পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কিন্তু কিন্তু করে পরিতোষকে ফোনটা করতেই সে তো আহ্লাদে আটখানা। বলেন কি দাদা, বৌদি আসতে চান, এ তো দারুণ ব্যাপার। নিয়ে আসুন আপনি, আমাদের বাড়িতেই থাকবেন বৌদি কোনও অসুবিধা হবে না। পরিতোষের সম্মতি পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। মাস তিনেক হল বিয়ে হয়েছে, কীর্ণাহারে একটা স্টোরি করতে যাওয়ার আগে বায়না ধরল নববিবাহিতা স্ত্রী, সেও সঙ্গে যেতে চায়। নতুন বৌ, মানা করা মুশকিল, সেও বেচারা চাকরি ছেড়ে এই গঞ্জে এসে দিন কাটাচ্ছে। তাই কি করা যায় জানতে চেয়ে ফোন করেছিলাম পরিতোষকে। পরিতোষ আমার ইটিভির তৎকালীন সহকর্মী, এখন অবশ্য এবিপি আনন্দের সাংবাদিক। যাই হোক ২০০৪ এর এক সকালে আমরা কত্তা গিন্নী বেরিয়ে পড়লাম বাসে চেপে। গন্তব্য দাশকলগ্রাম, পরিতোষের তখনকার বাড়ি। ঠিক হল স্ত্রীকে সেখানে রেখে আমরা বেরবো খবর করতে। দুপুরে ফিরে একটু বেড়িয়ে সন্ধেয় ফের সিউড়ী ফেরা। 

পরিতোষের গ্রামে যেতেই দেখলাম বৌ এর আমার মুখটা বেশ ঝকমকে হয়ে উঠেছে। চারিদিকে সবুজ, মাঝে ছোট্ট গ্রাম, মাটির বাড়ি সব মিলিয়ে ছবিতে দেখা গ্রামের মতই। পরিতোষদের বাড়ি দেখে তো আরও মুগ্ধ আমরা দুজনেই। মাটির দোতলা বাড়ি। তালগাছে ঘেরা পুকুর। আম জাম কাঁঠাল গাছে ভরা বাগান। আমার স্ত্রী তো উচ্ছ্বসিত। ওকে ওখানে রেখে আমরা আমাদের কাজ সেরে ফিরে এলাম দুপুর নাগাদ। এর পর মধ্যাহ্ন ভোজন, সে কথা মনে করেও কেমন আতঙ্ক হয়। কাঁসার থালায় উপুড় করা ভাত। তিনটে বেড়াল বোধহয় লাফ দিয়ে ডিঙোতে পারবে না, তার পরে থরে থরে বাটি সাজিয়ে গোল করে দেওয়া থালার পাশ দিয়ে। দেখেই আমাদের দুজনের চোখ ছানাবড়া। কতটা কি খেয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই, তবে খাওয়ার পরে বিশ্রাম নিতে হয়েছিল তা মনে আছে। মে মাস, বেশ গরম, কিন্তু মাটির দোতলায় এক অনাস্বাদিত ঠান্ডা। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে পরিতোষের প্রস্তাব মত আমরা বেরোলাম গ্রাম দেখতে। 

আট দশটা মত বাড়ি ছাড়াতেই গ্রাম শেষ, মাঠের শুরু। সবুজ ধানের ক্ষেত, চোখের আরাম। ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে ছোট্ট রেললাইন। ঝিরি ঝিরি হাওয়ায় বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মন্দ লাগছিল না। একটু পরেই দেখি আমার স্ত্রীর অস্ফুট অবোধ্য আওয়াজ। তাকাতেই নজরে এল উত্তেজনার কারন। সবুজের বুক চিরে ছুটে আসছে ছোট্ট রেলগাড়ি। সেই অপু দুর্গার চিরন্তন দৃশ্য। সে ছবি আজও ভুলতে পারিনি। আমার স্ত্রীর তখনই বায়না “এই ট্রেনে চড়বই”। পরিতোষই সমাধান করল, বিকেলে আমরা যখন ফিরব তখন দাশকলগ্রাম স্টেশন থেকে উঠে খানিকটা যাওয়া যেতেই পারে। 

পরের দৃশ্য বিকেলে, আমরা পৌঁছেছি দাশকলগ্রাম স্টেশনে। স্টেশনে পৌঁছে তো আবার অবাক। হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। গোটা এলাকা জুড়ে বসে গিয়েছে বিকিকিনির পসরা। আলু পেয়াজ উচ্ছে পটলের পাশেই রয়েছে বাচ্চাদের গেঞ্জি জাঙিয়া। ট্রেন লাইনের উপরে বসেছে ফলের বাজার, তার ওপাশে মশলাপাতি। প্ল্যাটফর্ম সেভাবে কিছুই নেই, যেটুকু আছে, তাও বোঝার উপায় নেই। কারন কোথাও ডাঁই করা কুমড়ো মাপা চলছে, কোথাও আস্ত মুরগি নিয়ে বসে আছে বিক্রেতা। অবাক দৃষ্টিতে পরিতোষের দিকে তাকাতেই একটু হেসে সে জানাল, আজ হাটবার। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে এই স্টেশন চত্বরে। তাই একটু ভিড়, নাহলে ফাঁকাই থাকে। 

ঠিক আছে, কিন্তু ট্রেন আসবে বা দাঁড়াবে তো? জিজ্ঞাসা করতেই সক্কলে মিলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, দাঁড়াবে না মানে? আলবাত দাঁড়াবে। এবার তাহলে টিকিট কেটে ফেলি? চারপাশে খুঁজে পেতেও টিকিট কাউন্টার নজরে পড়ল না। কিন্তু টিকিট না কেটে উঠি কি করে? সকলেই জানাল টিকিট লাগবে না, এখানে কেউ ধরে না। কিন্তু আমার স্ত্রীও এককাট্টা আমার সঙ্গে, টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠব না। অগত্যা পরিতোষই ভরসা। কার সঙ্গে কথা বলে সে দেখলাম এগিয়ে গেল একটা গামছার দোকানের দিকে। গামছা বিক্রেতাকে কি একটা বোঝাতে লাগল আমাদের দেখিয়ে। ঠিক বুঝতে না পেরে এগিয়ে গেলাম আমিও। গিয়ে যা বুঝলুম তাতে চোখ কপালে উঠল আরও দু ধাপ। টিকিট কাউন্টারটাই এখন গামছার দোকান। গামছা বিক্রেতাকে বললে সেই টিকিট দিয়ে দেবে। তাকে টাকা দিতেই সে তার ঝোলানো গামছা সরিয়ে কাউন্টারের জানালা থেকে টিকিট নিয়ে এল। 

দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের জন্য, আবার আমার স্ত্রী কেমন হাউমাউ করে নড়েচড়ে উঠল। এবার তাকিয়ে দেখি একটা মাঝারি মাপের ছাগল তাকে গুতো মেরেছে। আসলে ওই ছাগলের জায়গাতেই বোধহয় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেটা সে ঠিক পছন্দ করেনি। ন্যারো গেজ লাইন, টয় ট্রেনের মতই এই রেলগাড়ির চেহারা। কাটোয়া-আহমেদপুর শাখার এই ট্রেনে আমরা যাব কীর্ণাহার স্টেশন পর্যন্ত। সেখান থেকে বাস ধরে সিউড়ী। প্রসঙ্গত বলে রাখি ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় এই ট্রেন চলাচল। ১৯৬৬ সালে ভারতীয় রেল তা অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে। এখন অবশ্য এখানে বড় ট্রেন চলে। 

এরই মধ্যে হঠাৎ ব্যস্ততা তুঙ্গে স্টেশন চত্বরে। লাইনে বসে থাকা ফল সরানো, গেঞ্জি জাঙিয়া চটজলদি তুলে ফেলা। হাত ফস্কে চলে যাওয়া মুরগিগুলিকে সামলানো। বেশ একটা শশব্যস্ততা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ট্রেন আসছে। এলও, আমরা একটা কামরাতে উঠে বসবার জায়গাও পেলাম। মিনিট দশেক গুছিয়ে বসার পরও ট্রেন ছাড়ছে না, কি ব্যাপার। পরি খবর নিয়ে এল ড্রাইভার এবং গার্ড সাহেব নাকি হাটে বাজার করছেন তাই দু দশ মিনিট সময় লাগবে? বোঝ কাণ্ড... এমনও হয়? যাই হোক আরও মিনিট দশেক পরে বোধহয় তাদের বাজার সম্পন্ন হল, ছাড়ল ট্রেন। পরি অবশ্য ট্রেনে আসেনি, সে বাইকে চলে গিয়েছে, আমাদের আগেই কীর্ণাহার পৌঁছে যাবে। 

ট্রেন তার নির্ধারিত গতিতেই চলেছে। বৌ-এর মুখখানি দেখে মনে হল বেশ মজা পাচ্ছে ব্যাপারটিতে। অন্যান্য যাত্রীদের প্রায় সকলেরই চোখ আমাদের দিকে। কেউ কেউ কৌতুহল বশত জিজ্ঞাসাও করে ফেললেন, কোথায় যাব, এতে কেন যাচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঠের মধ্যে দিয়ে, এর ওর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফের থমকে গেল ট্রেন, আবার কি হল? ট্রেনে উঠলেন এক যাত্রী, তিনিই জানালেন এখানে ড্রাইভার দুধ নেয়। রোজই থামে। মানে? এটা স্টেশন নয়? নয়ই তো, এই পাড়ার এক বাড়ি থেকে দুধ নেওয়া হয়, তাই সেই দুধ নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেল ট্রেন। দরজা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখলাম, ঠিক তাই। এক মহিলা দুধের ক্যান তুলে দিচ্ছেন ইঞ্জিনে। সেই সুযোগে দু একজন নেমেও গেল সেখানে।

কীর্ণাহারে নেমে এবার আমাদের বাস ধরার পালা। পরিতোষদের নতুন বাড়িটি তৈরি হচ্ছিল তখন, সেটি দেখে বাসে চাপলাম আমরা। মনে কিন্তু রয়ে গিয়েছে সেই ছোট ট্রেনের রেশ। দুজনের কথাতেই ফিরে ফিরে আসছিল তা। যাই হোক, যেমনই হোক ছোট্ট ট্রেনের সেই যাত্রাটা কিন্তু দারুণ ছিল। ছোট রেল নিয়ে পরে নানা মজাদার খবর করেছি আমরা। খুব ইচ্ছে ছিল সেই দৃশ্যগুলির ছবি তুলি। কিন্তু স্টিল ক্যামেরা নিয়ে যাইনি, আবার আমি এখনও আনস্মার্ট, আমার মোবাইল তখন ছিল আনস্মার্ট। তাই সেই দৃশ্যগুলি খুব মিস করি। বিশেষ করে টিকিট কাউন্টারে গামছার দোকান আমি জীবনে ভুলব না। এর বছর দুয়েক পরে আমি বীরভূম থেকে চলে আসি। ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় ছোট রেল। ২০১৮ তে সেই জায়গায় চলে আসে বড় রেল। তবে যে যাই বলুক আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছিলাম বীরভূমের ওই ছোট রেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। আমার খুব পছন্দের এবং ভালবাসার রেল ছিল ওটা। এখন বড় ট্রেন বড় লাইন, পাশ দিয়ে গেলে দেখি বটে, কিন্তু সেই ছোট রেলের জন্য কষ্টটা উথলে ওঠে।

(ছবি সৌজন্যে:প্রতিবেদক স্বয়ং।) 

(www.theoffnews.com - ticket rail kirnahar birbhum) 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours