প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা:

ব্যান্ডেল থেকে রেলপথে  কাটোয়া লোকালে চরে মাত্র দেড় ঘন্টায়  পৌঁছে যাওয়া যায় নদীয়া জেলার এই প্রাচীন জনপদে। নবদ্বীপের নাম শোনেননি এমন মানুষ এদেশে নেই বললেই চলে। নবদ্বীপ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার একটি সুপ্রাচীন শহর । নবদ্বীপ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান ও লীলাক্ষেত্র। বাংলায় সেন রাজাদের আমলে (১১৫৯ - ১২০৬) এই নবদ্বীপ ছিল বাংলার রাজধানী। ১২০২ সালে রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময় বখতিয়ার খলজি নবদ্বীপ জয় করেন ও   বাংলায় মুসলিম সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। নবদ্বীপ ছিল সেই সময় থেকেই বিদ্যালাভের অন্যতম পীঠস্থান। তাই নবদ্বীপকে একসময়  বলা হতো বাংলার অক্সফোর্ড।

এই জনপদ ধন্য হয়েছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, রঘুনন্দন, কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগিস, ধোয়ী, উমাপতি, বিষ্ণুপ্রিয়া, প্রসন্ন চন্দ্র ন্যায়রত্ন ও প্রসন্ন চন্দ্র তর্ক রত্নের মত দিকপালদের জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে। বরাবরই এই শহর শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশের অন্যতম পীঠস্থান। একসময় চৈতন্যের আবির্ভাবের পর কৃষ্ণ ভাবপ্রচারে এই শহর সারা দেশে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। অনেকে এই শহরকে বাংলার বৃন্দাবন বলেন। এই শহরকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মঠ ও মন্দির গড়ে উঠেছে। এই কারনেই দেশবিদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ভিড় করেন এই শহরে। গঙ্গা নদীর ওপর পারে মায়াপুরে ISKCON এর মন্দির এই শহরের আরো এক আকর্ষণ। 

নবদ্বীপের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম দর্শনীয় স্থান  বুড়োশিব মন্দির।  এটি দ্বিশতাধিক কালের  প্রাচীন শিব মন্দির। বাংলার মন্দির স্থাপত্য রীতির নবরত্ন ধারায় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটি দ্বিশতাধিক বর্ষ প্রাচীন হলেও শিব মূর্তিটি আরো বেশি প্রাচীনত্বের স্মৃতি বহন করছে। বুড়োশিবের আদি প্রাচীন মন্দিরটি কৃষ্ণকান্ত শিরোমণি ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তারাপ্রসন্ন চূড়ামণির প্রচেষ্টায় বর্তমান "নবরত্ন' মন্দিরটি নির্মিত হয় ।  নবদ্বীপের জনৈক প্রবীণ নাগরিকের কাছ থেকে জানি মন্দিরের বারান্দা এবং চূড়াগুলির নির্মাণ ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে হলেও গর্ভগৃহটি প্রাচীন, পাতলা টালি ইটের নির্মিত। একসময় এই পোড়ামাতলায় হত শিবের বিয়ে। বাসন্তীপুজোর দশমীর ভোরে বুড়োশিব আর যোগনাথ শিবের জোড়া বিয়ে হত। বিয়েতে স্ত্রী আচার, জলসাধা থেকে কোঁচানো ধুতি পরে বরযাত্রী যাওয়া কিংবা মালাবদল, কোনও কিছুই বাদ যেত না। তারপর চলত ঢালাও ভুরিভোজ।

ভবতারণ শিব মন্দির নবদ্বীপ শহরের দ্বিশতাধিক প্রাচীন একটি শিব মন্দির। নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় এই মন্দিরের পাশেই পোড়ামা কালী মন্দির ও মা ভবতারিণী মন্দির অবস্থিত। ভবতারণ মন্দিরটি বিরলরীতির অষ্টকোনাকৃতি শিখর মন্দির।

নবদ্বীপে গৌরীপট্ট সম্বলিত ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির প্রথম শিব মূর্তিটি ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা রুদ্র রায় স্থাপন করেছিলেন। রাজা রাঘব গণেশ মূর্তি স্থাপনের সঙ্গে একটি শিবলিঙ্গও সেই সময়েই স্থাপন করেন। তখন সেটি রাঘবেশ্বর শিব নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের গঙ্গার ভাঙনে এই মন্দিরসহ মূর্তিটি গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হয়। তার প্রায় ৬৫ বছর পর রাজা গিরিশচন্দ্র ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাতলায় শিব মূর্তিটি ভবতারণ মানে পুন:স্থাপিত করেন, যা বর্তমানে ভবতারণ শিব মানে পরিচিত। নবদ্বীপ বাজারের অভ্যন্তরে এই পোড়া মা তলা ও তথায় বহুপ্রাচীন বটগাছটি দর্শনার্থীদের কাছে বিস্ময়ের। পোড়া মা এই বটগাছটির বহু শিকড়ের তলায় অধিষ্ঠিত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাসুদেব সার্বভৌম নামক এক পণ্ডিত নবদ্বীপ শহরের এক বটবৃক্ষতলে দক্ষিণাকালীর ঘট স্থাপন করেন। কোন এক সময়ে বটগাছটি অগ্নিদগ্ধ হলে এই কালী পোড়ামা নামে জনপ্রিয় হন।

অন্য মতে, বাসুদেব সার্বভৌম এর বহু পূর্বে জনৈক রামভদ্র সিদ্ধান্তবাগীশ (কুসুমাঞ্জলি গ্রন্থের 'রামভদ্রি' টীকাকার) দক্ষিণাকালীর সাধক ছিলেন। গোপাল মন্ত্রে সিদ্ধ অন্য এক পণ্ডিতের সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় বিচার হয়। পরাজিত ব্যক্তি বিজয়ীর মন্ত্রশিষ্য হবেন, উভয়ে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সিদ্ধান্তবাগীশ, পরাজিত হয়ে প্রতিজ্ঞামতো তার ইষ্টমন্ত্র ত্যাগ করতে উদ্যত হলে, ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে তার ইটের বাড়ি ভস্মীভূত হতে থাকে এবং মন্দিরের মধ্যে দেবীর করালমূর্তি তার দর্শনগোচর হয়, দেবীর কোলে গোপাল উপবিষ্ট। মন্ত্রশোধিত জল ছড়িয়ে আগুন নিভলে সাধক নিজে বেঁচে যান এবং তার মন্দিরে দু'খানি মাত্র ইট অবশিষ্ট থাকে। এই ইট দুখানা আজও পোড়া-মার আধার হয়ে রয়েছে এবং তার উপরেই ঘটস্থাপন করে পূজা হয়।

নবদ্বীপে যাবেন আর সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির দর্শন করবেন না এমন হয় না। অসংখ্য মন্দির নবদ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রায় দেড় শতাধিক মন্দির গড়ে উঠেছে নবদ্বীপ শহরে। তার মধ্যে সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির অবশ্যই দেখুন।বছরের আর পাঁচটা দিন তিনি ধামেশ্বর মহাপ্রভু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তবে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী অর্থাৎ জামাইষষ্ঠীর দিনে তিনি মহাপ্রভু মন্দিরের সেবাইতদের কাছে ‘জামাতা’। ঘরের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার স্বামী। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাইয়ের বংশের উত্তরপুরুষেরা বংশ পরম্পরা মহাপ্রভু মন্দিরের সেবা পুজোর অধিকারী। সারা বছর ভোর থেকে রাত ঘড়ির কাঁটা ধরে হয় তাঁর ‘আত্মবৎ’ নিত্যসেবা। তখন তিনি ভক্তের ভগবান। জামাইষষ্ঠীর দিন সেই নিমাই  হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের জামাই। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি রেওয়াজ।  ষষ্ঠীদাস গোস্বামীর আমল থেকে জামাইষষ্ঠী পালন শুরু হয়েছিল মহাপ্রভু মন্দিরে। ষষ্ঠীদাস ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর ভাই মাধবাচার্যের  তৃতীয় পুরুষ। অর্থাৎ প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা।” আর কোথাও মহাপ্রভুকে এ ভাবে সেবা করা হয় না। ওইদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় মঙ্গলারতি হয় কীর্তন সহযোগে। আর পাঁচ দিনের মতোই এই দিনও এই মন্দিরে গাওয়া হয়-

‘‘উঠো উঠো গোরাচাঁদ নিশি পোহাইলো,

 নদিয়ার লোক সবে জাগিয়া উঠিল...’’। 

আমাদের দেশে ভগবানকে  পিতা, মাতা, সন্তান বলে পুজোর রীতি দীর্ঘদিন যাবৎ চালু আছে । তবে জামাই বলে দেবতাকে আপন করে নেওয়ার রীতি নবদ্বীপ ছাড়া অন্য কোথাও বড় একটা দেখা যায় না। 

নিমাইয়ের জন্ম নিয়ে নবদ্বীপে এলে দুটি স্থানের নাম শোনা যায়। কেউ বলেন নিমাই জন্মেছেন প্রাচীন মায়াপুরে । এই প্রাচীন মায়াপুরে নিমাইয়ের জন্মস্থান দর্শনার্থীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের। আজ সে জায়গায় সুন্দর একটি মন্দির গড়ে উঠেছে। এই মন্দির থেকে পায়ে হেঁটে ৫ মিনিটের পথ গেলে শ্রীচৈতন্যের বড় আবক্ষ মুর্তিটিও বেশ সুন্দর। 

তবে, অনেকে মনে করেন নিমাই মায়াপুরে জন্মেছিলেন। নবদ্বীপ থেকে লঞ্চ পেরিয়ে মায়াপুরে গেলে নিমাইয়ের জন্মস্থানে সেই মন্দিরটিও দর্শন করতে পারেন।  ওই মন্দির ISKCON  মন্দিরের পরেই। ISKCON কথাটির বাংলা অর্থ 'আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সঙ্ঘ।' শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ১৯৬৬ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে এই ধর্মীয় সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। একে হরেকৃষ্ণ আন্দোলন (The Harekrishna Movement Organization) ও বলা হয়। ইসকনের উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী বিশেষত ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করা, মানুষকে ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন করা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আধ্যাত্মিকতা ধর্মচর্চা ও ভগবৎতত্ত্ব প্রচার ছাড়াও মানব সমাজের উন্নতিতে যোগ, শিক্ষা ও নানান জনসেবা মূলক কাজকর্ম ইসকন করে থাকে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব আজ থেকে প্রায় ৫৫০বছর আগে তার ভক্তবৃন্দদের প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে কৃষ্ণনাম প্রচার করার কথা বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন-

"পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম।

সর্বত্র প্রচার হবে মোর নাম।"

অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি শহর ও গ্রামে তার নাম ও কর্ম প্রচারিত হবে। ইসকনের সকল সদস্যরাই শ্রীচৈতন্যদেবের অনুগামী তাই তারা মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সেনাপতি বলে মনে করা হয়।  

ভারতীয় ধর্ম ও ইতিহাসের   অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত এ.এল ভাসান  শ্রীল প্রভুপাদ সম্পর্কে বলেছেন, তার বলিষ্ঠ পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে তিনি যে গৃহ নির্মাণ করেছেন, সেখানে সারা পৃথিবীর মানুষ আশ্রয় পেতে পারে। শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ১৮৯৬ সালের  ১লা সেপ্টেম্বর উত্তর কলকাতার হ্যারিসন রোডে জন্মাষ্টমীর দিন  জন্মগ্ৰহন করেছিলেন। তার প্রকৃত নাম অভয়চরন দে। বাবার নাম গৌরমোহন দে, মা রজনী দেবী। অভয়চরনের বাবা ছিলেন একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। তারা ছিলেন সুবর্ণ বনিক সম্প্রদায়ের। গৌরমোহন দে ছিলেন শুদ্ধ বৈষ্ণব, তাই তিনি তার পুত্র কে ছোট থেকেই কৃষ্ণভক্তরূপে মানুষ করে তুলেছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করেন।পরবর্তীকালে বৈদিক জ্ঞান বিতরণের জন্য প্রভুপাদ নিজেকে প্রস্তুত করেন ও বিদেশ যাত্রা করেন। সারা পৃথিবীব্যাপী শ্রীল প্রভুপাদের সুনাম ও সুখ্যাতি আছে ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার রচনার জন্য। তিনি বৈদিক দর্শনের উপর ইংরাজীতে প্রচুর গ্ৰন্থাবলী রচনা করেন। প্রভুপাদের ওই সব ব‌ইগুলো ভীষণ ভাবে মানুষের কাছে সমাদৃত হয়।

ISKCON মন্দির প্রভুপাদ তাঁর জীবদশাতেই তৈরির কাজ শুরু করেন। বর্তমানে এখানে আরো একটি মন্দির তৈরি হচ্ছে, যা হবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মন্দির।

নবদ্বীপ স্টেশন থেকে টোটো রিক্সা ভাড়া করে পৌঁছে যাওয়া যায় নবদ্বীপ খেয়াঘাটে। এখান থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে মায়াপুর-নবদ্বীপ জলপথে। লঞ্চে ভাড়া জনপ্রতি ৭ টাকা, নৌকায় ভাড়া জনপ্রতি ৩ টাকা। মায়াপুরে ইসকন মন্দির ছাড়াও  দেখে নিন  চৈতন্যভক্ত চাঁদ কাজীর সমাধি ও বল্লাল সেনের ঢিবি। ফিরে এসে ইসকন মন্দির দেখব। যদিও আমি ছাড়া অন্য কারুর এসব দেখার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না। 

নিমাইয়ের জন্মস্থানের মন্দিরটির (দ্বিমতে) পরই নিমাইয়ের "মাসির বাড়ি"।  এই মন্দিরটি দর্শনার্থীদের বিশেষ নজর কারে। এরপর  পৌঁছে যান  "বল্লাল সেনের ঢিপি"। হুলোর ঘাট থেকে বল্লাল সেনের ঢিপির দূরত্ব প্রায় ৮ কিমি পথ। ঐতিহাসিকদের মনে হয়েছে এই ঢিপি প্রাচীন  মন্দিরের ধ্বংসবশেষ। বল্লাল সেনের রাজত্বকালে বাংলায় বিশেষত এই এলাকায় হিন্দু ধর্মের থেকেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বেশি ছিল। এই মন্দিরটি আসলে হিন্দু মন্দির না হয়ে  বৌদ্ধ মন্দিরও হতে পারে বলে ইতিহাসবিদরা অনেকেই মনে করেন । তবে এমন তথ্যও প্রমাণিত হয়েছে, বল্লাল সেনের রাজত্বকালে এই অঞ্চলের প্রচুর বৌদ্ধ মন্দির ছিল যা পরবর্তীকালে  ধ্বংস করা হয়েছিল।

তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বখতিয়ার খিলজি নবদ্বীপ আক্রমনের সময়েও এই মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। তবে বন্যা, ভূমিকম্প সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও এই অঞ্চলের  ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই  ।  বল্লাল ঢিপি নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নস্থল । নবদ্বীপের নিকটবর্তী মায়াপুরে কাছে বামুনপুকুরে ভক্ত চাঁদ কাজীর সমাধিস্থল থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে বল্লাল ঢিপি। এই ঢিপির নীচে বল্লাল সেনের আমলে নির্মিত প্রাসাদ ছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে বর্তমানে এটি পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইন অনুসারে এই অঞ্চল সংরক্ষিত করা হয়েছে। বল্লাল ঢিপি প্রায় চারশো ফুট প্রশস্থ ও উচ্চতায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট। ঢিপিটি সবুজ ঘাসে মোড়া, আর চারিদিক কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা রয়েছে। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের নামানুসারে এই ঢিপিটির নামকরণ করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন ধ্বংসস্তুপটি তৎকালীন সমাজের ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর বিজাপুরের একটি অংশ। বিজাপুর ছিল সেই সময়ের একটি অত্যাধুনিক শহর ও সেন বংশের রাজধানী। বিজাপুর স্থাপন করেন বল্লাল সেনের পিতা রাজা বিজয় সেন।

এই বৃহদাকার ঢিপিটি ১৯৭০-এর শেষের দিকে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব দুটি পর্যায়ে খননকার্য সম্পূর্ন করেছিল। প্রথমটি ১৯৮২-১৯৮৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৮৮-১৯৮৯ সালে। খননে প্রাপ্ত বস্তুর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল, পক্ষী মূর্তি, পোড়ামাটির মানুষ ও জীব-জন্তুর মূর্তি, তামা ও লোহার নানান জিনিসপত্র, পেরেক ও নানান প্রত্নসামগ্রী। এসবই কলকাতায় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। খননের কারনে অঞ্চলটি বর্তমানে অনাবৃত রয়েছে। বিস্তৃত প্রাঙ্গনের মধ্যে অবস্থিত বৃহদায়তন ইটের ইমারত যার চারিদিকে ছিল উচ্চ প্রাচীর।  ইতিহাসবিদরা এই ইটের তৈরী ইমারত দেখে ইমারতটি কিসের তার সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ইতিহাসবিদ্ বা প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারেন যে নিচের অংশের অনেক পরে ইমারতের উপরের অংশটি নির্মাণ করা হয়। অষ্ঠম ও নবম শতকের ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাতন স্থাপত্যকীর্তির উপর পুনঃনির্মিত এই সৌধের উপরিভাগ আনুমানিক দ্বাদশ শতকের। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ের মেরামত,পরিবর্তন ও সংযোজন নিদর্শন পাওয়া গেছে।

বল্লাল সেন বাংলার সেন রাজবংশের দ্বিতীয় তথা শ্ৰেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন। তিনি ১১৬০ থেকে ১১৭৯ সাল পর্যন্ত সেনবংশের রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেনের পুত্র এবং তার যোগ্য উত্তরসূরী। রাজা বল্লাল সেন বাংলার সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তনকারী হিসাবে পরিচিত। তিনি সুপণ্ডিত ও লেখক ছিলেন। ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুদসাগর’ তার উল্লেখযোগ্য রচনা। বল্লাল সেন তার রাজত্বের সময় বহুদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। বরেন্দ্রভূমি, রাঢ়, বঙ্গ, এবং উত্তরপ্রদেশের মিথিলা তার অধীনস্থ ছিল। শোনা যায় বল্লাল সেন দক্ষিণাত্যের কোন  বংশদ্ভূত ব্যক্তি ছিলেন। 

বল্লাল সেনের ঢিপির কাছেই  বামুনপুকুর বাজারের মধ্যে আছে "চাঁদ কাজীর" সমাধি মন্দিরে। চাঁদ কাজী ছিলেন ওই এলাকার একজন ছোট রাজা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি বৈষ্ণব আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।  চাঁদ কাজী বিভিন্ন সময়ে সেসময়ে চৈতন্যদেবকে হেনস্থাও করেছিলেন তবে  পরবর্তী সময়ে শ্রী চৈতন্যের ভাবাদর্শ অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্য করেছিলেন । সেই চাঁদ কাজীর সমাধির উপর এক প্রকান্ড চাঁপা গাছ গজিয়ে উঠেছিল, যা আজও বর্তমান। জনশ্রুতি এই গাছটির আনুমানিক বয়স প্রায় ৫০০ বছর। চাঁদের সমাধি থেকে ফেরার পথে দেখে নিন "খোল ভাঙা মন্দিরে"। জনশ্রুতি এই জায়গাতেই নিমাই সন্ন্যাসীর হরিনাম সংকীর্তনের সময়  খোল বাদ্যটি ভেঙেছিলেন জগাই ও মাধাই। 

মায়াপুর নবদ্বীপ দর্শন করে মন চাইলে সেই রাত থেকে যান ইসকনের মন্দিরের গেষ্ট হাউসে অথবা নিকটবর্তী হোটেলে। মন্দিরের আশেপাশে অসংখ্য বিভিন্ন দামের হোটেল পাবেন। সন্ধ্যায় মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি আপনার মনমোহিত করবে। আবার ইচ্ছা হলে নবদ্বীপেও কোন ধর্মশালা বা হোটেলে থাকতে পারেন। সন্ধ্যায় নবদ্বীপ ঘাট থেকে ইসকনের মন্দিরের দৃশ্য ও সুন্দর। (সমাপ্ত) 

তথ্য ঋণ -

১) তিন তীর্থে, শিবশঙ্কর ভারতী, সাহিত্যম্‌, ১৮বি, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ- ১৮ই জানুয়ারী, ২০০১

২)গৌরাঙ্গ সুন্দর দত্ত

৩) গুগুল

৪)উইকিপিডিয়া

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours