তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

লক্ষ্মীকান্তের প্রপৌত্র কেশব রাম (১৬৫০-১৭২৬খৃ ) দক্ষিণ চাকলার রাজস্ব সংগ্রহের কর্মচারী অর্থাৎ জমিদার হিসাবে নিযুক্ত হন৷ তখন কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর তিনটি গ্রাম সাবর্ন রায় চৌধুরী বংশের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ এই তিনটি গ্রামকে কেশবরামের তিন নাবালক পৌত্র (১৬৯৮ খৃষ্টাব্দের) ১০ই নভেম্বর তেরশো টাকার বিনিময়ে লিজ দিয়েছিলেন৷ তাহলে এর থেকে প্রমানিত হয় উক্ত গ্রাম তিনটি ইংরেজদের নিঃশর্তে দিয়ে দেওয়া হয়নি৷ বরং বলা যেতে পারে নিঃশর্তে বিক্রির পরিবর্তে পাট্টা বা লিজ দেওয়া হয়েছিল৷ অর্থাৎ তারা ছিল ওই গ্রাম তিনটির পাট্টাদার মালিক৷ সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের সঙ্গে একটি অঙ্গীকারপত্র লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে৷ এই তিনটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব লাভ করার পর ইংরেজ কোম্পানির মর্যাদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল৷ এই সময় লালদিঘির পাড়ে সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের একটি পাকাবাড়ি ছিল৷ যে বাড়িতে জবচার্নকের জামাতা চার্লস আয়ার কোম্পানির সেরেস্তার জন্য ভাড়া নিয়েছিল৷ সেটি ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম অফিস বাড়ি৷

(১৭৫৭খৃষ্টাব্দে) পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর ইংরেজদের হাতে অনেক ক্ষমতা চলে আসে৷ স্বাভাবিক ভাবে সাবর্ণ রায় চৌধুরীগণ ইংরেজদের আর প্রজা বলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে৷ যার ফলে ইংরেজরা খাজনা আদায় দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল৷ যদিও সাবর্ণ চৌধুরীগণ এর বিরুদ্ধে মামলা করে খাজনা বুঝে নিয়েছিলেন৷ সেই খাজনা আদায়ের প্রমান স্বরূপ Consultation Book'এ তারিখ অনুসারে সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছে৷

অতএব সমস্ত দিক বিচার করে এটাই প্রমানিত হয় কলকাতা বহু আগে থেকেই ছিল৷ তবে তখন এই গ্রামগুলি ছিল হতশ্রী, জনবসতি বিরল। পর্ত্তুগীজ দাস ব্যবসায়ী এবং মগেদের আক্রমনে (১৬৮০খৃ) প্রায় ৬০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়। তার প্রভাব এই সব অঞ্চলে ও পড়েছিল। সে সব কারনে এই অঞ্চলগুলি ছিল ঝোপঝাড় অধ্যুষিত৷ পরে আস্তে আস্তে চেহারা বদল হতে হতে কলকাতা সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে ওঠে৷ দিনে দিনে গড়ে ওঠে দুর্গ, পাকা বাড়ি, ব্যারাক, হাসপাতাল, গির্জা, আরো কতো কি৷ অবশ্য এর বেশীর ভাগ নির্মান কাজই ইংরেজদের৷ অর্থাৎ সাহেবরা তাদের প্রাণের শহরের রূপের বদল ঘটিয়েছেন৷ এমনকি কলকাতা নিয়ে চর্চাও সাহেবরা আমাদের শিখিয়েছেন৷

ইংরেজরা কলকাতা নিয়ে যে সমস্ত বই লিখেছেন বা আমরা যে সমস্ত বই পড়ে অভ্যস্ত, সেখানে কলকাতার যে পরিচয় আমরা পাই তা সত্য নয়৷ বরং আমাদের দেশীয় সাহিত্যে যে সমস্ত লেখা পাওয়া যায় তা নিঃসন্দেহে গ্রহন যোগ্য৷ এমন কি মোগল যুগের ইতিহাসেও কলকাতা নিয়ে অনেক সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়৷ কিন্তু আমরা ভারতীয়রা ইংরেজদের সৃষ্ট যে কোন বিষয়কে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকি৷

রবি ঠাকুরের ভাষায় —

বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে

বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে

দেখিতে গিয়েছি পর্বত মালা

দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশির বিন্ধু ৷ (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours