প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:
গুপ্তিপাড়া হুগলী জেলার একটি প্রাচীন জনপদ। এই জায়গাটি চুঁচুড়া সদর মহকুমা ও বলাগড় থানার অধীন। গুপ্তিপাড়া ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত। ১৭৭৯ সালের রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় পার্শ্ববর্তী বেহুলা নদী গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে ভাগিরথী বা গঙ্গায় পড়েছে। ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব ৪৩ কিমি।
বাংলায় প্রথম বারোয়ারি পুজার প্রচলন শুরু হয় গুপ্তিপাড়ায়। এটি বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী পুজা নামে প্রচলিত। ১৭৬০ সালে (মতান্তরে ১৭৯০) কয়েকজন ব্যক্তি স্থানীয় সেন রাজাদের প্রচলিত দুর্গাপুজায় অংশ না নিয়ে নিজেরাই পুজা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বারোজন ব্যক্তি মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বিন্ধ্যবাসিনী বারোয়ারী পুজা। রাজার বিরুদ্ধে সেকালে এহেন সিদ্ধান্ত নেওয়া কিন্তু মুখের কথা নয়। রাজ পরিবারের লেঠেলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই দুর্গাপূজা সারা রাজ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল।
গুপ্তিপাড়া শিক্ষার বিষয়ে পিছিয়ে পড়া গ্রাম নয়। এই অঞ্চল বরাবরই শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুরাগের প্রতি বিশেষ যত্নশীল । একসময়ে এখানে প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নানা টোল গড়ে উঠেছিল। সংস্কৃত ভাষার শিক্ষাবিদ, টোলের পন্ডিতেরা বসবাস করতেন এই গুপ্তিপাড়ায়। এই সংক্রান্ত বহু পুঁথি স্থানীয় সরকারী গ্রন্থাগার 'শিশির বানী মন্দির পাঠাগারে' আজও সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে এই অঞ্চলে অনেকগুলি প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। গুপ্তিপাড়ায় আছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ IIMT । রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থী আসেন এই কলেজে পড়াশুনা করতে। গুপ্তিপাড়ার পরের স্টেশন অম্বিকা কালনা। এই এলাকার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী কালনা মহাবিদ্যালয় ও জিরাট মহাবিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি শিক্ষা লাভ করেন।
গুপ্তিপাড়া হুগলি জেলার প্রান্তবর্তী গ্রাম। গুপ্তিপাড়ার পরই পূর্ব বর্ধমান জেলার সীমানা। আবার গঙ্গার অন্যপাড়ে নদীয়া জেলার ফুলিয়া। ফলে এই গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের মধ্যে তিন জেলার প্রভাব লক্ষ্যনীয়। গুপ্তিপাড়ার প্রধান ও বিখ্যাত উৎসব হল দোল ও রথযাত্রা। এই অঞ্চলে ২৭৯ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাইল পথের দু’ ধারে মেলা বসে। উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয়। প্রথা অনুযায়ী ভোগ নিবেদন করার পর ভক্তরা ভোগ লুট করে নেন। বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যতম। পূর্বভারতের নানা অঞ্চল থেকে রথের রশি টানার জন্যে এখানে মানুষ আসেন।
বৃন্দাবনচন্দ্র মঠে রয়েছে ৪টি বৈষ্ণব মন্দির। বৃন্দাবনচন্দ্র, চৈতন্য, রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। রামচন্দ্র মন্দিরে বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের নিদর্শন আছে। এই চার মন্দিরের সমষ্টিকে বলা হয় গুপ্তিপাড়ার মঠ। গুপ্তিপাড়া ও পার্শ্ববর্তী কালনা বৈষ্ণব সংস্কৃতি ও শাক্ত সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। প্রাচীন দেশকালী মাতার মন্দির আছে গুপ্তিপাড়ায় । দেশকালীমাতা গুপ্তিপাড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এখানে কালীপূজার দিন নতুন মাটির মূর্তি এনে পুজো করা হয়। পরের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন মূর্তির কেশ, কাঁকন, কেউর, কপোল প্রভৃতি কেটে নিয়ে বাকি মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। খণ্ডিত অংশগুলো একটা আধারে রেখে সারা বছর তান্ত্রিক মতে পূজা করা হয়। এই মন্দিরে আধার ছাড়া কোনো দেবীমূর্তি নেই।
গুপ্তিপাড়ায় জন্মেছেন রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু কালী মির্জা। এছাড়া বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা, বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লালের জন্মস্থান হিসেবেও স্বীকৃত। বাংলার মিষ্টান্ন গুঁপো সন্দেশ উদ্ভব হয় এই গুপ্তিপাড়াতেই।
গুপ্তিপাড়া স্টেশনটি হুগলি জেলার অন্তিম স্টেশন। গুপ্তিপাড়ার পরের স্টেশন অম্বিকা কালনা। তবে সকলেই এই শহরকে কালনা নামেই চেনেন।
অবিভক্ত বর্ধমান জেলার প্রাচীন জনপদ অম্বিকা কালনা। অধুনা পূর্ব বর্ধমানের এই শহর কালনা নামেও পরিচিত । অতীতে এই জনপদের নাম ছিল অম্বুয়া নগরী। আকবরের রচিত আইন-ই- আকবরি তেও এই অম্বুয়া নগরীর উল্লেখ আছে। কথিত আছে ঋষি অম্বু এই কালনা শহরেই বসবাস করতেন। তাঁরই নাম অনুসারে শহরের নাম অম্বিকা কালনা। দ্বিমতে কালনার অধিষ্ঠাত্রি দেবী অম্বিকার নাম অনুসারে কালনা, অম্বিকা কালনা নামে পরিচিত। কালনা শহরের শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা বহুকাল থেকেই খ্যাতি অর্জন করেছে । শহরের প্রানকেন্দ্রে একটি মহাবিদ্যালয় ও নয়টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি টেকনিক্যাল কলেজ আছে।
বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এই কালনা শহরে বসবাস করেন। কালনা শহরের উত্তরে ভাগিরথী নদী। বর্নিত আছে কালনা কোন এক সময় এরাজ্যের অন্যতম প্রধান জাহাজ বন্দর ছিল। আজও কালনা ব্যাবসা বাণিজ্যে অন্যতম প্রধান জায়গা দখল করে আছে পূর্ব বর্ধমান জেলায়।
কালনার মূল আকর্ষণ দুইটি বৃত্তের মধ্যে সুদৃশ্য ১০৮ শিব মন্দির । এই মন্দির স্থানীয়দের কাছে নব কৈলাশ মন্দির নামেই পরিচিত। ১৮০৯ সালে মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর এই ইঁটের তৈরি আটচালা মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন। মন্দিরগুলি দুটি বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত। একটি বৃত্তে ৭৪টি ও অপর বৃত্তে ৩৪টি মন্দির অবস্থান করছে। প্রথমোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি শ্বেত অথবা কষ্টিপাথরে ; কিন্তু শেষোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি কেবলমাত্র শ্বেত পাথরেই নির্মিত। মন্দিরের সুপরিকল্পিত নকশার কারণে সবকটি শিবলিঙ্গই মন্দির-চত্বরের কেন্দ্র থেকে দেখা যায়। সম্ভবত জপমালার প্রতীক হিসেবে মন্দিরগুলি উপস্থাপিত হয়েছে।
১৭৫১-৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৫টি চূড়বিশিষ্ট কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির কালনার অপর জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য। এই জমকালো ইঁটের তৈরি পঞ্চ-বিংশতি রত্ন মন্দিরটির সামনে সংলগ্ন রয়েছে অপূর্ব অলঙ্করণে সমৃদ্ধ ত্রিখিলান প্রবেশ পথ বিশিষ্ট ঢালা ছাদের প্রলম্বিত বারান্দা। মন্দিরের গা অলঙ্কৃত মহাকাব্য ও পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্যসম্বলিত পোড়ামাটির ফলকে সমৃদ্ধ। এছাড়াও ১৭৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৫টি চূড়াবিশিষ্ট অপর মন্দির লালজি মন্দির এবং ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রেখ দেউলের নিদর্শন প্রতাপেশ্বর মন্দিরও উল্লেখযোগ্য। প্রাচীরবেষ্টিত প্রাঙ্গনে ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই পঞ্চবিংশতি-রত্ন লালজি মন্দির সম শ্রেণীভুক্ত মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাটমণ্ডপ এবং আর একটি পর্বতাকৃতি মন্দির যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত। মূল মন্দিরটি পোড়ামাটির অলঙ্করণে মণ্ডিত। এই ছবিতে কিছু পোড়ামাটির কাজের নমুনা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে উঁচু ভিত্তির উপর উত্থিত এক খিলান প্রবেশ পথ ও ঈষৎ বক্র শিখর সমন্বিত প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি ঊনবিংশ শতকের রেখ দেউলের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির জমকালো অলঙ্করণ। মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি ছাদবিহীন রাসমঞ্চ।মাইজির বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৫২ সালে। এই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত শ্যামচাঁদ রাধারানি মন্দির। এ বাড়ির ঐতিহ্য তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো। আজও দোল পূর্ণিমা, রথযাত্রা, ঝুলন পূর্ণিমা, অন্নকূট ও রাস বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হয় এখানে। এই উপলক্ষে এখানে উপস্থিতও হন বর্ণ, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ। তাছাড়া প্রতিবৎসর রাজ্য সরকারের পক্ষ্য স্থানীয় রাজবাড়ীর মাঠে পর্যটন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পৌরসভার উদ্যোগে মন্দিরগুলিতে রঙবেরঙের আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজবাড়ীর অনতিদূরে গোপাল বাড়ির ২৫ চূঁড়া বিশিষ্ট মন্দিরটিও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
গোপালবাড়ির সন্নিকটে অবস্থিত কালনার অধিষ্ঠাত্রীদেবী মা সিদ্ধেশ্বরীর এক চালা মন্দির।
১১৪৬ বঙ্গাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠ মাসে রাজা চিত্রসেনের ইচ্ছায় এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। মন্দির নির্মাণ করেছিলেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী শ্রীরামচন্দ্র মিস্ত্রি। বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা চিত্রসেন হলেও তার বহুপূর্ব থেকেই দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালনায় পূজিত হয়ে আসছেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন আসলে দেবী সিদ্ধেশ্বরী জৈনদের আরাধ্য দেবী। দেবী সিদ্ধেশ্বরীর মূল মন্দিরটি ছাড়াও আরো পাঁচটি শিবমন্দির আছে মন্দির প্রাঙ্গণে। এর একটি ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন রাজা ত্রিলোকচাঁদের মাতা লক্ষীকুমারী দেবী। বর্ধমান রাজার অমাত্য ছিলেন রামচন্দ্র নাগ। ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনিও অন্য একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন মন্দির প্রাঙ্গনে।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের অনতি দূরেই অনন্তবাসুদেব মন্দির। এটিও বিষ্ণুপুরের স্থাপত্যের আদলে তৈরি আটচালা আকৃতির মন্দির। টেরাকোটার অপূর্ব অলঙ্করণে সুসজ্জিত এই মন্দির। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত পাথরে নির্মিত বদ্রিনারায়ণের সুদর্শন বিগ্রহ। ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে (১৬৭৬ শকাব্দ) মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন রাজা ত্রিলোকচাঁদ। উৎসর্গ করেন পিতামহী ব্রজকিশোরী দেবীর নামে।
গঙ্গার তীরে বর্ধমান মহারাজাদের তৈরি আরো একটি সুন্দর মন্দির আছে, এটি জগন্নাথ মন্দির নামে পরিচিত। তবে সেই মন্দিরটি রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে দিন দিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এক সময় রাজাদের উদ্যোগে কালনায় জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা উৎসবে দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসতেন। হত নগরপরিক্রমা, উৎসব। কিন্তু আজ সেই কৌলিন্য হারিয়েছে সময়ের সাথে সাথে। রাজাও নেই,তাই রাজ বৈভবও দেখা মেলে না জগন্নাথ মন্দিরে । যদিও রথযাত্রা উৎসব এখনো হয়, কিন্তু সেই চাকচিক্য ছাড়াই।
কালনা শহর সাধক কমলাকান্তের সাধনক্ষেত্র। কালনার বিদ্যবাগিস পাড়ায় কমলাকান্তের ভিটায় নবরূপে একটি মন্দির তৈরি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সাধক ভগবান দাস বাবাজি একজন বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। বৃন্দাবন থেকে তিনি কালনায় এসে বসবাস করতেন। একসময় ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব ভগবান দাস বাবাজিকে দর্শন করতে কালনায় উপস্থিত হয়েছিলেন। কালনা চকবাজারে ভগবান দাস বাবাজির মন্দির। ভগবান দাস বাবাজি রোজ গঙ্গায় স্নান করতেন। কিন্তু বার্ধক্যে তিনি গঙ্গায় যেতে পারতেন না। সেই সময় মা গঙ্গা তার আশ্রমে এসেছিলেন। এই মন্দিরে আজও মা গঙ্গা নিত্য দর্শন দেন । এটি পাতাল গঙ্গা মন্দির নামেও পরিচিত।
কালনা বৈষ্ণব সাধনার অন্যতম পীঠস্থান। এখানে নিমাই সন্নাসী, নিত্যানন্দ, গদাধর পন্ডিত বারেবারে এসেছেন ও থেকেছেন। কালনার মহাপ্রভু বাড়ি দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণ । এখানে আজও ঝাঁপি দর্শন প্রথা চালু আছে। শ্রী চৈতন্যদেব যে আমলি বৃক্ষের তলায় বিশ্রাম নিয়েছিলেন তা আজও অক্ষত ও বিরাজমান। এই মন্দিরে রক্ষিত আছে চৈতন্যদেবের পাণ্ডুলিপি ও ব্যবহৃত সামগ্রী। এই মন্দিরে সকাল ১০ টার মধ্যে পূজারীকে আবেদন করলে দর্শনার্থীদের জন্য ভোগের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
মহাপ্রভু মন্দিরের কাছেই কালনার শিতলা তলায় প্রাচীন একটি মসজিদ আছে, যা কালনার পুরাতন মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল আনুমানিক ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে। মুঘল আমলে হুসেন শাহের পুত্র ফিরোজ শাহের চেষ্টায় তাঁর সেনাপতি আলাউদ্দিন শাহ এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। এত পুরানো মসজিদ পূর্ব বর্ধমান জেলায় নেই। ঈদের সময় এবং বিশেষ বিশেষ পরবে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা এই মন্দিরে নামাজ পড়েন।
প্রথমেই বলেছিলাম কালনা প্রাচীন জনপদ। এই জনপদ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পদার্পনে ধন্য । কালনার কৃতি সন্তান তারানাথ তর্কবাচস্পতীর পাঠশালা ও বসতবাটী ছিল এশহরে। যাঁরা বিদ্যাসাগরের নাম জানেন তাঁরা তারানাথ তর্ক বাচস্পতি মহাশয়ের মত পন্ডিতের নামও জানেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই শহরের অনেক সংগ্রামী মানুষ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সাধক ভবা পাগলা এ শহরে শাক্ত আরাধনা করেছেন। ভ্রমনার্থীরা ইচ্ছা করলে একদিনেই এসব দেখে নিতে পারেন। দেখে নেওয়া যায় একটি দিন কালনায় থাকলে কালনা থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক ভিটে দত্ত দেরিয়াটন। যদিও সেই বাড়ির আর কিছুই নেই।
কালনা মহকুমার বৈদ্যপুর গ্রামের নামও ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে আজ আর অজানা নয়। একসময় এই গ্রামে নন্দীদের জমিদারি ছিল। নন্দী বংশের প্রথম জমিদার হারাধন নন্দী। একদিন কালনায় থাকলে বৈদ্যপুরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য পুরাকীর্তিগুলিকেও দেখে নেওয়া যায়। জোড়া দেউল, বৃন্দাবন চন্দ্র মন্দির, রাজ রাজেশ্বরী মন্দির, নবরত্ন মন্দির, রাশ মঞ্চ ও জমিদার বাড়ি বৈদ্যপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বৈদ্যপুরের প্রধান উৎসব রথ যাত্রা ও জগদ্ধাত্রি পূজা। বেশ আড়ম্বরের সাথে এই দুই উৎসব এই গ্রামে পালিত হয়।
বৈদ্যপুর রথতলা পেরিয়ে বৈদ্যপুর স্কুলের মাঠ। এই মাঠের পশ্চিম দিকের পথ চলে যাচ্ছে গোপালদাসপুর গ্রামে। এখানে আছেন “রাখাল রাজা” মন্দির। বৈদ্যপুর অঞ্চলের মন্দিরগুলি সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের কারনে অনেকগুলিই তাঁর প্রাচীন গরিমা হারালেও এই অঞ্চল আজও ভক্তি আন্দোলনের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। স্থানীয় মানুষদের কাছে রাখাল রাজা এক আবেগ।
রাখাল রাজার ইতিহাস বড়ই রোমাঞ্চকর। কাটোয়ার খাটুন্তি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন ধর্মপ্রাণ রামকানু গোঁসাই। পারিবারিক কলহে অতিষ্ট হয়ে তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা গোপীনাথকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে গোপালদাসপুর জঙ্গলে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। সেই সময় এই এলাকা ছিল গভীর জঙ্গলে পরিবেষ্টিত। আশেপাশের মানুষজন খুব একটা দরকার না পড়লে এই জঙ্গলে আসতেন না।মাধুকরি করেই সেকালে রামকানু জীবিকা অর্জন করতেন ও দেবতার সেবা করতেন। তাঁর তিন পুত্র সন্তান ছিল। নিমাই চাঁদ, বলদেব ও রাখাল। এই রাখাল একদিন খেলতে খেলতে পিতার লাগানো মাধবী গাছটির ডাল পালা সব ভেঙে ফেলে। এদিকে অন্যান্য ফুলের গাছগুলিতেও কোন ফুল ধরেনি সেদিন।রামকানু সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন কে মাধবী গাছটির ফুল ছিঁড়েছে। সবাই পিতার ভয়ে নিশ্চুপ । রামকানু রেগে গেলেন, পূজার ফুল না পেয়ে ক্রোধে বলে বসলেন, যে ফুল ছিঁড়েছে তিন রাত্রির মধ্যে তাঁর মৃত্যু হবে।
পিতার অভিশাপে রাখালের মৃত্যু হয় তারপর দিনই। রামকানু পরে জানতে পেরে অবশ্য দেবতার সামনে কান্নাকাটি করেও পুত্র রাখালের মৃত্যু রোধ করতে পারেননি। রাখালের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মন দুঃখে বৃন্দাবনের দিকে হাঁটতে থাকেন। একদিন সন্ধ্যায় একটি গাছের তলায় বিশ্রাম নেবার সময়, তিনি স্বপ্নাদেশ পান বৃন্দাবন তো তাঁর গ্রামেই। ভগবান রামকানু গোস্বামীকে গ্রামে ফিরতে বলেন। ব্রজধামে না গিয়ে গ্রামে ফিরে এসে রাখাল রাজের প্রতিষ্ঠা ও পূজা শুরু করেন রামকানু গোস্বামী।
স্বপ্নাদেশে রাখাল রাজের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। এখানে বর্তমানে যে মূর্তি পূজিত হয় রাখাল রাজের তা বড়ই সুন্দর। কৃষ্ণ রাখাল, বাম হাতে ক্ষীরের নাড়ু, ডান হাতে লাঠি। মূর্তির ডান হাঁটু ভাঙা। রাখাল রাজার চারিদিকে গাভী ধবলী। কথিত আছে যে নিমকাঠটি দিয়ে মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল তা পাশের পুকুরে ভেসে উঠেছিল। এই পুকুরটি যমুনা নামে খ্যাত। স্বপ্নাদেশে রামকানু নির্দেশমত সেই কাঠটি দিয়ে দেবতার মূর্তি বানিয়েছিলেন বাঘনাপাড়া গ্রামের পাঁচ বছরের শিশু মহাদেব।এসবই লোককথা বা স্থানীয় মানুষের ও ভক্তদের বিশ্বাস।
শত শত বৎসর ধরে এই এলাকায় আসছেন সাধুসন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রী ও ভ্রমন পিপাসু মানুষেরা। সীতারাম ভক্ত ব্রহ্মানন্দ দাস সহ অজানা অচেনা অনেক সাধু সন্ত এখানে এসেছেন। একসময় গভীর জঙ্গলের মধ্যেই এই মন্দির গড়ে তুলেছিলেন পোঁটবার জমিদার গোপাল দাস। যদিও ওনার জীবনী বিশদে জানতে পারিনি। তবে সে সময় মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খান। রামকানু গোস্বামীর কথা শুনে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ও নিষ্কর জমি দান করেছিলেন রাখাল রাজের সেবার জন্য।
জনশ্রুতি পোঁটবার জমিদার গোপাল দাস শিকারে বেরিয়ে এই এলাকার গভীর জঙ্গলে একদিন সন্ধ্যায় তাঁবু ফেলেন। এমনি সময় তিনি জঙ্গলে কাঁসর, ঘন্টা, শঙ্খ ধ্বনি শোনেন। সেই আওয়াজ অনুসরণ করতে করতে তিনি একটি বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়ে দেখেন একজন ব্রাহ্মন কৃষ্ণের পূজা করছেন। গভীর জঙ্গলে এ দৃশ্য দেখে তিনি অবাক হন। এদিকে ব্রাহ্মন গোপাল দাসকে দেখেও অবাক। তিনি প্রশ্ন করেন গোপালের এখানে আসার হেতু। এরপর ব্রাহ্মন তাঁদের সকলকেই ভোগ খাবার অনুরোধ করেন। কিন্তু অল্প ভোগ থাকলেও সেদিন জমিদার ও তাঁর সহযাত্রী সকলের সেদিন পেট ভরে। জনশ্রুতি এই গোপাল দাস প্রথম এখানে মন্দির করেন ও রাখাল রাজের ভোগের জন্য সম্পত্তি দান করেন ব্রাহ্মনকে। ১৭৭৫ সালে এই মন্দির তৈরি হয়। অন্যান্য মন্দিরগুলি যদিও ধ্বংস হয়েছে। এই গোপাল দাসের নাম অনুসারেই গ্রামের নাম গোপালদাসপুর।
মন্দির প্রাঙ্গণ খুবই সুন্দর। ফাঁকা মাঠের মধ্যে বড় বড় বট, অশল্থ, করবীর জঙ্গল আজও চোখে পড়ে। মন্দিরের পাশেই যমুনা নামের পুষ্করিনি,যা পবিত্রতার নিদর্শন। অনতি দূরেই বয়ে চলেছে একটি খাল। পঞ্চায়েতের পরিচর্যায় অনেক বৃক্ষ রোপিত হয়েছে চারিপাশে। মন্দিরের আশেপাশে কোন ঘরবাড়ি নেই। এ যেন এক তপোবন।
মন্দিরে আসার জন্য বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও তা যথেষ্ট নয়। গ্রামের পাকা রাস্তা হইতে মন্দির পর্যন্ত রাস্তার উন্নতি হলে ভালো হয়। তবে এ রাস্তায় ছায়াঘন পরিবেশ দূর দুরন্ত থেকে আসা পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
বংশপরম্পরায় রামকানু গোঁসাই এর পরিবারের লোকজনই এখানে পৌরহিত্য করেন। যদিও এখন পালা করে পূজাপাঠ অনুষ্ঠিত হয়। ভাত, ডাল, শুক্ত, চরচরি,চাটনি, পরমান্য সহযোগে রোজ দুপুরে ভোগ দেওয়া হয়। এখানে এলে প্রসাদ না পেয়ে কেউই ফিরে যায় না। এটাই এখানকার স্থান মাহাত্ম। তবে এখন পঁচিশ টাকা করে মূল্য দিতে হয়। পূজারীরাই ভোগের ব্যবস্থা করেন। প্রতিদিন কীর্তন অনুষ্ঠিত হয়। মন্দির সংলগ্ন প্রশস্ত মাঠটি বিশেষ সুন্দর।
সন্ধ্যা আরতির পর মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়। জনশ্রুতি আরতির পরে এই স্থানে আর কেউ আসেন না। কারন পুরো এলাকাতেই এক অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানুষের বিশ্বাস ভগবান রাখালরাজা এই স্থানে সাক্ষাৎ বিরাজ করেন সন্ধ্যার পর। এক পুরোহিত কে এই ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে উনি বলেন- “কিছু মানুষ এসেছিলেন রাত্রে বিষয়টির সত্যতার প্রমান পাওয়ার জন্য। বেশির ভাগ জনই ভয়ে ফিরে গেছেন। আবার অনেকের অপমৃত্যু হয়েছে ,নয়তো মুক ও বধির হয়ে গেছেন ।” পাঁচালিকার অজিত কুমার গোস্বামীর লেখা বই থেকেও সে ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।
তবে বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই এই তীর্থভূমিতে জনসমাগম দিন দিন বাড়ছে। বর্ধমান -হাওড়া মেন লাইন ট্রেন ধরে বৈচি স্টেশনে বা হাওড়া-কাটোয়া লোকাল ধরে কালনা স্টেশনে নেমে বাসে আসতে হয় বৈদ্যপুর। বৈদ্যপুর থেকে অটো বা টোটো রিক্সা নিয়ে গোপালদাসপুর আসা সুবিধা। গোপালদাসপুর আসার পথেই পড়বে আরও একটি প্রাচীন মন্দির “জগৎ গৌরী” মায়ের। এই স্থান জগৎ গৌরী তলা নামে খ্যাত।বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই তান্ত্রিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
কালনায় এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেখে নিতে পারেন আরো দুটি প্রসিদ্ধ গ্রাম বাঘনাপাড়া ও সমুদ্রগড়। শিবক্ষেত্র রূপেই আদি পরিচিতি বাঘনাপাড়ার। তবে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে একসময় ধীরে ধীরে সে পরিচিত ম্লান হয়ে প্রসিদ্ধি পায় বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্র রূপে। স্থানীয় বৈষ্ণব পরিবারের উদার মানসিকতায় শিব দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রী রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি দেবদেবীর পুজো চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে এই গ্রামে। সারা বছর উৎসব লেগে রয়েছে এখানে। শিবরাত্রিতে গোপীশ্বর মন্দিরে, বৈশাখী পূর্ণিমায় কৃষ্ণ বলরামের ফুলদোল উৎসব, দোলযাত্রা, চৈত্রমাসে গোপীশ্বর শিবের গাজন, আষাঢ়ে জগন্নাথদেবের স্নান ও রথযাত্রা এমন অসংখ্য উৎসবে সারাবছরই মুখরিত বাঘনাপাড়া। কালনা শহর থেকে বাঘনাপাড়ার দূরত্ব মাত্র ৭ কিমি। বাসের যোগাযোগ ভালো। ইচ্ছা হলে একটি টোটো বা অটো রিকশা ভাড়া করেও দেখে নেওয়া যায় এই গ্রামের অনাচেকানাচে।
সমুদ্রগড় আরো একটি জনপদ। কালনা থেকে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিমি। এই জনপদ তাঁত শিল্পের জন্য বিশেষ খ্যাতি আছে। ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম গড় হিসাবে এই গ্রাম বিশেষ পরিচিত রাজ্যবাসীর কাছে। একসময় এই সমুদ্রগড়ের তাঁত বাংলা সিনেমা এমন কি হলিউডের শিল্পীদের কাছেও বিশেষ সমাদৃত ছিল। মহানায়ক উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী অনেকবার এই গ্রামে এসেছেন তাঁতের টানে।
আসুন প্রাচীন মন্দির শহর কালনায়। সময় থাকলে পৌঁছে যেতে পারেন লঞ্চে করে গঙ্গার অপর পাড়ে শান্তিপুর শহরে। রেলপথে এই শহর হয়েও কালনায় আসা যেতে পারে অতি অল্প সময়ে। (ক্রমশঃ)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours