তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:
কলকাতাকে এ যাবৎ বহু সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কখনও সে দুঃস্বপ্নের নগরী, কখনও মিছিল নগরী, কখনও অস্বাস্থ্য ও দারিদ্রের বিচরণভূমি৷ সাহেবরা আবার কলকাতাকে নেটিভ কলিকাতা বলেও ডাকত৷ সাহেবরা বসবাস কালে কলকাতাকে আবার দুভাগে ভাগ করে বলতেন বাজার কলকাতা (বড়বাজার অঞ্চল)৷ আর টাউন কলকাতা (ডালহৌসি অঞ্চল)৷ বর্তমানে কলকাতাকে তো কতো না নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়৷ কখনও সে কল্লোলিনী তো কখনও তিলোত্তমা, কখনও মহানগর, কখনও সে উৎসব নগরী৷
কলকাতাকে যে নামেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন কলকাতা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের অন্ত নেই৷ আগেও যেমন কৌতুহল ছিল বর্তমানেও কিছু কম নয়৷ অথচ যে শহরকে নিয়ে মানুষের এতো কৌতুহল এতো অনু-সন্ধিৎসা সেই শহরের ইতিহাস রচনায় রয়ে গেছে বিরাট গলদ৷ এটা যে কতোটা অদূরদর্শিতার ফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
কলকাতা প্রেমী সাহেবদের লেখায় বর্ণিত যে সব তথ্যদি পাওয়া গেছে সেগুলি শিরধার্য্য করলে যা দাঁড়ায় — জবচার্ণক যে সময়কালে সুতানুটি ঘাটে এসে ভিড়লেন৷ তখন এই অঞ্চলের মানুষজনেরা ছিলেন নিতান্ত, অনগ্রসর, শিকারি, নিকারি, জেলে, বাগদী, অশিক্ষিত বর্বর ,অস্বাস্থ্যকর জলহাওয়া, হতশ্রী, জনজঙ্গল অধ্যুষিত একটি অঞ্চল৷ সে সব কথা মেনে নিলে বলতেই হয়, জবচার্ণক সুতানুটি এসে নামলেন সঙ্গে সঙ্গে জলহাওয়া পরিবর্তন হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ হয়ে উঠলো স্বাস্থ্যকর৷ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল দুর্গ, প্রাসাদ, ব্যারাক, গির্জা, পাকা বাড়ি৷
তিনি অশিক্ষিত বর্বর মানুষজনকে জাদুবলে শিক্ষিত করে উন্নত সমাজে চলার উপযোগী করে তুললেন৷ আর সেই সব তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আপামর কলকাতাবাসী ও তাঁদের আনুগত্য স্বীকার করে জবচার্ণক আসার দিনটিকে অর্থাৎ (১৬৯০ এর ২৪ শে আগষ্ট ) কলকাতার জন্ম সাল ধরে উৎসব প্রেমী মানুষ কলকাতার জন্মদিন পালন করতে শুরু করে দিলেন৷ কিন্তু হায়রে বাঙালী শুধু উৎসবকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অত্যন্ত খামখেয়ালি ভাবে কলকাতার জন্ম সাল ধরে উৎসব অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে সেটা একবার মাথায় আসলো না৷ অথচ প্রশাসনের জানা উচিত ছিল প্রাণী বা জীবের মতো কোন দেশ বা নগর জন্ম গ্রহণ করে না৷ নির্দিষ্ট কোন দিনে বা ক্ষণেও কোন নগর জন্মায় না৷ উদাহরণ স্বরূপ রোম সাম্রাজ্যের কথা বলা যেতেই পারে৷ Rome was not built in a day.
ঠিক তেমনি কলকাতাও নির্দিষ্ট কোন দিনে বা ক্ষণে জন্মায়নি৷ বরং জবচার্ণক কলকাতায় আসার (১৬৯০ সালের) বহু আগে থেকেই কলকাতা ছিল৷ এবং সেটা কয়েক শতক আগে থেকেই ছিল৷ তার বহু প্রমান আছে৷ সে সব তথ্যাদি যদি মিথ্যা হয় তবে আমাদের পৌরানিক গ্রন্থগুলি যেমন—
মনসামঙ্গল কাব্য, চন্ডীমঙ্গল কাব্য, আইনি আকবরি, (১৬৬০ সালের), Van Dun Brouk এর ম্যাপ মিথ্যা, গুরুমুখী ভাষায় রচিত গুরু নানকের জীবনী সব সব মিথ্যা৷
আসলে যারা জবচার্ণকের কলকাতা উক্তিটি সমর্থন করেন তারা অর্বাচীনের ধারনা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্যকে সমর্থন করেন ছাড়া আর কিছু না৷
কলকাতার সৃষ্টি কোন জাদুস্পর্শে হয়নি৷ তাছাড়া এটাও বিবেচনা করার বিষয় জবচার্ণক এবং তাঁর অনুগামীরা কি ভাবে দরিদ্র,অনুন্নত তিনটি গ্রামকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরে পরিনত করলেন৷ তিনি কেবল মাত্র কলকাতার কৈশোর কালকে দেখেছেন৷ জন্মদাতা তো ননই বরং তিনি কলকাতার শৈশব ও দেখেননি৷ এছাড়া তিনি কয়েকটি কুঠী ছাড়া আর কিছুই নির্মাণ করে যেতে পারেননি। (ক্রমশঃ)
তথ্য সূত্র
কলকাতার ইতিবৃত্ত —প্রাণকৃষ্ণ দত্ত।
কলিকাতা সেকালের ও একালের —হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা কালীক্ষেত্র কলিকাতা - - ভবানী রায় চৌধুরী।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours