প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:

পঞ্চানন ঠাকুর বাংলার এক খ্যাতিমান লৌকিক দেবতা। লোকবিশ্বাসে ইনি মহাদেব শিব তবে অন্যমতে, ইনি শিবের পুত্র। গ্রামবাংলায় পঞ্চানন ঠাকুর গ্রামের রক্ষা কর্তা, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন ঠাকুর পূজিত হন। নিঃসন্তান ব্যক্তিরাও সন্তান কামনায় এনার পূজা করেন। রক্তবর্ণ পঞ্চাননের মুণ্ড-মূর্তি ও ঘট প্রতীক পূজিত হয়। ভক্তবৃন্দ পঞ্চানন ঠাকুরকে মাটির ঘোড়া, সিন্নি প্রদান করেন মনস্কামনা পূরণের জন্য। 

রাঢ়-বঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া-হুগলী-কলকাতা, বর্ধমান, নদিয়া ও বাঁকুড়াতে এই দেবতার পূজার রেওয়াজ আছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার স্থানবিশেষে ইনি 'বাবাঠাকুর' নামেও পরিচিত। মধ্যযুগীয় বেশকিছু মঙ্গলকাব্য-এর পুঁথিতে পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ পাওয়া যায় দ্বিজ দুর্গারাম রচিত পঞ্চাননমঙ্গল গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, -

          "পঞ্চমুখে গান কর ত্রিলোচন।"

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে বর্ণিত  আছে,

         "কামারহাটে পঞ্চানন্দ বন্দে জোড় হাতে।

         ছেলেদের জন্য কত মেয়ে ওষুধ যায় খেতে।"

মূলত গ্রামের শেষ প্রান্তে অশ্লথ, বট ও কয়েত বেল তলায় ঘন জঙ্গল পরিবেষ্টিত জায়গায় পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার রেওয়াজ আছে। সাধারণত কোন মন্দির তৈরি করে পঞ্চানন ঠাকুরের পূজার প্রচলন নেই। তবে বর্তমানে কোন কোন গ্রামে পঞ্চানন তলায় মন্দির করেও পূজার প্রচলন শুরু হয়েছে। গ্রামবাসীদের কাছে পঞ্চানন ঠাকুর  অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা। গ্রামবাংলায় নতুন শস্য ওঠার পর সেই শস্য উৎসর্গ করে এই দেবতার নিকট পূজা দেওয়া হয়। 

মহাদেব শিবের সঙ্গে কল্পিত পঞ্চানন ঠাকুরের দেহাকৃতি ও বেশভূষার সাদৃশ্য আছে, তবে উভয়ের রূপকল্পনায় পার্থক্যও বিদ্যমান। পঞ্চাননের গাত্রবর্ণ লাল এবং চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী। বেশ বড় গোলাকার ও রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক, দাড়ি নেই, গোঁফ কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং তার মধ্যে জটা কিছু বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতুরা ফুল। উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গ বাঘছাল পরিহিত, আবার স্থানবিশেষে কাপড় পরানো রূপের কল্পনা করা হয়েছে। তবে গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু; পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। এনার অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামক দুজন অপদেবতা। এঁর সঙ্গে থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি।

গ্রামদেবতা রূপে মন্দির মধ্যে কিংবা গাছতলায় শনি ও মঙ্গলবারে ইনি পূজিত হন। কোথাও মাটির মূর্তিতে, কোথাও শিলা বা ঘটের প্রতীকে। শিশুদের ধনুষ্টংকার এবং গর্ভস্থ শিশু রক্ষা করা বা নষ্ট ভ্রূণ থেকে প্রসূতিকে রক্ষা করা পঞ্চাননের কাজ। তার উদ্দেশ্যে ছাগবলির প্রচলন আছে কোন কোন জায়গায়। অনেকের ধারণা রাঢ়-বাংলার মুখ্য লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমে ক্রমে পঞ্চানন ঠাকুর রূপে পূজিত হওয়া শুরু হয়েছে। বছরের নির্দিষ্ট দিনে গ্রামবাংলায় পঞ্চানন ঠাকুরের পূজা হয়। এই উপলক্ষে গ্রামের সব মানুষ উপস্থিত হয় পঞ্চানন তলায়। কোন কোন গ্রামে এই উপলক্ষে মেলা ও মাঠ ফলারও হয়। 

হালকা হালকা শীতের মেজাজ। এই মাসের প্রথম সপ্তাহে এমনই একদিন পৌছেছিলাম পূর্ব বর্ধমানের বিজুর গ্রামের পঞ্চানন তলায়। দিগন্ত বিস্তৃত চাষ জমির আল দিয়ে হেঁটে পৌঁছালাম।  স্থানীয় একজন কৃষক তখন জমিতে কাজ করছিলেন। তিনি বললেন "আমাদের পঞ্চানন ঠাকুর ভীষণ জাগ্রত। সন্ধ্যার পর এখানে কেউ আসেন না। প্রতি বছর চৈত্র মাসের অমাবস্যায় পঞ্চানন ঠাকুরের পূজা হয়। পূজা উপলক্ষে পাঁঠা বলি ও একটি মেলা হয়।"

(www.theoffnews.com - God)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours