উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক, কলকাতা:
আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষার দিন পেরিয়ে নীল আকাশে যেই পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা ভাসতে শুরু করে, পুজো পুজো রোদ সোনা ঝরায় যেই, যেই না হাওয়ার দোলায় সবুজ মাঠে সাদা কাশ দুলতে থাকে, অমনি বাঙালির মন ছেয়ে যায় চেনা চেনা পুজো পুজো অনুভূতিতে। আর পুজো বলতেই মনে ভাসে কিছু আজন্ম পরিচিত অনুষঙ্গ, যেমন পুজোর জামা, পুজোর জুতোর পাশাপাশি পূজাবার্ষিকী আর পুজোর গানও। তবে, এই সোশ্যালমিডিয়া শাসিত, ইউটিউব সর্বস্ব সময়ে বাঙালির পুজোর গানের দীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই হয়তো প্রশ্ন উঠবে। গ্রামোফোন কোম্পানি, মেগাফোন, কলম্বিয়ার ইপি, এল পি রেকর্ডে প্রকাশিত নতুন নতুন গান আর শারদ অর্ঘ্য বইয়ের জন্য রসিক গৌড়জনের অধীর অপেক্ষার দিনগুলো ইতিহাস হয়ে গেছে, তাও অনেক বছর হয়ে গেল। রেকর্ড গিয়ে ক্যাসেট, ক্যাসেট গিয়ে সিডি হয়ে এখন গান শুধু ফেসবুকে আর ইউটিউবে। ফোনের কোণের বাইরে তার দৌড় আর কতটুকুই বা? তাতে গান গণতান্ত্রিক হয়েছে। যে কেউ যে কোন ভাবে, ঘরে বসে বা স্টুডিওয়, সমাইক বা অমায়িক, শিখে বা না শিখে, কভার বা ডিসকভার যেকোনো ধরণের গানই শোনাতে পারেন। তবে দোকান সেই 'ফোনইভূষণ সঙ্গীতালয়', আর কান ও 'দো' ই। ফলে পুজোর জো থাক না থাক, গান জন্মাচ্ছে অবিরত আর হারিয়েও যাচ্ছে কিছু লাইক আর ভিউতুতো চরিতার্থতার পালা সাঙ্গ হলেই, কে জানে কোন্ কৃষ্ণগহ্বরে! তবু হীরক রাজার দেশেও থাকে গায়েন চরণদাস। অনন্ত অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তির পরেও প্রাণ থাকে, তাই গানও থাকে। ইউটিউবে কোনো নবীন কন্ঠে 'আবরণ সংস্করণে' বাজতে থাকে 'কত গান হারালাম...'। তবু 'নতুন গানের জন্মতিথি' আসেই, ফিরে ফিরে, নতুন করে পাব বলেই, হয়তো। সে পুজো আসুক আর নাই আসুক।
তবে, পুজোর গান বলতে পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন গানই যদি বোঝায়, তখন প্রশ্ন চেনা অভ্যাসের বাইরে গিয়ে সত্যিই নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে আপামর শ্রোতার কান, মন কতটা তৈরী থাকে। কেন নতুন সুর, নতুন কথার জন্য কিছু মানুষ সর্বস্ব পণ করে লড়ে যাওয়া সত্বেও একটা কথাই তোতাপাখির মত ফেরে তথাকথিত শ্রোতাদের মুখে, "আহা, আগেকার গান কেমন সহজেই মনে থেকে যেত, এখনো ভুলিনি। এখনকার গান একবার শোনার পরই আর মনে থাকেনা!" অনেকে বলেন, "আগের মত তেমন কথা তেমন সুর আর হয়না!" অথচ, যিনি ভাল কথার জন্য হা হুতাশ করেন, তিনি তাঁর ভাললাগা গানের ভাল ভাল কথার কতটুকু স্মৃতি থেকে বলতে পারবেন, তা অবশ্য বলা যায়না। যিনি বলেন এখনকার গান মনে থাকেনা তিনি ভেবে দেখেননা তাঁর মন বা সময়ের কতটুকু নতুন গান মন দিয়ে শোনার জন্য অবশিষ্ট আছে। বিগত কয়েক বছরে মৌলিক নন ফিল্মি বাংলা গান হিট হয়েছে এমন নজির খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। যা কিছুটা হলেও মানুষের মুখে ফিরেছে তা হলো সিনেমার গান, যার জনপ্রিয়তা কতটা তার কথা সুরের উৎকর্ষে আর কতটা ছায়াছবির বিশেষ দৃশ্যের অনুষঙ্গে আর প্রযোজকের ব্যয়বহুল প্রচারের সৌজন্যে তা বলা যায় কি? আবার যে শিল্পী নতুন গান রেকর্ড করছেন, নতুন গান শোনার জন্য মানুষকে অনুরোধ করছেন তিনিই টিভি চ্যানেলের ফোন ইন লাইভে বা এ মঞ্চে সে মঞ্চে গাইতে উঠে অতীতের প্রতি 'শ্রদ্ধা ভান' দেখিয়ে সেই সিলেবাস মানা জনমনোরঞ্জনী পথেই অর্থ বা সার্থকতার সন্ধান করছেন। তাহলে, সব মিলিয়ে পুজোয় নতুন গান এর ধারণাটা হয়তো অন্তঃসারশূন্য প্রথামাফিক আনুষ্ঠানিকতার মতোই হয়ে গেছে এই অস্থির অগভীর সমকালে। পুজো যেমন নিয়ম করে আসে চার দিনের সাজানো উৎসব হয়ে, ভাঙা বাড়ির চুন বালি খসা পলেস্তারায় রঙের প্রলেপের মতো, চিরাচরিত অভ্যাসে তেমন করেই নিয়ম মেনে আসে, ভাসে, ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় 'শৈবালেরই দল' গানগুলো। তাদের অকালপ্রয়াণে লেখা হয় শোকগাথা। কিন্তু বাঁচাবার চেষ্টা করেনা উদাসীন সমসময়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours