সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী। উক্তিটা খুব চেনা চেনা না? আচ্ছা ভাবুনতো, উক্তিটা যদি এমন হতো! হবুচন্দ্র রানি গবুচন্দ্র মন্ত্রী। হাহাহা। শুনতে কেমন কেমন লাগল বলুন? যাক কাষ্ঠ আলাপ বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। গত ৫ নভেম্বর নবান্নে বসেছিল প্রশাসনিক বৈঠক। হাবে ভাবে যেন মনে হল এতো রাজ দরবারি খানার আয়োজন। রানির ইচ্ছাই হল গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। বাকি সব বকয়াস। তবে নবান্নের দরবারে লিড রোল করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাজির বাংলার পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকী প্রশ্ন দুর্গাপুর নগর নিগমের মেয়র দিলীপ অগস্তির কাজের মূল্যায়ন নিয়ে। সঙ্গত কারণে তিনি এটা জানতেই পারেন। ফিরহাদ হাকিম জানালেন, উনি কাজ করছেন না। এই মতামত প্রকাশ করাও মন্ত্রীর সাংবিধানিক দায়িত্ব। এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, "চেঞ্জ করে দাও।" একেবারে অন ক্যামেরার সামনে। প্রকাশ্যে খোলাখুলি। যা প্রচারিত হয়েছে কতিপয় সংবাদ মাধ্যমে। অনেকটা লঘু আবরণে। 

প্রশ্নটা কিন্তু এখানেই। একজন ভোটে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি কি প্রকাশ্যে এভাবে বলতে পারেন "চেঞ্জ করে দাও।" এটা তো তৃণমূল দলের মিটিং নয়। একেবারে বিশুদ্ধ সরকারি বৈঠক। তাও আবার ভোটে নির্বাচিত হয়ে মেয়র পদে আসীন রয়েছেন যেখানে দিলীপবাবু। চেঞ্জ হবে কি হবে না তা আলাদা বিষয়। কিন্তু গণতন্ত্রের শিষ্ঠাচার মেনে এই মন্তব্য কি সত্যি মানায় একজন মুখ্যমন্ত্রীর গলায়? এটা কি মগের মুলুক নাকি? চেঞ্জ করবেটা কি করে শুনি? উনার ইচ্ছা হল ব্যাস সেটাই গণতন্ত্রের মান্যতায় চেঞ্জ শিলমোহর পড়ে যেতে পারে? তাজ্জব তো? 

২০১৭ সালে দুর্গাপুরের পুরভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই শিল্পশহরে কান পাতলে শোনা যায় সেদিন ঘটেছিল ভোটের নামে ভোটলুঠের প্রহসন। এই ভোটে জনগনের ইচ্ছেকে শাসকগোষ্ঠী বলি চড়িয়েছে বলে অনেকে আজও মনে করেন। ৪৩ সিট। ৪৩টাই দখল। এখন তো বনিবনার অভাবে নিজেরাই নিজেদের বলির পাঁঠা বানিয়ে কূপকাঠে চড়াচ্ছে মেয়রকে। মুখ্যমন্ত্রী বচনে সেটাই এখন যেন জলের মতো পরিস্কার। দিলীপবাবু প্রকৃতই মানুষটা রাজনীতিক নয়। আপাদমস্তক প্রাক্তন ব্যুরোক্রাট। একদা মুখ্যমন্ত্রীর গুডবুকে থাকা এই ভদ্রলোকটি মেয়র পদে নির্বাচিত হন সাংবিধানিক নিয়ম মেনেই। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে মেয়র পদে তাঁর থাকাটা অনেকের পক্ষেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তাঁর কাছে দল বড় ছিল না। ফাইলের বিধিটাই প্রাধান্য পেয়েছে বরাবর। ফলে শুরু হয় দলের সঙ্গে একটা দূরত্ব। তারই চুড়ান্ত ক্লাইমেসের নাটক অনুষ্ঠিত হয় নবান্নের বৈঠকে। এটাই কিন্তু ইস্পাত নগরীর প্রবল হালফিল ফিসফাস। 

মুখ্যমন্ত্রীর রাজনীতির ঘরানা সম্পর্কে যারা জানেন তাদের বক্তব্য, মমতার কোনও কাজ আপাতত দেখলে মনে হবে যেন উনি সব তাৎক্ষণিক করছেন। এই মনে হওয়াটা পুরোপুরি ভুল। উনি যা করেন তা পূর্ব পরিকল্পিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সব করেন। এখানেও কিন্তু তাই হয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞের অভিমত। এই যে ফিরহাদ ও মমতার কথাবার্তার ঘটনা ঘটল ক্যামেরার সামনে তা সব কিন্তু প্রি প্ল্যান করা সাজানো নাটকের একটা দৃশ্যমাত্র। জাস্ট শো অন করা হল স্ক্রিপ্ট অনুসারে। নিন্দুকের তো সেরকমই টিপন্নি আড়ালে আবডালে।

প্রশাসনিক কথা বাদ না হল। রাজনীতিতেও একটা সৌজন্যতা থাকে। এটা হতেই পারতো গোপনে ফিলার মারফৎ পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারতো। বা অনাস্থা ডেকে পদত্যাগে বাধ্য করানো সুযোগ যে রয়েছেই মেয়রের বিরুদ্ধে। রাজনীতিতে অনেক প্রতিষ্ঠিত অবকাশের সুযোগ আছে। কিন্তু মমতার বক্তব্যে কি মেয়রের পদমর্যাদাকে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় আঘাত করলো না? এই প্রশ্নটাই কিন্তু বড্ড বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতির ময়দানে। যখন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করছেন তখন কিন্তু এই মমতাই বলছেন গণতন্ত্র বিপন্ন করছেন রাজ্যপাল। আবার সেই তিনিই যখন মেয়র নিয়ে প্রকাশ্যে একই ভাবে সমালোচনা করছেন তখন কি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেই সযত্নে লালিত করছেন মুখ্যমন্ত্রী? একটিবার ভাবুনতো, দিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে বসে ক্যামেরার সামনে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন রাজ্যপালকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কোনও সরকারি বৈঠকে, "চেঞ্জ করে দাও।" আর তা প্রচারিত হল মিডিয়াতে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সেক্ষেত্রে আপনি কি করতেন? মহা সুখ সঙ্গে প্রভূত সম্মান উপলব্ধি করে উত্তরবঙ্গ সফরে কি যেতেন তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য অনুভব করার তাগিদে? মনে হয় না। কারণ সহানুভূতি আদায়ের আপনার নানা কর্মসূচির রাজনৈতিক কৌশল জনগন জানেন। আপনার কাছে যে সম্মান প্রত্যাশিত সেই সম্মান ফিরিয়ে দেবার দায়বদ্ধতাও বোধ হয় আপনার তাই না ম্যাডাম মুখ্যমন্ত্রী? আপনি ভুলে গেলেও আমি মনে করিয়ে দিলাম কেমন। শ্রদ্ধা নেবেন। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours