সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:
আমার ছাত্রী কৌশিকীর মন খারাপ খুব।এতটাই খারাপ সে পড়াশোনায় মন দিতেই পারছে না। e-ক্লাসরুম ওর কাছে একেবারেই অসহ্য। একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম "কি হয়েছে তোর?
ওর উত্তর টা জানার আগে বলি যেএখন eEducation eTeaching e Learning খুব চেনা শব্দ। করোনা আবহে এই eমার্কা শিক্ষা ব্যবস্থার বাজারে কাটতি এখন খুব ঐ আগমার্কা জিনিস পত্রের মতো। করোনা আবহে যখন চারিদিকে দিশেহারা অবস্থা তখন এই eTeaching /eLearning নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করল।
এই কিছু বছর আগেও একটা generation স্কুল কে ইস্কুল বলত। বলা উচিত ইসকুল বলবে বলেই বলত কখনো স্কুল তারা বলত না। অনেকে এখন ভালবেসেই ইস্কুল উচ্চারণ করেন। অঞ্জন দত্তের গানটা"...চশমাটা পড়ে গেলে মুশকিলে পড়ি, দাদা আমি এখনো যে ইস্কুলে পড়ি।"
কিন্তু কি আশ্চর্য সমাপতন ছাত্রছাত্রীরা এখন eস্কুলেই পড়ে আমরা পড়াই।
এই যে একটা ভার্চুয়াল দুনিয়া আগে যান্ত্রিক দুনিয়া কথাটা বলতাম বা যান্ত্রিক জীবন। কিন্তু এখন ভার্চুয়াল জগত। এই ভার্চুয়াল জগত কতটা গ্রহণযোগ্য এইটাই প্রশ্ন? ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ভার্চুয়াল মিটিং, ভার্চুয়াল অফিস তবু চলতে পারে কিন্তু ভার্চুয়াল টিচিং /লার্নিংয়ের মাধ্যমে কি প্রকৃত পাঠদান হয় বিশেষ করে যারা স্কুলপড়ুয়া। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণত পড়ুয়াদের কথা বলছি না।
প্রতিদিন আমি সকালে ল্যাপটপে পাঠদান শুরু করি। নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো online য়ে ঝুলে আছে। কেউ ঝোলার চেষ্টা করছে (trying to be connected) কেউ ঝুলতে পারেনি (for network issue) আবার কেউ ঝুলতে গিয়ে ছিটকে গেছে (disconnected ).
তারপর যারা সৌভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে ঝুলে আছে তাদের কেউ কেউ দেখি শুয়ে ক্লাস করছে, কেউ প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো কোনো বাচ্চা ডিগবাজি খেয়ে নিল। কারোর ফোন খোলা কিন্তু সে ফোনের চার পাশে নেই। কেউ কেউ এটা সেটা নিয়ে খেলছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সরলমতি বাচ্চারা বাড়ির পরিবেশে বসে আছে। সেখানে ক্লাসরুম অনুভূতি আসতে পারে না। প্রতিদিন এইভাবে পড়া পড়া খেলা হচ্ছে।
আবার গ্রামের বাচ্চাদের কথা ভাবুন তাদের তো স্মার্টফোন নেই ল্যাপটপ তো দূরহস্ত। খবরের কাগজে পড়ি এমন গ্রামও আছে যেখানে এখনো বিদ্যুৎ নেই। সেখানে ফোনের চার্জ দিতে সাঁতরে অন্য গ্রামে যেতে হয়। এটাই আমাদের চেনা চিত্র অথচ আমরা নাকি ডিজিট্যাল হচ্ছি। সেই বিজ্ঞাপনটার কথা মনে হয় "দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি"জোর করে বলতে হবে "Digital India"।
আবার কারোর কাছে নেট মানে সত্যিকারের জাল যা দিয়ে তারা মাছ ধরে। জীবিকার জন্য তারা সেই "জালে"আটকে। পেটের তাগিদে সেই জাল থেকে বেরিয়ে অর্ন্তজালে ঢোকার চেষ্টা করবে কি করে।
প্রাক করোনাকাল কে এখন সেকাল (অতীত কাল) আর উত্তর করোনা কালকে ভবিষ্যৎ কাল বলি, তাহলে করোনাকালকে একাল (বর্তমান কাল) বলতে হয়। আর এখানেই দ্বন্দ্ব শুরু মানে শিক্ষার সেকাল আর একাল নিয়ে।
সেকালে ছাত্ররা পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করত। আর একালে পরীক্ষা না দিয়েও ফুলমার্কস পাওয়া যায়। (সরল ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে কেউ দেখবেন না) ফুলমার্কস পাওয়াটা কিন্তু একরকম বঞ্চনা। প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ার একটা উপশমকারী মলম হল ফুলমার্কস।
একজন শিক্ষিকা হয়ে বলতে পারি ভার্চুয়াল ক্লাস করে কেউ কেউ ভাবল "দুনিয়া মুঠোর মধ্যে"। ভার্চুয়াল দুনিয়াটা কারোর কারোর কাছে ভিনগ্রহের অচিন দুনিয়া হয়েই রয়ে গেল। ওদের কাছে স্কুলটা ইস্কুল হয়েই রইল "eস্কুল" আর হল কই?
আর্থসামাজিক ব্যবধান সবসময় ছিল কিন্তু করোনা আবহে এই ব্যাপারটা আরও প্রকট হল। শিক্ষা ব্যবস্থাটা এখন শুধু করোনা না অনেক দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত।
উত্তরকরোনা শিক্ষাবর্ষের অপেক্ষায় রইলাম।
ওহ্যাঁ, আপনারা কৌশিকী কি বলেছিল তা ভাবছেন তো! সে বলেছিল "ম্যাম eক্লাসে সবাই আছে অথচ কেউ নেই। একসাথে টিফিন খাওয়া নেই, খেলা নেই, আড়িভাব নেই, পেন পেনসিল নিয়ে ঝগড়া নেই। আর নাকি ম্যামের গায়ের গন্ধ নেই।"
আমি নিরুত্তর ছিলাম নিরুপায় বলে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours