সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

করোনা আবহে বিষাদের সংখ‍্যা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।মনখারাপ চারিদিকে। দুর্গোৎসব এসে গেল। সম্বৎসর অপেক্ষায় থাকি। আর মাত্র কদিন বাদেই ঢাকে কাঠি পড়বে। তবুও মনে কোনো তাপ উত্তাপ পাচ্ছি না।  অন‍্যবার এসময় পুজো হয়ে যায় বা কখনো কখনো আশ্বিন কার্তিক এই দুমাসে পুজো হয়েছে অর্থাৎ  আশ্বিনের সংক্রান্তিতে নবমী হয়েছে বা দশমী। এবার   আশ্বিন ছিল মল মাস। তাই পুজো বেশ দেরিতে। কিন্তু পুজো নিয়ে আলাদা কোনো উন্মাদনাকে মনে জায়গা দিই নি। কেন দেব? উৎসব, উদযাপন, উদ্দীপনা তখনই আসে যখন মনে আনন্দ আসে। কিন্তু চারিদিকে বিষণ্নতা, মৃত্যুর মিছিল। তাই এবছর কোনো কিছুতেই সামিল হলাম না। তবে বিষণ্নতার মাঝে পুরোনো কিছু ভালোবাসার স্মৃতি মনে কেমন যেন মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসের স্নিগ্ধতা এনে দেয়। সেই রকম একটা স্মৃতি হল নলসংক্রান্তি।

গ্রামীণ বাংলার এক বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য নলসংক্রান্তি বা আশ্বিনের সংক্রান্তি। এই উৎসবকে  অনেকে ডাকসংক্রান্তিও বলেন।

কিন্তু কি এই নলসংক্রান্তি? চলতি কথায় এ হল ধানগাছের সাধভক্ষণ। আসন্ন প্রসবাকে যেমন সাধ খাওয়ানো হয় ঠিক সে রকম সশীষ ধানকেও আসন্ন প্রসবা হিসেবে গণ‍্য করে তাকে ধূমধাম করে বিধি মেনে বিভিন্ন উপাচার দিয়ে সাধ খাওয়ানো হয়। 

আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস এই দুমাসকে ধানের গর্ভ কাল বলে ধরা হয়। নলগাছ বহু প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী। গাঁ গঞ্জের সরল মানুষ আশা করেন তাদের ধানগাছ গুলোও নল গাছের মত প্রজনন ক্ষমতার অধিকারি হয়ে সুজলা সুফলা হবে। স্বর্ণশস‍্যে যেন  ধানের গোলা যেন ভরে ওঠে। 

এখনো মনে পড়ে আশ্বিনের শেষদিনে বেশ গা শিরশির ঠাণ্ডা থাকত। কুয়াশা গাঢ় না হলেও থাকত। হলুদ মেখে স্নান করে ছোটা হত জমিতে নলগাছ পুঁততে। ওখানেই পুজো হত। তখন অবশ‍্য সাধ খাওয়ার ব‍্যাপার বুঝতাম না। তালের আঁটির ভেতর প্রসাদ খাওয়া হত।

নলগাছের সাথে বোড় গাছের পাতায় মোড়া হত নিম, হলুদ, আদা, কেতকী পাতা, কালোমেঘ, বেলপাতা, সিঁদুরের এক  মিশ্রণ। একেই বলা হত বরোজ। এই বরোজই নল গাছে বাঁধা হয়। (অঞ্চল ভেদে পার্থক্য থাকতে পারে) আজ কংক্রিটের জঙ্গলে বসে সবুজ ক্ষেত, আলপথ, মেঠোসুরের গান খুউব মিস করি।

এরপরের উপাচার ছিল "আলুই খাওয়া"। এই প্রথাটা বিশেষত বাঁকুড়া মেদিনীপুর ইত‍্যাদি জায়গায় প্রচলিত। আলুই হল বিভিন্ন গাছ গাছড়ার শেকড় বা পাতা বেটে তৈরি ভেষজ খাদ‍্য বিশেষ। যা অবশ্যই বিধি মেনে বানানো হত। এই সময়টা আসলে আবহওয়া  পরিবর্তনের সময। ফলে রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে প্রবলভাবে। তাই এসবের হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসাবে কৃষিজীবী মানুষজন ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করত। আসলে নলসংক্রান্তি হল গ্রাম‍্য আচার উপাচারকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব চিন্তাভাবনার একটা বহিঃপ্রকাশ।

এ হল প্রাচীন ভাবধারার অবৈজ্ঞানিক ভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ভাবনা। 

এই নলসংক্রান্তি কোচবিহার, জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজন “লক্ষ্মীর ডাক” বলে থাকেন। আবার আসামে আশ্বিনের সংক্রান্তিতে শুরু হয় কাতি বিহু। আবার আজ থেকেই পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে জ্বালাই আকাশপ্রদীপ। 

নলসংক্রান্তি বা ডাক সংক্রান্তি যাই বলা হোক না কেন শুভ উদ্দেশ্যে পালিত উৎসবের পুণ‍্যতিথিতে শুধু বলি এই পৃথিবী করোনা মুক্ত হোক। বিষাদ কেটে যাক।পৃথিবী সুজলা সুফলা হোক। মানুষের কল‍্যাণ হোক।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours