প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:
পর্বতপ্রেমীরা সকলেই চেনেন রডোডেনড্রন গাছটিকে। হিমালয়ের পার্বত্যভূমিতে মোটামুটি ৩০০০ মিটার উচ্চতার পর থেকে এই বিশেষ গাছটির দেখা মেলে।
এই ফুলটিকে অনেকে পাহাড়ি গোলাপও বলে থাকেন। গ্রিক শব্দ "রডোন" কথাটির অর্থ গোলাপ আর "ডেনড্রন" কথাটির অর্থ গাছ। রডোডেনড্রন নেপালের জাতীয় ফুল। ভারতবর্ষের পাহাড়ি সব রাজ্যেই বিভিন্ন উচ্চতায় এই ফুল ও গাছটিকে দেখা যায়। তবে উচ্চতার তারতম্যের কারনে ফুলটি বিভিন্ন রঙের হয়। ভারতবর্ষ, নেপাল, ভুটানের বিভিন্ন উচ্চতায় গাঢ় লাল, কমলা, সাদা রঙের রডোডেনড্রন ফুল আমি দেখেছি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "শেষের কবিতায়" এই ফুলটির উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি এই ফুলের প্রেমে পড়েই অমিত ও লাবণ্যের প্রেমময় কাহিনীতে লিখেছিলেন-
“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।
নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণকিরণে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেনড্রন গুচ্ছ।"
মার্চ -এপ্রিল -মে মাসে হিমালয়ের পাহাড় জুড়ে এই ফুল ফোটে আর তার সৌন্দর্যে পাহাড় লাল হয়ে ওঠে। গুল্মজাতীয় এই গাছের প্রতিটি শাখায় তখন বিভিন্ন রঙের থোকা থোকা ফুলে ভরে ওঠে যার সৌন্দর্য এক কথায় বর্ননা করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য।
সমগ্র ভারতেই এই উদ্ভিদের আলাদা আলাদা ৮০ টি প্রজাতি পাওয়া যায়। হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন উচ্চতায় এই উদ্ভিদের নানান প্রজাতির আধিক্য লক্ষ্যনীয়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় এই গাছের ১৯টি প্রজাতির লক্ষ্য করা যায়। গাছটি মূলত ভেজা বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্মায়। যে মাটিতে অত্যধিক পুষ্টি ও মাটিতে অ্যাসিডের পরিমান বেশি থাকে সেই মাটিতে এই গাছ সবচেয়ে ভালো হয়
ভারতবর্ষ, নেপাল, ভুটান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাভা-সুমাত্রা, চীন, তিব্বত ও জাপানে মোটামুটি ১৯০০ প্রজাতির রডোডেনড্রনের দেখা মেলে। এই গাছটির নামকরণ করেন বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ কার্ল ফর্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই গাছটিকে স্থানীয়রা আল্পাইন রোজ, স্নো রোজ, বুরুশ, গুরাসও বলেন।
রডোডেনড্রনের ফুল থেকে একধরনের মৃদু উত্তেজক পানীয় তৈরি করা হয়। রডোডেনড্রন ওয়াইনের হালকা পানীয় গাঢ় লাল বর্ণের। এই পানীয় প্যাকিং করা অবস্থায় প্রায় সারাবছরই উত্তরাখণ্ডে পাওয়া যায়। বদ্রীনাথ ধামের পথে, তুঙ্গনাথের পথে পর্যটকদের আকর্ষণ এই পানীয়। আমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিবমন্দির তুঙ্গনাথের পথে এই পানীয় প্রথম পান করেছিলাম। হৃদরুগীদের জন্য এই পানীয় বিশেষ উপকারী।
সারা পৃথিবীতে শীতকালে ট্রেকিং জনপ্রিয় তবে রডোডেনড্রন এর সিজনে ট্রেকিং যাওয়া মানে পাহাড়ের আর এক মন কাড়া রূপ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করা। তখন সারা পাহাড় এই ফুলের শোভায় শোভিত হয়ে থাকে। যাঁরা ট্রেকিং করতে চান না অথচ পাহাড়কে ভালোবাসেন , ফুল ভালোবাসেন বা গাছ ভালোবাসেন তাঁরা ভারতের সিকিম, উত্তরাখন্ড, হিমাচলপ্রদেশে বা নেপাল, ভুটান ভ্রমণে গেলেও এই গাছটির সাথে পরিচিত হবেন। আমাদের রাজ্যের দার্জিলিংয়ের সান্দাকফুর পথেও এই ফুলের আধিক্য আছে।
তথ্যসূত্র :- উইকিপিডিয়া ও গুগল
ছবি :- গুগল থেকে সংগৃহীত ও প্রতিবেদকের নিজস্ব ক্যামেরায় তোলা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours