শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারত উপমহাদেশের মুসলিমদের কাছে জাতির পরিচয় কি, তা  জানতে  প্রশ্ন করে দেখুন। অনেকেই বলবে, 'আমরা মুসলিম'।  জাতি আর সম্প্রদায়ের পরিচয় তো এক হয় না। তবে কি ভারত উপমহাদেশের মুসলিমরা তাদের পরিচয় সংকটে ভুগছে? আপনার জাতির নাম কি, আপনি কখনো, কোন তুর্কি মুসলমানকে প্রশ্নটি করেছেন? বা কোন আরব মুসলমানকে? অথবা কোন মিশরীয় বা ইরানি মুসলমানকে প্রশ্ন করেছেন, আপনার জাতির নাম কি? তাহলে আরব মুসলিমরা বলবে, আমি আরব। ইরানি মুসলিম বলবে, আমি ইরানি। মিশরীয় মুসলিম বলবে আমি মিশরীয়, তুর্কি মুসলিম বলবে, আমি তুর্কি। ইয়েমেনের মুসলিম বলবে, আমি ইয়েমেনি। 

এ বিষয়ে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়। তারা অধিকাংশই জাতির পরিচয় জানতে চাইলে উত্তর দিয়ে থাকেন, 'আমি মুসলমান'। জাতির পরিচয়ে এমন উত্তর কেবল, মক্তবে যাওয়া, বা কওমি ও আলিয়া, খারেজি মাদরাসায় পড়ুয়ারা দিয়ে থাকলে, কথা ছিলো না। হয়তো তাদের এমন শিক্ষাই (?) দেওয়া হয়। কিন্ত অবাক হই, যখন কোন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা জাতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, 'আমি মুসলমান'!  অনেকেই সম্প্রদায় ও ধর্মীয় পরিচয়কে জাতীয় পরিচয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। একজন বাঙালি, গুজরাতি, পাঞ্জাবি, বেলুচ, সিন্ধি, পশতুন তারা যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, তার জাতির পরিচয় একই থাকে। একজন  পাঞ্জাবি, সিন্ধি বা বাঙালি, হিন্দু হতে পারে, মুসলিম হতে পারে, খৃস্টান হতে পারে, শিখ হতে পারে, বৌদ্ধ হতে পারে, নাস্তিক হতে পারে। 

তাতে তার জাতিগত পরিবর্তন ঘটে না। ধর্ম মানুষের সাম্প্রদায়িক পরিচয়, জাতীয় পরিচয় নয়। জাতি পরিচয়, ধর্ম পরিচয় এক নয়। একজন মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে এক মূহুর্তেই তার সাম্প্রদায়িক পরিচয় পরিবর্তন করতে পারেন। কোন ব্যক্তি এক হপ্তায় তিনটি ধর্ম পরিবর্তন করে তিনবার তার সাম্প্রদায়িক পরিচয় পরিবর্তন করতে পারবে। কিন্তু একজন বাঙালি, একজন বেলুচ, একজন সিন্ধি, একজন পাঞ্জাবি কি, তার ভাষা, সংস্কৃতি, চিন্তা -চেতনা আচার ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস আমৃত্যু পরিবর্তন করতে পারে? পারে না। লোভ দেখিয়ে, বিভ্রান্ত করে, ভুল চেতনায় মোহগ্রস্ত করে সাময়িক মগজ ধোলাই করা যায়। নির্যাতন করে, মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে যুগ যুগ দাবিয়ে রাখা যায়। কিন্তু হাজার বছরের সভ্যতা সংস্কৃতিকে বাতিল করা যায় না। একটি জাতির সভ্যতার সাথে সে জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক পিতা মাতা সাথে সন্তানের সম্পর্কের মত। পিতা মাতা তার সন্তানকে তাজ্য করলেও বা সন্তান তার পিতা মাতাকে তাজ্য করলেও অংশীদারত্ব ও পরিচয় বাতিল হয় না।  এক তালাক দুই তালাক, তিন তালাক বললে, বিবি তালাক হয়। কিন্তু কোন উসিলায় 'বাইন তালাক' বললেও জাতির সাথে জনগোষ্ঠীর সম্পর্কচ্ছেদ হয় না। ধর্মীয় পরিচয়ে, কোন আরবীয় ব্যক্তি খৃস্টান, মুসলিম, ইহুদী হতে পারে, হয়ও। কিন্তু জাতিতে তারা সকলেই আরব। তুর্কির বেলাতেও তাই। কোন ইরানি নিজের জাতির পরিচয় দিয়ে বলে না, তারা শিয়া বা মুসলিম। তারা বলে আমরা ইরানি, এবং তা বলে তারা গর্বিত। তুর্কিরাও আত্ম অহংকার করেই বলে, তারা তুর্ক। তুর্কি ও ইরানিরা আরবের ইসলাম গ্রহন করলেও তারা তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি সাহিত্য ছাড়েনি। ইরানিদের সাহিত্যে সোহরাব রুস্তম জনপ্রিয়। তারা পারস্য সাহিত্য, সভ্যতার ও সংস্কৃতির কিছুই পরিত্যাগ করেনি। ইন্দোনেশিয়ার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। তারা তাদের মুদ্রায় হিন্দু দেবতা গনেশের ছবি পর্যন্ত রেখেছে। অথচ ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ, মুসলিম জনসংখ্যার সংখ্যার বিবেচনায়। মিশরীয়রা তাদের সভ্যতাকে নিয়ে গর্বিত, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। মিশরীরা, যে যত বেশি শিক্ষিত, সে তত বেশি গর্বিত তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে। মিরামিড ও মমি নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। অথচ  ভারতবর্ষের মুসলিমরা আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছেন। এটা চিন্তার দৈনতা, মুর্খতা না ধর্মান্ধতা তা নির্ণয় করা কঠিন। ইতিহাস ও সভ্যতার জ্ঞান চর্চা, না থাকলে যা হয়! 

বিস্ময়কর বিষয় হলো, ভারত ও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এসব 'স্পর্শকাতর' প্রশ্নে নীরব থাকলেও পাকিস্তানের মত মৌলবাদী 'জেহাদি' রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা নিরবতা পালন করে না।  একটি অনুষ্ঠানে একজন ডেলিগেট  বক্তব্য দেওয়ার সময় বলছিলেন 'মুসলিম নেশন' মডারেটর, ডক্টর আরিফা সৈয়দ জাহরা তো ডেলিগেটকে থামিয়ে তখনি প্রশ্ন করেন, 'মুসলিম নেশন' বলে আদৌ কিছু আছে কি না? ডেলিগেট 'স্লিপ অব টাং' বলে পার পেয়ে যান। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত একটি সিম্পোজিয়ামে এ ঘটনা ঘটে। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হাসান নিসার তো আরো দু কদম এগিয়ে বলেন, আরবদের স্পেন জয়ে ভারত ও পাকিস্তানি মুসলানদের গর্বের কি আছে। যারা বিজয়ী ছিলো তারা সকলেই আরব। এমন কি তিনি পাকিস্তানি হয়ে, মুহাম্মদ বিন কাশিমকে একজন, দখলকারী আরব মনে করেন। ইতিহাসও তাই বলে। মুহাম্মদ বিন কাশেম একজন আরব যিনি ভারতবর্ষ আজকের (পাকিস্তান) দখল করেছিলেন।  

কিংবদন্তি বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর শাহবাজ খান ভুকতি, (আকবর ভুকতি) যিনি পাকিস্তানের  ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রী সভাতেও ছিলেন। তার রাজনৈতিক কেরিয়ার বেশ দীর্ঘ। একবার তার জাতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমরা বেলুচ, সাড়ে সাত হাজার বছর ধরে, আমরা বেলুচ। এমনকি আমরা মুসলমান নই। আমরা মুসলমান হয়েছি মাত্র ১৪'শো বছর আগে। বেলুচরা তাদের জাতিসত্তা নিয়ে এত গর্বিত যে তারা, তাদের নামের শেষে বেলুচ শব্দটি সংযুক্ত করে। বাংলাদেশের  অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন, আমরা আগে বাঙালি তারপর অন্য কিছু। ভারত ও বাংলাদেশে যারা বাঙালি, তারা হিন্দু হোক, মুসলিম হোক বা খৃষ্টান তারা বাঙালি। হ্যাঁ অবশ্যই তারা বাঙালি  দুই দেশের নাগরিক হয়েও। আবার আমাদের সাথে বাস করে চাকমা গারো মুরং খাসিয়া এক দেশের হয়েও তারা ও আমরা এক জাতির নই। জাতি কাকে বলে তা জানার জন্য মহাপন্ডিত হতে হয় না। প্রাথমিক বিদ্যালয় অথবা  বড় জোড় মাধ্যমিকের বইগুলো পড়লেই হয়। কিন্তু আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে, আমরা যা পড়ি-পড়াই, শিখি -লিখি এবং যা জানি, তা  মানি না! মানি অন্য কিছু। এমন পরিচয় সংকট থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর যে কোন সভ্য দেশে অথবা কোন সুশিক্ষিত মানুষের সামনে কেউ যদি তার জাতীয় পরিচয় দিতে গিয়ে জাতির নাম না বলে, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় দেয়। তবে ভিন্ন জাতির মানুষ তার আক্কেলবোধ নিয়ে হাসাহসি করবে।

(www.theoffnews.com - Bangladesh Pakistan India Muslim nation)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours