সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:
বুয়েনস্ আয়েরস থেকে কলকাতা। পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত! কি ভাবছেন দূরত্ব কতটা? কাগজ কলম নিয়ে ম্যাপ খুলে হিসেবে কষতে গেলে অপনি ওখানেই শেষ, গণনা আপনি করে উঠতে পারবেন না। যদি ভাবেন কলকাতা আর বুয়েনস্ আয়েরস এই দুই রাজধানীর মাঝে আছে শুধু ফুটবল; একটা হাওয়া ভর্তি চামড়ার গোলক! তাহলেই গণনা শেষ। একেবারে বাজিমাত। দুটি শহর ফুটবলে পাগল। দুটি শহর ভালবাসে দিয়েগোকে।
বাঙালির আবেগের আরেকনাম ফুটবল।
সেই চর্ম গোলক ফুটবল! স্বপ্নাবিষ্ট বাঙালির পকেট গড়ের মাঠ আর সেই মাঠেই আবেগ আনন্দের ভাগিদার ফুটবল। "গোওওওল...." এই চিৎকার শুধু চিৎকার নয় বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শত কষ্টের এক উচ্ছ্বল আবেগ।
চার বছর অন্তর হওয়া ফুটবলের উৎসব "ফিফা বিশ্বকাপ" চলাকালীন বাঙালি ভাগ হয়ে যায় তাদের প্রিয় ক্লাব মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গলকে কিছু দিন বিরতি দিয়ে। কেউ তখন ব্রাজিল; কেউবা আর্জেন্টিনা।
আসলে আমরা যারা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ তাদের কাছে ফুটবল শুধু একটা খেলা নয় ফুটবল একটা বিশাল প্রাপ্তি; ফুটবল সাময়িক চিন্তার বিরতি। সেই উন্নয়নের প্রশ্নে অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে কোথায় যেন আর্জেন্টিনার মানুষের সাথে বাঙালির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তারাও গোটা বিশ্বের সাথে অবাক বিষ্ময়ে হাঁ হয়ে দেখে ছিয়াশির সেই গোল যা কিনা "হ্যান্ড অফ গড"। অথচ ফুটবল পায়ের খেলা। কিন্তু ঈশ্বরের হাতের গোল আর সেই গোলের নায়ক ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা বিতর্ক যার সবসময়ের সাথী।
সবুজ ময়দান দাপিয়ে বেরিয়েছেন, লালকার্ড, হলুদকার্ড কত দেখছেন, মেজাজ হারিয়েছেন রাজপুত্র। কিন্তু রেফারি কখন যেন খেলা শেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। গ্যালারি একেবারে শান্ত। পিন পড়লে শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সবাই গুণছেন এক, দুই,তিন....
"দিয়েগো" "দিয়েগো" "দিয়েগো" আওয়াজ উঠছে কিন্তু না ফুটবল গালিচা শান্ত একটু বেশীই শান্ত। দিয়েগো আজ শান্ত, চিরশান্তিতে শুয়ে আছেন কোনো মেজাজ হারানো নেই, কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো বিতর্ক নেই।
খেলা শেষ, রেফারি জানিয়ে দিয়েছেন কোনো এক্সট্রা টাইম নেই। ট্রাইবেকার নেই।
দিয়েগো মারাদোনা সারা বিশ্বে ফুটবল ময়দানের মাঝমাঠে ড্রিবলিং করতে করতে চলে গেলেন। বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র বহু খ্যাতি বহু অখ্যাতির পালক নিজের মাথায় নিয়ে নিজস্ব "দিয়েগোচিত" মেজাজেই যেন ফুটবল মাঠ থেকে বিদায় নিলেন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। ৬০ বছর বয়সেই শেষ হয়ে গেল ফুটবল কিংবদন্তির অধ্যায়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রস্থান নিলেন এল পিবে দে অরো (সোনালি বালক) ২৫শে নভেম্বর ২০২০। ৬৭৯ ম্যাচে ৩৪৬ গোল করা রাজপুত্রর ঘামে যে ময়দান ভিজে থাকত আজ চোখের জলে ভিজে গেল সেই ফুটবল ময়দান।
সেই পঁচিশে নভেম্বর! ফুটবল ময়দান শাসন করা মানুষটি যখন মাদকের নেশায় বুঁদ কেউ পাশে নেই তখন ছিলেন কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। না না প্রসিডেন্ট হিসেবে নয়। একেবারেই বন্ধু হিসেবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিয়েগোর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল কম্যুনিষ্ট কাস্ত্রোর। একেবারেই নিখাদ এই বন্ধুত্ব। রাজপুত্র নিজেকে কম্যুনিষ্ট বলতেন না। বলতেন ফিদেলিস্তা। তাঁর হাতে ছিল চে গুয়েভারার উল্কি আবার পায়ে ছিল কাস্ত্রোর উল্কি। এই পঁচিশে নভেম্বর ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুদিন। কি আশ্চর্য সমাপতন না!
এই দিনটি যেন রাজনীতির ময়দান ফুটবল ময়দান এক হয়ে গেল। জীবনের ওপারে দুই বন্ধু কি হাভানা চুরুট সেবন করতে করতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গল্পে মেতে উঠবেন? না কি ভাবি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বার্ডেন ভেবে খোশ গল্পে মেতে উঠবেন?
ফুটবলের মক্কা কলকাতায় তখন কমিউনিস্ট শাসন, রাজপুত্র কলকাতায় এলেন মানুষের মন জয় করলেন।
সে সময় তিনি সাক্ষাত করেছিলেন সেই সময়ের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী শ্রীজ্যোতি বসুর সাথে। কলকাতার মানুষকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দিয়েগো বলেছিলেন কলকাতার মানুষের স্থান তাঁর হৃদয়ে। এসব তার সমাজতন্ত্রিক মনভাবের প্রতিফলন। কলকাতাবাসীরাও কিন্তু চোখের জলে বলছেন "তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব; ছেড়ে দেব না.."
গোটা ফুটবল বিশ্ব আজ শোকে মূহ্যমান। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মারাদোনার মৃত্যু প্রসঙ্গে ব্রাজিলের লেজেন্ড ফুটবলার পেলে বলছেন ‘আকাশের উপরে আমরা দু’জন অবশ্যই একদিন ফুটবলে শট নেব।"
সব তর্কবিতর্ককে ছুটি দিয়ে ফুটবলের সোনার ছেলের প্রস্থান। বিদায় মারাদোনা!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours