সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:

যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একদিন ক্লাস শুরুর আগে বেঙ্গল ল্যাম্পের গেট দিয়ে ঢুকেই আমাদের আর্টস বিল্ডিং -এ ঢুকেছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা -র চমক খেয়ে দেখি তরতর করে নেমে আসছেন তিনি - উজ্জ্বল রঙের শাড়িতে প্রাণচঞ্চল। তখন সদ্য অবসর নেবার পরেও প্রায়ই আসতেন ডিপার্টমেন্টে। সদাচঞ্চল এক বালিকাকেই যেন দেখতে পেতাম তার চোখের তারায়, চলাফেরায়, তা বয়স যতই সংখ্যা বাড়িয়ে চলুক না কেন। কপালে তার সিগনেচার গোল বড় টিপ আর হাতে। একরাশ বই। মুখোমুখি হবার মূহুর্তে ধুমধাম ধপাস, বইগুলো হাত থেকে পড়ল। সিঁড়িময় ইতস্তত ছড়ানো বই, বিব্রত মুখে তিনি। কুড়িয়ে তুলে দিলাম হাতে, উপচানো অফুরান হাসিতে ধন্যবাদ উপহার দিয়ে নেমে গেলেন। পরে মনে হলো, এত কাছে পেয়েও কিছু বলা হলো না। সেমিনারে কয়েকবার তার বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হলেও একেবারে সামনাসামনি সাক্ষাত সেই একদিনই সিঁড়িতে, তিনি নবনীতাদি, ভাল -বাসার বারান্দার বাসিন্দা নবনীতা দেবসেন। 

নবনীতাদিকে চিনেছি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে। ভালবেসে যাদের লেখা পড়েছি আর আগামীতেও পড়ব - সেই অনন্ত সুতো দিয়ে গাঁথা মালায় নবনীতাদি এক উজ্জ্বল মুক্তো। ধানসিঁড়ি নদীর তীরে বা চৈত্রের শালবনে ফিরে ফিরে আসা জন্ম জন্মান্তরের এক জীবন প্রেমিকা, যে তার উল্টো স্বভাবের মতোই কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গাকে দেখে মনে মনে ভাবে মর্ত্যের শেষ সীমা বৈতরণীর কথা, বুকের মধ্যে দিয়ে বইতে দেয় তাকে আর হৃদগঙ্গায় সন্ধান পায় অমৃতকুম্ভের। 

নবনীতাদি নিজেই বলেছেন - ''তুমি নিজে যদি মনে করো তুমি মুক্তপ্রাণী তোমাকে বদ্ধ প্রাণী করতে পারে হেন সাধ্য কারুর নেই। সবাই তো আর গৃহপালিত জীব হয় না, কেউ কেউ বন্যপ্রাণী।'' তাই জীবনটাকেই উপবন বানিয়ে স্বচ্ছন্দ ও সঠিক অর্থে বিচরণ করে গিয়েছেন তিনি। অনায়াস ভ্রমণে নিজেই মুখোমুখি হয়েছেন নিজের। তুচ্ছতার যাপনকে তুড়ি মেরে নিজেই নিজের কাঁধে হাত রেখে কখনো বলেছেন 'চিয়ার আপ ওল্ড গার্ল', কখনো বলেছেন 'কামেন ফাইট'।

বয়স, হাজার একটা অসুস্থতা সত্ত্বেও নবনীতাদির গা থেকে তাজা ঘাসের মতো টাটকা জীবনের সুরভির বিচ্ছুরণ টের পেত আশেপাশের মানুষ। তিনি একইসঙ্গে পুষ্প ও বৃক্ষ - সৌন্দর্যে মুগ্ধ ও পরিণতিতে ঋদ্ধ করেন।

নবনীতাদি বলেছিলেন যে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের সময়ের প্রধানতম বলক্ষয়কারী রোগ যা অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, যার নাম 'পিছুটান', তার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। দিদি সম্বোধন করলেও আমরা তো তাঁর পরবর্তী প্রজন্মই। কিন্তু পিছুটান পিছু ছাড়ল না তো, নবনীতাদি। নিজেকে উড়নচন্ডী বলে আক্ষেপ করে বলেছেন যে তাদের কেউ ভালবাসে না, তাদের চোখ যে পাখির নীড়ের মতো নয়, পাখির উড়ন্ত ডানার মতো হয়। এতদিন সবাইকে নিয়ে উৎসবের মতো হইচই করে বেঁচে ছিলেন, তাই গত একবছরের শারীরিক অনুপস্থিতিতে তাঁকে যেন প্রতিমুহূর্তে নতুনভাবে আরো বেশী করে অনুভব করেছি। গত ৭ই নভেম্বর নবনীতাদির চিরভ্রমণের পথে যাত্রা শুরুর এক বছর পূর্ণ হলো। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতোই তাঁকে অন্তর উজাড় করা প্রণাম জানালাম তাঁরই 'জন্মদিনের কবিতা ' স্মরণ করে --

'এক চোখে আধবিন্দু অশ্রু ঝুঁকে আছে /

অন্য চোখ খালি /

সে মেয়ে ঘুমিয়ে আছে? নাকি জাগরণে /

মগ্ন আছে? স্বপনে? মননে?/

সে মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। বামবাহু রেখেছে কপালে/

ডানহাত ঠোঁটে। যদি জেগে ওঠে/

এই স্তব্ধ গৃহস্থালি, সে মেয়ে জাগবে না। তার /

একচোখে অশ্রু ঝুঁকে আছে /

অন্য চোখ খালি। অহর্নিশি /

তার কানে বাজে /

বর্ষার ঝরণার মতো মত্ত করতালি /

সে- মেয়ে ঘুমিয়ে থাকে, এক চোখে /

অশ্রু নিয়ে, অন্য চোখ খালি।'

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours