প্রত্যেক মানুষই তাঁর স্বভাবগত নিজের পছন্দের কাজটিই করতে চায়। সেই কাজে সে যে সফল হবেই তার কোন নিশ্চয়তা নেই জেনেও সে সেই কাজটিই করতে চায় । তাই অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করেও মানুষকে দেখি পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দুর্গমতাকে জয় করতে । পর্বতারোহী পাহাড়ের চূঁড়ায় ওঠার লক্ষে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে ও তারজন্য কঠিন কসরৎ করে। সমুদ্রে বিভিন্ন ভয়ঙ্কর মাংসাশী প্রাণী আছে জেনেও সাঁতার কাটে মানুষ।
আর সেই পছন্দে বাধাপ্রাপ্ত হলে মানুষ ভাবে তার এ জীবন বৃথা হয়েছে। এ সমাজে তাঁর আর কোন মূল্য নেই। আর এই জায়গা থেকেই জন্ম নেয় ডিপ্রেশন। যদিও এটি একটি কারণ মাত্র। ডিপ্রেশনের অন্যান্য অনেক কারণ ও আছে। ডিপ্রেশনের মত ভয়ঙ্কর ব্যাধি বোধহয় মনুষ্য জীবনে আর কিছুই নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী ৭.৫% ভারতীয় কোন না কোন কারনে ডিপ্রেশনের শিকার। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৫ কোটি ভারতীয় আজ এই অসুখে আক্রান্ত।
উপরের কারণটি ছাড়াও ডিপ্রেশন, আরো কয়েকটি কারণে আসতে পারে। তবে অন্যতম কারণগুলির মধ্যে প্রধান কারণ হলো জেনেটিক । অর্থাৎ পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিজনের মধ্যে এ সমস্যা থাকলে এ রোগ হতে পারে।এছাড়াও মস্তিস্কের সেরাটোনিন ও নরএড্রানালিন এর ঘাটতি এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধিকে ডিপ্রেশন সৃষ্টির রাসায়নিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
তবে ডিপ্রেশনের অন্যতম আর একটি প্রধান কারণ হলো ব্যক্তির "ব্যক্তিত্ব"। উদ্বেগপ্রবণ, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তি, অল্পকিছুকে বড় করে দেখা ব্যক্তি , নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়া এমন স্বভাবের ব্যক্তিদের মনে ডিপ্রেশন আসার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। এই কারনে জীবনের কোন না কোন সময়ে লক্ষণীয় প্রত্যেক মানুষই একবার অন্তত ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়েন।স্নেহবঞ্চিত ও অবহেলাজনিত কারণেও ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়েন পূর্ণবয়স্ক মানুষ এমনকি শিশুও।
এছাড়াও অন্যান্য অনেক কারনেও ডিপ্রেশন আসতে পারে।
ডিপ্রেশনের প্রধান লক্ষণ বিষন্ন মন, আগ্রহহীনতা, আনন্দহীনতা । তবে এর সঙ্গে, অপরাধবোধ, নৈরাশ্যবাদ, আত্মঘাতী চিন্তা, আত্মসম্মানবোধের অভাব, অরুচী, অনিদ্রা, ক্লান্তি, ওজনে পরিবর্তন, কাজে ধীরগতি ইত্যাদি। মনে অশান্তি, অযথা মনঃকষ্ট, দুশ্চিন্তাবোধ ও মন খালি খালি লাগা, নেতিবাচক মনোভাব, সবকিছুতে হতাশা, নিজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই-এমনটি ভাবা। স্মরণশক্তির অভাব, শরীর ও মাথাব্যথা, যৌন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
এই ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে অনেকে অ্যালকোহল পান ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তবে এরফলে ডিপ্রেশন বাড়ে বৈ কমে না। আজকাল শিশুরাও ডিপ্রেশনের শিকার হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মন খারাপ থাকা, ক্রমাগত কান্না করা, স্কুলে কোনো সমস্যা হলে যেতে না চাওয়া, বন্ধু বা আত্নীয়পরিজনের থেকে দুরে থাকা, মৃত্যু চিন্তা, অনিদ্রা, পড়াশুনায় অমনোযোগী, রেজাল্ট খারাপ হওয়া, ক্ষুধার ধরণ বদলে যাওয়া, ওজনের পরিবর্তন ইত্যাদি।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো যদি ২ সপ্তাহের অধিককাল স্থায়ী হয় তবে তাকে মেজর ডিপ্রেশন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদের মধ্যে যদি স্বল্প সংখ্যক লক্ষণ উপস্থিত থাকে, তবে তাকে মাইনর ডিপ্রেশন ধরা হয়। এই মাইনর ডিপ্রেশন পরবর্তীতে মেজরে পরিণত হয়। ডিপ্রেশন তুলনামুলক ১৮-৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তি ও মহিলাদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। তবে আত্নহত্যার প্রবণতা পুরুষ ও বয়স্কদের বেলায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ডিপ্রেশন কত বড় সমস্যা। আগামী পৃথিবীতে এই সমস্যা প্রধান সমস্যার রূপ নিতে চলেছে বলা যায়।
তাই ডিপ্রেশন দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোচিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবে এই ব্যাপারে রুগীর পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। রোগীর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে।
রোগীকে উপহাস বা অবহেলা করা যাবে না।
ডিপ্রেশনের কোন লক্ষণ দেখা দিলে তাকে মানবিকভাবে বোঝাতে হবে। তার প্রতি মানবিক ভাব প্রকাশ করতে হবে।
ডিপ্রেশন থেকে রক্ষা পেতে আমাদের উচিত জীবনকে ভালোবাসতে শেখা। জীবনের সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে চলার মানসিকতা গড়ে তোলা। সর্বদা পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহন, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, হাসি, দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন, বেড়ানো ইত্যাদি ডিপ্রেশনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করা, পরিবারে সময় দেওয়া, ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়া, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদি ডিপ্রেশনকে দুরে রাখতে পারে। ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে নিয়মিত প্রাণায়াম ও মেডিটেশন করা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকের জীবনে চড়াই-উতরাই আছে, ঘাত প্রতিঘাত আছেই। এগুলো জীবনেরই একটি অংশ। কোন দুঃখে কাতর না হয়ে আসল বাস্তবতা হিসাবে তাকে চিহ্নিত করে মনে শক্তিধারণ করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দের বাণীগুলিও ডিপ্রেশন নিরোধনে ভালো কাজ করে। তিনি বারবার তাঁর বিভিন্ন ভাষণে মানুষের জীবনদর্শন কেমন হওয়া উচিত সে কথা বলে গেছেন। কুসংস্কারচ্ছন্ন না হয়ে এক মনে ধ্যান করলেও ডিপ্রেশন কমানো যায়। ঈশ্বর বিশ্বাসী বা নিরীশ্বরবাদী উভয়েই এই ধ্যান, যোগ থেকে মনের প্রশান্তি পেতে পারেন। স্বামীজি রচিত এই গানটি মনে সর্বদা স্মরণে রাখলে ডিপ্রেশন অবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
স্বামীজি রচিত গানটি-
মন চলো নিজ নিকেতনে,
মন চলো নিজ নিকেতনে
সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে
ভ্রম কেন অকারণে
মন চলো নিজ নিকেতনে।
বিষয়-পঞ্চক আর ভূতগণ
সব তোর পর কেহ নয় আপন,
পরপ্রেমে কেন হয়ে অচেতন
ভুলিছ আপনজনে
মনো চলো নিজ নিকেতনে।
সত্যপথে মন কর আরোহণ
প্রেমের আলো জ্বালি চল অনুক্ষণ,
সঙ্গেতে সম্বল রাখো পূণ্যধন
গোপনে অতি যতনে।
লোভ-মোহা আদি পথে দস্যুগণ
পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ,
পরম যতনে রাখোরে প্রহরী
শম,দম দুইজনে
মন চলো নিজ নিকেতনে।
সাধুসঙ্গ নামে আছে পান্থধাম
শ্রান্ত হলে তথায় করিবে বিশ্রাম,
পথভ্রান্ত হলে শুধাইবে পথ
সে পান্থনিবাসী জনে।
যদি দেখ পথে ভয়েরই আকার
প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার,
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ
শমণ ডরে যার শাসনে।
মন চলো নিজ নিকেতনে,
মন চলো নিজ নিকেতনে
সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে
ভ্রম কেন অকারণে,
মন চলো নিজ নিকেতনে..
Post A Comment:
0 comments so far,add yours