সুরঞ্জন কর, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

রাত আটটা নাগাদ গগনের sms টা পেয়ে অতনু প্রথমে একটু চমকেই উঠেছিল, 'আমি এখন গিরিডি আর উশ্রীর  মাঝে'…I বলে কি? কাল অবদি কথা হয়েছে, কৈ একবারও তো বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেনি? এটা কেমন হলো? পরমূহুর্তেই অতনু বুঝতে পেরেছে এটা গগনের রসিকতাI নিশ্চই গ্লাস বোতল নিয়ে বসেছে, নেশার ঘোরে উল্টোপাল্টা লিখছেI অতনু প্রমাদ গুনলো, সবে সন্ধে, যত রাত বাড়বে, নেশার সাথে সাথে smsও বাড়বেI মুশকিল হলো গগনটা একেবারে ছোটবেলার বন্ধু, শরীর খারাপ, সারাদিন প্রায় বাড়িতেই থাকে, হাবিজাবি গল্প লিখে সময় কাটায়I কোন কুক্ষণে যে একবার লেখার প্রশংসা করে ফেলেছিলো, সেই হয়েছে কাল, এখন ওর লেখা সমস্ত গল্প অন্তত ভদ্রতার খাতিরে হলেও পড়তে হয়I তবে এইটুকু ছাড়া গগনের আর কোনো উৎপাত নেই, নিরীহ স্বভাব, নিজের মনেই থাকে ওর কল্পনার জগৎ নিয়েI   

অতনু পাল্টা sms করে 'ক পেগ হয়েছে রে? ভুলভাল বকছিস?'

'কি করি বল, সত্যি খুব মনে পড়ছিলো আমাদের উশ্রী যাওয়ার কথা। সেই টাঙ্গা চড়া...মনে আছে?'

'একবার ঘুরে এলেই পারিস? এখন তো যাতায়াতের ব্যবস্থা অনেক ভালো, আমরা গেছিলাম সেই কোন যুগে, তখনকার সাথে কোনো মিল পাবি না, সাহস করে একবার বেরিয়ে পর, তোর লেখার পক্ষেও ভালো হবে, নতুন প্লটও হয়তো পেয়ে যেতে পারিস'I 

গগন আর কথা বাড়ায় নাI বাকি চার বন্ধুকেও ওই একই sms করে, কি আশ্চর্য! সবারই একই উত্তর...'ক পেগ হলো রে?' সবাই যেন ধরেই নিয়েছে ও বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই পারবে নাI অবশ্য ওদের দোষও দেওয়া যায় না, আজ প্রায় পনেরো বছর কলকাতার বাইরে পা রাখেনি, বাড়ি, অফিস আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই বন্ধুদের বাড়িতে মাঝে মধ্যে আড্ডা...এই করেই দিব্বি কাটিয়ে দিলো এতগুলো বছরI   

গগনের নিজেরই প্রথম দিকে খারাপ লাগতো, এখন কেমন যেন সয়ে গেছেI দু এক বার যে  বেরোনোর কথা ভাবেনি তাও না, পাঁচজনের কাছে গল্প শুনে, কাছেপিঠে বেড়াতে যাওয়া প্রায় ঠিকও করে ফেলেছিলো, কিন্তু যত বেরোনোর দিন কাছে এসেছে ততই যেন ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছে, ধরেই নিয়েছে বেড়ানোর শারীরিক ধকল ও আর নিতে পারবে নাI এখন আর এই নিয়ে ভাবে না, বই পড়ে, গান শুনে, গল্প লিখে দিব্বি সময় কেটে যায়I 

গল্প লিখতে বসেও প্রথম দিকে সমস্যায় পড়েছিল, সব গল্পের পটভূমি এক...হয় সেই দার্জিলিঙের পাহাড় আর না হলে মেদিনীপুর,  দুর্গাপুর, ডায়মন্ড হারবার...মানে যেটুকু নিজে দেখেছে কোনো এক সময়I নিজেরই এক সময় একঘেয়ে লাগছিলো, তারপর ভেবে দেখলো ও যা লেখে সে তো একান্তই নিজের আনন্দে, যে জায়গা ও জীবনেও দেখেনি, দেখবেও না হয়তো...মন্দ কি সে সব জায়গা নিয়ে গল্প লিখলে ?  

কিছুদিন আগে উশ্রীর ছবি দেখছিলো গগনI ওর ছোটবেলার দেখা সেই ঝর্ণার সাথে তেমন মিল পেলো না, সত্যি বলতে কি এতো বছর আগের স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে এসেছে। ছবির তলায় নামটা দেখে মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু খুব বেশি এগোতে পারলো নাI ওর খালি মনে আছে বড়ো বড়ো পাথরের আশপাশ দিয়ে অবিরাম জলের ধারা নেমে আসছিলোI ছবিটা দেখার পর থেকেই কল্পনায় বারে বারে ওখানে ফিরে যেতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কোথায় যেন আটকাচ্ছে...সেটা কি আবছা স্মৃতি আর কল্পনার বিরোধ? কে জানে...হবেও বাI 

গগন ঠিক করেই ফেলেছে এবারের গল্পটা ও উশ্রীর পটভূমিতেই লিখবেI যে টাঙাওয়ালা ছোকরা ওদের নিয়ে গেছিলো, কি যেন নাম ছিল? কে জানে, সেই কোন যুগের কথা..I তা ওরও তো এখন ভালোই বয়েস হয়েছে, নাম...ধরা যাক আফজল মিয়াঁ...ওকে নিয়ে একটা গল্প ফাঁদলে কেমন হয়? এই যেমন…অটো আর ট্যাক্সির দাপটে আজকাল টাঙ্গা আর কেউ চড়ে না, আফজল মিয়াঁ তাও রোজ আসে, স্টেশনের বাইরে সারাদিন অপেক্ষা করে, কোনো কোনো দিন ভাড়া জোটে, কখনো জোটে না...আফজল তবু প্রাণে ধরে টাঙ্গা বিক্রি করতে পারে না...I নাঃ, এ বড্ডো চেনা ছক...অন্য কিছু ভাবতে হবে...একটু আলাদা...অন্যরকম...I আচ্ছা এমন কি হতে পারে? আফজল মিয়াঁ আজ ভাড়া পেয়েছে, যাত্রী নিয়ে উশ্রীর পথে চলেছে...হঠাৎ ঘোড়াটা মুখ থুবড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়লো...একটা গেলো গেলো রব চারদিকে...ঘোড়াটার মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠছে...অসহায় আফজল দেখছে চোখের সামনে ওর এতদিনের পুরোনো সঙ্গীর চলে যাওয়া...ধুস, কিচ্ছু হচ্ছে না, দূর দূর...এই সব টাঙাওয়ালার গল্প থাক, অন্য কিছু ভাবা যাক...আচ্ছা রাস্তাটা যেখানে বাঁয়ে একটু বাঁক নিয়েছে, ওই খান থেকে যে মেঠো পথ দূরে গ্রামের দিকে চলে গেছে...ওই রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে কেমন হয়? গাড়ি যদিও মুহুর্তের মধ্যেই বাঁক পেরিয়ে গগনকে নিয়ে উশ্রীর রাস্তা ধরলো, অন্য গগন তখন মনে মনে গ্রামের পথ ধরে হেঁটে চলেছেI বাঁশবনের কাছে গিয়ে শুনতে পেলো একটা অদ্ভুত আওয়াজ, ঠিক যেন কারো দীর্ঘশ্বাস ফেলার আওয়াজ...এগিয়ে দেখতে যাবে...পথ আটকে দাঁড়ালো এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী,' মত্ যাইয়ে উধার বাবুজি...খতরা হায়'। কিন্তু গগনকে যে যেতেই হবে...ও অন্ধকারে পা বাড়ায়...এরপর? এরপর কি? চিন্তাগুলো দানা বাঁধছে না কেন? পরে শান্তিতে বসে ভাবতে হবে...I

ফোন এ অনবরত বন্ধুদের sms এসেই চলেছে...' কি রে কত পেগ হলো? কল্পনায় উশ্রী দেখা হলো?...রাতে আর কি দেখবি? সকালে যাস...চুপ করে গেলি যে একদম...আর রাত করিস না...শুয়ে পর...' I গগন ফোনটা বন্ধ করে দেয়, ওটা আপাতত বন্ধই থাকI গাড়ির অন্ধকারে টাইপ করতে অসুবিধাও হচ্ছে আর ফোনের দিকে মন দিতে গিয়ে বাইরেটাও আর দেখা হয়ে উঠছেনাI ও যে সত্যি সত্যি আজ সকালের ট্রেন ধরে গিরিডি এসেছে তা না হয় নাই মানলো বন্ধুরাI তার চেয়ে বরং এই যাত্রাটুকুই উপভোগ করা যাকI 

এখন শুক্লপক্ষ, চাঁদের আলোয় সাদা হয়ে আছে পথের দুদিকI গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পিচের রাস্তাটা একটা কালো ফিতের মতো মনে হচ্ছে, দু পাশে ধু ধু মাঠ, দূরে কোথাও কোথাও একটা দুটো আলো টিমটিম করে জ্বলছে। এক এই গাড়ির ইঞ্জিনের একটানা গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ ছাড়া চরাচর জুড়ে অবাক নিস্তব্ধতাI গগনের ভারী আনন্দ, ও কল্পনায় কতবার এমন গাড়ি চড়ে চাঁদনী রাতে এমন শুনশান পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে...কল্পনা আর বাস্তবের এতো মিল গগন ভাবতেই পারেনিI  

উশ্রী ফলসে যখন পৌঁছালো তখন চারিদিক জনশূন্য, চাঁদের আলোয় উশ্রীর এ এক অপূর্ব রূপ...সাদা জলের অবিরাম ধারা পাথর ভিজিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে নেমে আসছে...ভেজা পাথরগুলো চাঁদের আলোতে ঝিকমিক করছে...কোথাও কোনো আওয়াজ নেই...শুধু জলপ্রপাতের ঝরঝর কলকল শব্দ...গগন একটা পাথরের ওপর চুপ করে বসে  বসে দেখছে...এই অবিরাম জলস্রোত যেন ওর জীবনের এতো বছরের অবরুদ্ধ আবেগেরই প্রতীক...আজ ছাড়া পেয়েছে এতদিন বন্দি থাকার পর... মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় চোখে মুখে এসে পড়ছে জলের ছিঁটে...ও যেন কোথায় হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। 

ড্রাইভারের কথায় ঘোর কাটলো, 'চালিয়ে সাব, বহত দের হো চুকা'I 

গগন পাথর বেয়ে সাবধানে নেমে এলো, এবার ফেরার পালাI আজ বাদে কাল আবার শুরু হবে আগের জীবন। সেই অফিস, বাড়ি...আবার সেই চার দেওয়ালের মধ্যে বদ্ধ জীবন। একটাই ভরসা...গান থাকবে, ভালো বই থাকবে, বন্ধুরা থাকবে...আর থাকবে এক আকাশ কল্পনা...I

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours