপর দামী ব্র্যান্ডেড পোষাক পরলে আর যুবতী গায়িকার সঙ্গে ওপেন স্টেজে উদোম নৃত্য পরিবেশন করলেই যে শিক্ষিত হওয়ার শংসাপত্র কপালে জোটে কিনা জানি না কল্যাণবাবু। কিন্তু আপনি যা বলেছেন তা সুশীল সমাজের প্রতি একটা নগ্নতার উপমা হয়ে দাঁড়াল অবশ্যই। গায়েত্রী দেবী কি শুধুই আপনার প্রতিপক্ষের মা? তিনি তো আপনার দলের এক বর্তমান নেতারাও মা। তিনি তো এখনও তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার সহধর্মিনীও। আপনার এহেন কুৎসিৎ বচনে আপনার রাজনৈতিক মা চুপ করে থাকতেই পারেন প্রকাশ্যে কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনার গর্ভধারিনী মা আপনার এহেন কথায় সম্মতির ঘাড় হেলাতেন না। আসলে একজন গর্ভধারিনী মা অপর গর্ভধারিনী মায়ের অসম্মান কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না নৈতিক ভাবে। এটাই যে নৈতিক শিষ্ঠাচার। তাই হয়তো সুকৌশলে শুভেন্দু অধিকারী তাঁর বক্তব্যের মধ্যে "গর্ভধারিনী" শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন তাই না? রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে দরকারে অতি বিপ্লবী প্রতিবাদী হন। কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু মাকে মায়ের আসনে থাকতে দিন। গর্ভধারিনী 'মা'কে নিয়ে নাইবা আর কদর্য রাজনীতিকরণ করলেন। একটাই অনুরোধ, বাংলার রাজনৈতিক কৃষ্টির মুখকে আর কলঙ্কিত করবেন না তথাকথিত শিক্ষিত তৃণমূলী উকিলবাবু। দোহাই আপনার।
(www.theoffnews.com - TMC BJP CPM Kalyan Banerjee Mamata Banerjee Suvendu Adhikari Amit Shah West Bengal politics West Medinipur)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours