সুকন্যা পাল, ম্যানেজিং এডিটর, দ্য অফনিউজ, কলকাতা:

ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুসারে অবশেষে আরও একটা দিন এসেই গেল চলতি বছরান্তে। দিন তো প্রাকৃতিক নিয়মে আসবেই। আচ্ছা যদি 'দিন' না বলে শব্দটাকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায় না? এই ধরুন এবার আমরা যদি উচ্চারণ করি 'দিবস', তবে কিন্তু জাগতিক অর্থ এক থাকলেও শব্দের তাৎপর্যটা খানিক পাল্টেই যায়। আজ আমাদের কতরকম 'দিবস' মনে প্রাণে উঁকি মারে। ঠিক না? আর একেক দিবসকে কেন্দ্র করে চলে কত আয়োজন কত আনন্দ কত রকমারি পালনের শপথ। কিন্তু সেই দিবস যদি হয় 'বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস, তবে? না না। এই দিবস কিন্তু শুধুমাত্র আয়োজনের নয়। আনন্দের নয়। পালনের নয়। এই দিবস হল অবশ্যই ভাবে পাশে থাকার। আন্তরিকতার। ও ধারাবাহিকতার। আর ঠিক এইখানেই বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসকে বাস্তব মর্মে সমার্থক ও সার্থক করে তুলেছেন দুর্গাপুরের এক চিকিৎসক দম্পতি দীপঙ্কর সেন ও দিপান্বিতা সেন। এবং এই শিল্প শহরের সিটিসেন্টারে অবস্থিত 'প্রয়াস ফাউন্ডেশন'।

অর্থাৎ? বিষয়টা একটু খোলসা করা যাক। স্বামী শিল্পাঞ্চলের প্রখ্যাত অস্থি বিশেষজ্ঞ। স্ত্রী যে স্ত্রীরোগের নামজাদা ডাক্তার। তাঁরা শুধু পেশাদারী ভিত্তিতে মানুষের চিকিৎসাই করেন না। জীবনের তাগিদে তা তাঁদের করতে হলেও সামাজিক ভাবে বাঁচার প্রেরণায় তাঁরা জড়িয়ে গেলেন 'প্রয়াস ফাউন্ডেশন'এর আবদ্ধে। যৌথ ভাবে তাই তাঁরা একদা শপথ নিলেন অসহায় দুস্থ প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকার। শুরু হল প্রয়াস ফাউন্ডেশনের ধারাবাহিক নানান সামাজিক পরিষেবা মূলক কর্মকান্ড। সুচিত হল প্রতিবন্ধী দিবসের নয়া পরিভাষা। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষের মনের মনিকোঠার জায়গা করে নিয়ে। একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকার। 

কি যে বলেন? আরে বাবা, এত ভুমিকার কি আছে? আচ্ছ আচ্ছা। উত্তরে তবে বলাই যাক এক অজানা প্রান্তিক উপাখ্যানের অজানা কথা। ২০০০ সাল। দুর্গাপুর শহরের অতি অখ্যাত গ্রাম। নাম কুলডিহা। মাত্র তেরো বছরের সেদিনের এক কিশোরী। মহুয়া ঘোষাল। তখনই দূরারোগ্য বন ক্যান্সার ধরা পড়ে তাঁর ডান পায়ে। চিকিৎসার নিরুপায় নিয়মে হাঁটুর উপর অংশ থেকে বাদ চলে যায় তাঁর সেই পাটি। এক হাঁটাচলা করতে পারা মেয়েটি সেদিন থেকে হয়ে গেল একজন চির প্রতিবন্ধী। একইসঙ্গে আর্থিক কষ্ট ও অসহায়ত্ব তাঁকে যে অক্টোপাশের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে জীবন বাঁচন সঙ্গীতে টপ্পার তাল ঠুকেছিল আর্থিক নিরুপায়ের যন্ত্রণা বরাবর। কি আর করার? এক পায়ের জীবনটাকেই মেনে নেন মহুয়া ঘোষাল।

এরই মধ্যে আচমকাই এই ঘটনার খবর কানে আসে সেন দম্পতির। মনে যাঁদের মানব সেবার ইস্তাহার লিখে দিয়েছেন স্বয়ং বিধাতা তখন কি আর পেশাদারীত্বের কথা মনে থাকতে পারে নাকি যুগল চিকিৎসকের। ফলে জীবন থেকে কুড়ি বছর কেটে গেলেও মহুয়া ঘোষালের জীবনে মসিহা উঠলেন তাঁরা। অবশেষে চলতি বছরের এই বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে এক কৃত্রিম পা উপহার পেলেন এই প্রান্তিক ৩৩ বছরের আজকের যুবতী। সৌজন্যে সেই প্রয়াস ফাউন্ডেশন। এক মুখ স্বর্গ হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মহুয়া ঘোষালের চোখে মুখে। অফুরাণ বুকভরা তৃপ্তির অনুভবে তিনি বলে উঠলেন, "বিধাতার নিয়তির লিখনে আমি কত কাল আগে এক পা হারিয়েছি। কিন্তু মানুষরূপী দুই দেবতা চিকিৎসক আমার স্বভিমানের পা আজ ফিরিয়ে দিলেন। ধন্য তাঁরা। আমার অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রয়াস ফাউন্ডেশনকে।"

মহুয়া ঘোষালের পাশেই তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রয়াস ফাউন্ডেশনের অন্যতম কর্ণধার দীপঙ্কর সেন ও দিপান্বিতা সেন। তাঁদের মন্তব্য, "এই সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজ সেবামুলক কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এই সংস্থার শুধুমাত্র সেবক। মহুয়া ঘোষালদের মতো বহু মানুষের পাশে আমরা সাধ্যমতো থাকার চেষ্টা করি। আসলে ওঁদের মুখে সারল্যের হাসিটা দেখতে যে আমাদের খুব ভালো লাগে।" দুর্গাপুরের এই চিকিৎসক দম্পতির কথায় পূর্ণ সহমত জানিয়ে ওই যুবতীর দাদা কৌশিক ঘোষাল বলেন, "বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন মানে শুধুমাত্র সেমিনার বা পদযাত্রা নয়। এই দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য আজ খুঁজে পেলাম এই দুই চিকিৎসক ও প্রয়াস ফাউন্ডেশনের এহেন কর্মকান্ডে। তাই বলতেই হয় আমার বোনের এই আত্মপ্রত্যয়ের উপহার পাওয়াতে এখন থেকে তাই লেখা থাকবে আজকের দিবসের এক গভীরতম মানবিক রূপকথা।"

নটে গাছটি মুড়ালো। মহুয়া ঘোষাল পা ফিরে পেল।

(www.theoffnews.com - world disabled day) 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours