তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

কলকাতার ইতিহাস জানতে হলে কালীঘাটের কালীমাতার অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে৷ কলকাতার পত্তন ঘটে কালীমাতার অস্তিত্বের সঙ্গে অন্তশলীলা ভাগীরথীর প্রবাহের সঙ্গে৷ কালীঘাটের কালী মাহাত্বে "আচার-নির্ণয় তন্ত্র, মহালিঙ্গ- বচন তন্ত্র, চূড়ামণি তন্ত্রে কালীঘাটের বর্ণনা আছে৷ (১৫৪৪খৃ) কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীকাব্যে গঙ্গাতীরের বর্ণনা করেছেন সেই সঙ্গে সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের বংশধর বসন্ত রায় কালী মাতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন তার উল্লেখ আছে৷

বসন্ত রায় ছিলেন কালী ঘাটের বর্তমান সেবায়ত এর আদী পুরুষ ভুবনেশ্বর চক্রবর্তীর ব্রক্ষ্মচারীর মন্ত্র শিষ্য৷ তিনি কালীঘাটের জরাজীর্ণ মন্দিরকে পাকা পোক্ত মন্দিরের রূপ দিয়েছিলেন৷

এছাড়া গোবিন্দপুর,সুতানুটি, কলিকাতা যে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, সেই তিনটি গ্রামই সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের জমিদারীর অংশ বিশেষ৷ তাঁরাই এ জমির প্রকৃত মালিক৷ ইংরেজদের কেবল মাত্র লিজ বা পাট্টা দিয়েছিলেন (১৬৯৮) সালের ১০ই নভেম্বর৷ এর ও বহু পূর্বে সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশ (১৬০৮) এই অঞ্চলকে নবরূপ দিতে শুরু করেছিলেন৷ ক্রমে ক্রমে লোক বসতি বৃদ্ধি পেলে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে এই অঞ্চলের বদল ঘটাতে থাকেন৷ এর ও পূর্বে এই অঞ্চল ছিল ঝোপঝাড় জলা জঙ্গলে ভর্তি৷

ক্রমে ক্রমে বসতি স্থাপন শুরু করলো নিম্ন সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ৷ সেই সব সম্প্রদায় ভিত্তিক বসবাসের জন্য কিছু জায়গার নাম কলকাতা আজ ও বহন করে চলেছে৷ যেমন— কুমোরটুলি, মুচিপাড়া, যুগিপাড়া, কলুটোলা, চুনারি পাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি৷ ক্রমে এই সব অঞ্চলে শেঠ, বসাক, তাঁতি, দাদনী বণিকেরা বসবাস শুরু করেন৷ এর থেকে প্রমানিত হয় ব্যবসা বানিজ্যের সম্ভাবনা লক্ষ্য করে এখানে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা এবং বসতি স্থাপন বেড়ে যায়৷ শুধু তাই নয় ভৌগলিক নিরাপত্তা, মোগল রাজ কর্মচারীদের আনাগোনা, উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের ক্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধিতে ক্রমে জমজমাট হয়ে ওঠে এই অঞ্চল৷ (১৬৩২খৃ) শহিদ মিনারের দক্ষিণে বস্ত্র বোনার কারখানা গড়ে ওঠে৷ এই সব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ইংরেজ আনাগোনাও বেড়ে যায়৷ ক্রমে ইংরেজরা তাদের ব্যবসা বানিজ্যের জন্য এই অঞ্চলকে বেছে নেয়৷

এ সব দিক বিচার করলে একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়, জবচার্ণক কুঠি স্থাপনের বহু আগে থেকেই গোবিন্দপুর, সুতানুটি এবং কলিকাতা সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করেছিল৷ তখন কোথায় জবচার্ণক৷ জবচার্ণক কলকাতার জন্ম তো দূর শৈশবও দেখেননি৷ তাছাড়া তিনি কয়েকটি কুঠি নির্মান ছাড়া আর কিছুই করে যেতে পারেননি৷ তিনি পারা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান (১৬৯৪ খৃ)৷ জব চার্ণকের জামাতা চার্লস আয়ার ১৬৯৮ খৃঃ ১০ নভেম্বর ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কাছ থেকে তিনটি গ্রামের (গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলিকাতা) প্রজাস্বত্ত্ব ক্রয় করেন৷

মজার বিষয় কলকাতার উৎসবপ্রেমী মানুষ যখন মিথ্যার লেজ ধরে নিছক উৎসবের আনন্দে ভাসছিলেন, সাবর্ণ রায় চৌধুরীর বংশধর এবং কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর সহোযোগীতায় ২০০১ সালের ১আগষ্ট জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন৷ মোট নয় জন বুদ্ধিজীবী কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করে জানতে চান কোন ঐতিহাসিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে ১৬৯০খৃঃ ২৪শে আগষ্টকে কলকাতার জন্ম তারিখ ঘোষণা করা হল৷ তা জনসাধারণকে জানানো হোক এবং এই বিকৃত ইতিহাস সংশোধন করে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য পুস্তক সংশোধন করে সত্য ইতিহাস রচনা করা হোক৷

২০০৩ সালের ১৬ মে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পৌরসভার সম্পূর্ণ সমর্থনে কলকাতা উচ্চ আদালত সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদ এবং নয় জন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে রায়দান করেন৷

কলকাতা নগরের জন্ম তিনশো বছর বা তার কিছু বেশি বলে ঘোষণা করে (১৬৯০ এর ২৪ শে আগষ্ট কলকাতার জন্মদিন বলে জয়ধ্বনি দিয়ে যে মহোৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার সেই ভ্রান্ত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন ২০০১ সালের ১লা আগষ্ট৷ ২০০৩ সালে ১৬ ই মে কলকাতা যে প্রাচীন এক শহর সেই সত্যকে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেন৷

অতএব জবচার্ণক কোন মতেই কলকাতার জন্মদাতা নন৷ এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি মিথ্যা৷ তাই জবচার্ণকের কলকাতা বলে কিছু নেই৷ এটি ভ্রান্তিবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়৷ তাই নির্দ্বিধায় বলা যেতেই পারে "কলকাতা ছিল কলকাতাতেই"— (সমাপ্ত)

তথ্য সূত্র—

কলিকাতা সেকালের ও একালের—হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।

কলকাতার ইতিবৃত্ত—প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।

বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা কালীক্ষেত্র কলিকাতা—

ভবানী রায় চৌধুরী।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours