সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

গতকাল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গুরুতর শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে আচমকা কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এই সংবাদ আগুনের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের প্রতিটি আনাচে কানাচে। তাঁর তুঙ্গস্পর্সী জনপ্রিয়তার কারণে রাজ্যবাসী একযোগে করেছেন আরোগ্য কামনা। সেটাই তো স্বাভাবিক। বিধানচন্দ্র রায়ের পর একমাত্র এই একজনই তো মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এযাবৎ যিনি বাংলার বুকে পুঁজিনিবেশ ও শিল্পায়ন নিয়ে অনেকটা পথ বাস্তবোচিত ভাবে অগ্রসর হন। এছাড়া বুদ্ধদেববাবুর অতি সাধারণ পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন মানুষের মনে একটা আলাদা সমীহ আদায় করে নিয়েছে গভীর ভাবে। তাই হয়তো তাঁর রাজনৈতিক এককালের জাত-বিরোধী তথা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি আজও। সুতরাং প্রত্যাশিত ভাবেই গণতন্ত্রের মাধুর্যতা বজায় রেখে রাজ্যের বর্তমান প্রশাসক দৌড়ে গেলেন সেই হাসপাতালে, যেখানে প্রাক্তনী প্রশাসক বিছানায় শুয়ে রয়েছেন প্রবল শ্বাসকষ্ট শুশ্রষায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোঁজ নিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত হাল হকিকৎ। বুদ্ধদেববাবুর অসুস্থতা অবশ্যই বেদনার। কিন্তু তাঁর জন্য যে বাস্তবিক উদ্বিগ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এই নজিরই তো গতকালকের বাংলার আলোচ্য উঠোনে সবচেয়ে বড়িহা ক্যাচলাইন। তাই না? একযোগে একটাই উত্তর-অবশ্যই মানে পাঁচশো শতাংশ অবশ্যই।

আরে দাঁড়ান দাঁড়ান। ক্যাচলাইন নিয়ে তো দারুণ কলার উচানো ব্যাপার স্যাপার দেখছি। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও কোনও অভিযোগ নেই এখনও পর্যন্ত। তাহলে? তাহলেটা হলো, সবার অলক্ষ্যে এই বহুল চর্চিত ক্যাচলাইনের পাশাপাশি একটা বড় ধরনের ক্যাচড্রপের ঘটনা ঘটে গেছে তা কি নজরে পড়েছে?

বুঝতে পারলেন নাতো? ঠিক আছে, ক্যাচড্রপের বেড়ালটা তবে ঝুলি থেকে বের করি কি বলেন। রাজ্যে বাম জমানা চলেছে ৩৪টা বছর। বাপরে বাপ। কি লম্বা শাসনকাল। সিপিআইএম'এর মতে তো এই যুগ নাকি রাজ্যের উন্নতি এমন নজির সারা ভারতে খুঁজে পাবে নাকো তুমি। তা বেশ বেশ বলতেই হয় তবে। বাকি রইল তৃণমূল শাসনের শেষতম চলতি দশক। ঘাসফুল শিবিরের ঢোলে বোল উঠেছে সারা বাংলা উন্নয়নের জোয়ারে খুশিতে ডগমগ হয়ে হাসছে। এটাও না হয় মানলাম। খুব ভালো। খুব ভালো কথা।

আচ্ছা নিশ্চয়ই আমরা সকলে জানি, বুদ্ধদেববাবু কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন? উত্তর হল, দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত বেসরকারি হাসপাতালে। আমি ভুল বলিনি তো? অনেকেই বলতে পারেন, উনি কোন হাসপাতালে নিজের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হবেন সেটাও কি আপনি ঠিক করে দেবেন? এমা নানা! আমি তা বলতে চাইনি। আমরা ঠিক করার কে? আমরা তো স্রেফ জনগন। মানে আম আদমী। আর ভোট বাজারের ভাষায় আমার হলাম গিয়ে ওই একপ্রকার ব্রয়লার মুরগি। তা যাক। উনি কোথায় ভর্তি হবেন তা নির্ধারণ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে উনার এবং উনার পরিবারের সদস্য সদস্যাদের।

আসলে প্রশ্নটা হল অধিকারের নয়। বক্তব্যটা হল নীতির। একই সঙ্গে সরকারি আস্থার। ও দৃষ্টান্তেরও। বুদ্ধদেববাবু তো নিজেই একদা এই রাজ্যেরই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। অথচ আজ তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গেলেন তাঁকে দেখতে সেখানেই। এই ক্যাচলাইনের ডিউজ বলটা কি কলকাতা বা রাজ্যের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের প্রবেশ পথে ক্যাচড্রপ হল না? সেই কংগ্রেস আমলের তৈরি করা সরকারি হাসপাতালগুলো? মনে কি পড়ে এই ইতিহাসের কথা সিপিএম ও তৃণমূল সরকার বাহাদুরের? ভাগ্যিস কংগ্রেস সরকার সেগুলো তৈরি করেছিল। তাই তো সেখানে পকেট ফাঁকাওয়ালা ব্রয়লার মুরগির দল এখনও নিরুপায় হয়ে প্রাণ বাঁচাতে যায় বটে। কিন্তু সিপিএমের ও তৃণমূলের সার্বিক ৪৪ বছরের দৃষ্টান্তের সুস্বাস্থ্য পরিষেবার ঠেলায় বাস্তবে অধিকাংশ সময় ব্রয়লার মুরগির প্রাণ বাঁচানো তো দূর অস্ত, প্রাণ ওষ্ঠাগতই হয়ে ওঠে। তবে এটাও ঠিক, ক্যাচড্রপ বাঁচাতে রাজ্যের নানা শহরে গজিয়ে উঠেছে লোপ্পা ক্যাচের ওস্তাদ ফিল্ডসম্যান স্বরূপ বেসরকারি সুপার স্পেসালিটি হাসপাতাল। তারা কিন্তু অন্য গ্রহের নয়। এই রাজ্যেই মানুষের স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণ করছেন এই পশ্চিমবঙ্গেই অবস্থান করে। শুধু শর্ত একটা। ছাড়ো বেশি কড়ি মাখো কম তেল থিওরিতে। আর সেখানেই যে ভর্তি হলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। অবহেলিত থাকলো একই শহরের নীলরতন হাসপাতাল। উপেক্ষিত থাকলো পিজি হাসপাতাল। ধর্তব্যহীন থাকলো কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। এখানেই তো প্রশ্ন কেন এমনটা ঘটবে? এই ঘটনা চক্রের আসল রসায়নটা তবে কি? 

যদি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের স্মরণাপন্ন হতেন তবে নিশ্চয়ই একটা দৃষ্টান্ত অবশ্যই তৈরি হতো। প্রকৃত সুস্বাস্থ্য পরিষেবার অপর নাম তবে নিশ্চিত হতো সরকারি হাসপাতাল। তখনই তো আমজনতা ভরসার বুক বেঁধে সরকারি হাসপাতালে যেতে মনের থেকে আগ্রহী হতেন চিকিৎসার সন্ধানে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো কৈ? বুদ্ধদেববাবুর বেসরকারি হাসপাতাল গমনের অর্থ কি তাহলে সরকারি হাসপাতালে সুস্বাস্থ্যের চুড়ান্ত নগ্নতা? ৪৪ বছরের দুয়োরানির বিক্ষত ভগ্ন স্বাস্থ্য কি সত্যি তবে এই সরকারি হাসপাতালগুলো? তাহলে এই সুদীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে সরকারে আসীন মুখ্যমন্ত্রীরা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা কি করলেন জনস্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য? যেখানে নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে চিকিৎসা করাতে ভরসা পান না। ভোট তো যথারীতি রাজ্যবাসী আপনাদের দেয় অনেকগুলো বছর ধরে। কত আর কেন্দ্রের দোষ আর কেন্দ্রের দোষ বলে ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন বলুন তো? প্রশাসনে থেকে রাজনীতির উর্ধে উঠে আর কবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবেন আপনারা? আবার তো ভোট চলে এলো। ফের নির্লজ্জের মতো হাত জোর করে জনতার দুয়ারে তো আসবেন ভোট চাইতে। আবার বলবেন তো, এবারের মতো ভোট দিন আমাদের, আমরা আপনাদের উন্নত সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা দেব। কিন্তু বিগত দিনের আপনাদেরই দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ৪৪ বছরে আপনারা কি পরিষেবা দিলেন রাজ্যবাসীকে? বুদ্ধদেববাবুর কথা আর না তোলাই ভালো এখন। শোভনীয়ও নয়। কারণ উনি জবাব দেবার মতো পরিস্থিতিতে নেই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! আপনি তো কিছু বলতেই পারেন। বলুন না প্লিজ বুদ্ধদেববাবুকে এই ৪৪ বছর পড়েও কেন রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল বাদ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হল? এটা কি শুধুই উনার বা উনার পরিবারের নিজস্ব চয়েজ? নাকি নির্লজ্জ স্বাস্থ্য ফাঁকির বাধ্যবাধকতা? কোনটা?

(www.theoffnews.com - Buddhadeb Bhattacharya Mamata Banerjee health government hospital West Bengal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours