সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলার লোক সঙ্গীত জগতের এক অপার উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন আব্বাসুদ্দীন আহমদ। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসুদ্দীন। অতিসম্প্রতি তার ১২০তম জন্মদিবস পালিত হল। অবিভক্ত ভারতে বতর্মান কোচবিহারের তুফানগঞ্জ মহকুমায় কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আব্বাসুদ্দীন আহমদের জন্মস্থান। ১৯০১ সালের ২৭শে অক্টোবর উত্তরবঙ্গে কোচবিহারের তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

আমাদের উত্তরবঙ্গ! চারিধার মায়াবী সবুজ, নদীর পথচলা কিম্বা আরেকটু উত্তরে গিয়ে পাহাড় ঘেরা সুন্দরী উত্তরবঙ্গ। প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে আপন মাধুর্যে সাজিয়েছে উত্তরবঙ্গকে। আর তার ছোঁয়া পড়েছে শিল্পসংস্কৃতিতে। এখানের আকাশে বাতাসে যেন সুরের মিশেল, মাটিও যেন সহজ মানুষের সরল মনের কথাগুলি পড়তে পারে। মাটিও যেন কথা বলে ফিসফিসিয়ে...মাটি যেন গান গায় হৃদয় ছেঁড়া গান, সুখ দুঃখের গান অনুভূতির গান,  ভাবের গান এক কথায় ভাওয়াইয়া গান যা উত্তরবঙ্গের অন‍্যতম অভিজ্ঞান।

আর এই মাটিময় গানকে বিশ্বের দরবারে আনলেন আব্বাসুদ্দীন। মেঠো সুরের সুবাস ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বময়। 

একজন আইনজীবী পিতা হিসেবে জাফর আলি আহমদ আব্বাসকে চেয়েছিলেন আইনজীবী হিসেবে দেখতে। কিন্তু শৈশব থেকেই গানে গানে তানে তানে সুরে সুরে পথ চলতেন আব্বাসুদ্দিন আহমদ। প্রচন্ড একটা টান ছিল তাঁর গানের প্রতি। সুরের প্রতি এক নিবিড় সম্পর্ক। 

গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে, স্কুল যাতায়াতের পথে উত্তরবঙ্গের খরস্রোতা নদীর সুর ও ছন্দ, লোকজীবনের জীবনধারার এক গীতিময় জগৎ রূপকথার রঙিন দুনিয়ার মত বাধা পড়ত আব্বাসুদ্দীনের মনে। গাছগাছালি আর অরণ্যভূমি তাঁকে যেন হাতছানি শস্য শ্যামলা কৃষিভূমি আর কৃষকদের গান তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। ছোট্ট আব্বাসুদ্দীন গুনগুন করে উঠতেন তাদের সুরে। আর এই সুরই হল ভাওয়াইয়া সুর মানে ভাবের সুর। যদিও এই নিয়ে অনেক তত্ত্ব প্রচলিত আছে।  

এইভাবেই গ্রামে সবার প্রিয়, শিক্ষকদের প্রিয় আব্বাসুদ্দীনের মধ‍্যে লুকিয়ে ছিল শিল্পী হওয়ার চারাগাছটা। কিন্তু কারোর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার তালিম উনি পাননি। গান শিখেছিলেন পালাগান, ক্ষেত মজুর কৃষকদের মুখের গান শুনে। মাঝিভাইদের নৌকাবাইতে বাইতে তাদের গাওয়া গান... বালক আব্বাসুদ্দীন স্কুল যাতায়াতের পথে মেঠোপথ ধরে আসতে আসতে সোনালী রোদে গা ভিজিয়ে অথবা মেঘলা দিনে টিপটিপ বৃষ্টির ভেতর গলা ছেড়ে ভাওয়াইয়া গাইতে গাইতে পথ চলতেন। মাটির গানে সাক্ষী থাকত আকাশ বাতাস মাটি আর উত্তরবঙ্গের নদনদী। এইভাবে আব্বাসুদ্দীন হয়ে ওঠেন  ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসুদ্দিন।। তার লেখা একখানি গান--  

"তোর্ষা নদীর ধারে ধারে, ও

দিদি লো মানসাই নদীর ধারে 

ওকি সোনারবধুঁ গান করি যায়..."

আব্বাসুদ্দীন তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং পরে কোচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর সংগীত চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। 

এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় কাজী নজরুল ইসলাম, ইন্দুবালা, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, আঙ্গুরবালা সহ অসংখ্য শিল্পীর সাথে। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় বেশ কিছু ঠুুংরী, গজল রচনা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’’ গানটি আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়ে ছিল।  

আব্বাসুদ্দীনই প্রথম ভাওয়াইয়াকে রেকর্ড করে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তার প্রথম রেকর্ডকৃত গান হল -‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে...’ এবং ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে...’। 

তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ বইতে লেখেন- “খরস্রোতা ছোট্ট পাহাড়ি নদী তোরষা - কুচবিহারের পাদমূল ধৌত করে তরতর বেগে চলেছে। তারি তীরে তীরে গান গেয়ে চলেছে মোষের পিঠে করে দোতারা বাজিয়ে মোষ-চালক মৈষালের দল। তাদের কণ্ঠের সুর ছেলেবেলায় আমার কণ্ঠে বেঁধেছিল বাসা। তাদের মুখের ভাষাই আমার মাতৃভাষা।"

আব্বাসুদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পযর্ন্ত কলকাতায় থাকতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের দিনই ভারতের কোলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন।

ঢাকায় স্থায়ী হয়েই তিনি এ দেশের মানুষকে গানের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে সংগীত চর্চা কেন্দ্র খোলার ব্যবস্থা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক সমাবেশ সহ নানা অনুষ্ঠানে ভাওয়াইয়াকে পৌঁছে দিয়েছেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসুদ্দীন।

সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। এছাড়াও আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় তাঁকে বিভিন্ন সময় ভূষিত করা হয়।

১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর বুধবার সকাল ৭ টা ২০ মিনিটে মাটির পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে জীবন নদী র ওপারে চলে গেলেন মাটির পুত্র  আবাস উদ্দীন আহমেদ।  তখন  কোনো এক গাঁয়ের মাঝি হয়তো নৌকা বাইতে বাইতে গাইছে

"শালি ধানের শ্যামলা বনে হইলদা পঙ্খি ডাকে

চিকমিকাইয়া হাসে রে চান সইশা ক্ষেতের ফাকে

ফাকে সইশা ক্ষতের ফাকে

সোনালি রূপালি রঙে রাঙা হইলো নদী (আরে)।

মিতালী পাতাইতাম মুই মনের মিতা পাইতাম যদি রে..."

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours