সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:

                   বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের কাহিনী থেকে আমরা বিস্মৃতপ্রায় হলেও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ সেইসমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি আজও  আমাদের বিস্ময় উদ্রেকের সাথে সাথে রোমাঞ্চিত করে। আত্মত্যাগের এই বীরত্বপূর্ন সংগ্রামী ঘটনাবলী যেমন বাংলাদেশকে অন্য জাতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছে তেমনি বাঙালীর জাত্যাভিমানকেও মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এইরকম একজন আসামান্য বীর বাঙালী পরিচয় পাওয়া যায় যিনি তাঁর বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার বলে বারংবার মোগল আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। এই বিস্মৃতপ্রায়  দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধার নাম শংকর চক্রবর্তী, যিনি জন্মেছিলেন ষোড়শ শতকের শেষার্ধে হুগলী জেলার হরিপাল থানার অন্তর্গত দ্বারহাট্টার নিকটবর্তী প্রসাদপুর গ্রামে। একজন সাধারন মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ  করে স্বীয়বুদ্ধি ও যোগ্যতাগুণে তিনি বাংলাদেশের এক স্বাধীন রাজার প্রধান  পরামর্শদাতা ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে উন্নীত হয়েছিলেন ।

                 বাংলাদেশ তখন মোগল শাসকদের অধীন। দিকে দিকে স্থানীয় রাজাদের সাথে মোগলদের সংঘর্ষে যুদ্ধবিপর্যস্ত এই বাংলা অঞ্চল। দিল্লির শাসকেরা যদিও বাংলায় শাসনের জন্য প্রশাসক নিযুক্ত করতেন তথাপি শক্তিশালী হিন্দু ও মুসলিম নৃপতিরা রাজ্য  দখলের জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। তার ওপর ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুদের  আক্রমণ ও অত্যাচার এবং দাস ব্যবসা। এই অরাজকতার সুযোগে দিল্লি প্রেরিত প্রশাসকেরা সুযোগ বুঝে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করতেন। এমতাবস্থায় বাংলার জনগণেরা তখন শঙ্কিত ও অসহায়। নৈরাজ্যের দুর্বিপাকে সাধারনের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ। প্রসাদপুরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু ঐ এলাকার মানুষজনেরা সাহসী শংকরকে তাঁদের পরিত্রাতা মনে করত। কেননা সাধারন মানুষের  যেকোন  বিপদে তিনি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। শংকর তাঁর স্বীয়ক্ষমতা, সাহসী চরিত্র ও বুদ্ধিবলে প্রসাদপুর ও তৎসন্নিহত অঞ্চলে নিজস্ব বীর ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। এই কারনে শংকর চক্রবর্তী ‘সর্দার শংকর’ নামে সম্যক প্রসিদ্ধ ছিলেন।

               এই ঘনঘটার আবহে কায়স্থ কুলজাত শ্রীহরি গুহ ‘রাজা বিক্রমাদিত্য ’ উপাধি ধারণ করে যশোহরে নিজস্ব নতুন রাজ্য স্থাপনে উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। শংকরও এই দুরাবস্থার মুক্তি পেতে চাইছিলেন কোন স্বাধীন রাজার আশ্রয়ে চলে যেতে। তাই তিনি প্রসাদপুরের অধিবাসীদের পরামর্শ দিলেন নতুন যশোহর রাজ্যে বসতি স্থাপন করতে। এবং তিনি স্বয়ং সেখানে চলে গেলেন। যশোহরে তাদের সাদরে বাসস্থানের বন্দোবস্থ করা হয়েছিল। রাজা বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য ছিলেন  শংকরের মত সাহসী ও যোদ্ধা এবং শংকরের সমবয়সী। শংকরের ব্যক্তিত্ত্ব ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে  প্রতাপাদিত্য তাঁর সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যেকার এই বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের মুখ্য পরামর্শদাতা ছিলেন শংকর চক্রবর্তী। শুধু তাই নয় যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ করে মোগলশক্তির  বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুদ্ধকৌশল নির্ণয় করতে  শংকর প্রতাপাদিত্যকে সর্বদা পরামর্শ দিতেন।এই পরামর্শদান প্রতাপাদিত্যকে বহু লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে সাহায্য করেছিল।

               মোগল রাজত্বে বাংলায় শাসন করা বারোজন প্রধান নেতা বারভুঁইয়া নামে বিখ্যাত ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন  খিজিরপুরের ঈশা খাঁ, শ্রীপুরের দুই ভাই চাঁদ রায় ও কেদার রায় এবং  যশোহরের  প্রতাপাদিত্য। বারভুঁইয়াদের মধ্যে প্রতাপাদিত্যকেই দেশ রক্ষার জন্য মোগল বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছিল। আকবরের সৈন্যবাহিনী প্রতাপাদিত্যের হাতে  বারংবার পরাজিত হয়। মোগলশক্তিকে পরাস্ত করার মূল কারিগর ছিলেন সর্দার শংকর এবং  আরেক সেনাপতি সূর্যকান্ত গুহর কৌশলজনিত ভূমিকা। শাসনজনিতক্ষেত্রে সমস্ত ব্যবস্থাই শংকরের দক্ষ পরিচালনায় সংঘটিত হত। প্রতাপাদিত্য এই শংকরের পরামর্শে ধুমঘাটের মত সুরক্ষিত নগরীতে নিজের রাজ্য স্থাপন করেন। সেইসময় পর্তুগিজ জলদস্যুরা  গ্রামাঞ্চলে লুটপাটসহ দাসব্যবসার জন্য মানুষজনকে বন্দি করে ক্ষেতে শ্রমিক হিসাবে কাজের জন্য বিদেশে পাচারে করত। এদের ভয়ে সাধারন মানুষেরা সর্বদা তটস্থ হয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিতে আরম্ভ করেছিল। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতাপাদিত্য দুর্ধর্ষ জলদস্যু রাডারিককে পরাজিত করে তাকে নিজ নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে নিযুক্ত করেন। সাগরদ্বীপে প্রতাপাদিত্যের নৌ-বাহিনীর প্রধান অবস্থান ছিল। গড় মুকুন্দপুরে  প্রতাপাদিত্যের একটি দৃঢ় দুর্গ ও কুশলী নামক স্থানে কামান গোলাগুলি প্রস্তুত করার কারখানা ছিল। ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত্রে উল্লেখ আছে, প্রতাপাদিত্যের বাহান্ন হাজার ঢালী, একান্ন হাজার তীরন্দাজ ও প্রাসাদিহস্থ বহু সৈন্য ছিল।

                স্থল ও নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির পর শংকর এবার মন দিলেন মোগল শক্তির বিরূদ্ধে দেশের জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে। সেই সময় তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় জনগণদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয়। প্রতাপাদিত্যের পরামর্শদাতা হিসাবে শংকরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা মোগল শাসকদের চিন্তার কারন হয়ে উঠেছিল। শংকরকে দমানোর জন্য শাসকশক্তি বিভিন্ন উপায়ে সচেষ্ট থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। শংকর মোগলদের অভিসন্ধি জেনে রাজমহল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকলেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন এক দুঃস্থ ব্রাহ্মণকে আশ্রয় দিতে গিয়ে। সেই অপরাধে রাজমহলের শাসক শেরশাহ ব্রাহ্মণকে ছেড়ে দেবার জন্য শংকরকে আদেশ করেন। কিন্তু আদেশ অমান্য করায় শংকর শেরশাহের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত  করা হয়। কিন্তু চতুর শংকরকে বাগে আনা সহজ ছিল না। অল্প দিনের মধ্যেই শংকর কৌশল করে কারাগার হতে পলায়ন করেন। ক্রুদ্ধ শেরশাহ শংকরকে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ জারী করেন। কিন্তু প্রতাপাদিত্য সেই নির্দেশ সরাসরি প্রত্যাখান করেন। ফলস্বরূপ শেরশাহ অনমনীয় প্রতাপাদিত্যের বিরূদ্ধে যুদ্ধে   অবর্তীর্ণ হন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে প্রতাপাদিত্য শুধু শেরশাহকে পরাজিতই করলেন না রাজমহল ও পাটনা একসাথে দখল করে নিলেন। 

                   শেরশাহের পরাজয় বার্তা আকবরের কাছে ছিল বিরাট ধাক্কা। তাই তিনি প্রতাপাদিত্যের বিরূদ্ধে একের পর এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে প্রতিশোধের ইচ্ছাপূরন করতে চেয়েছিলেন। যদিও সেটা বাস্তবে সম্ভব হয়নি। শংকর ও প্রতাপাদিত্যের সাহসিকতা ও বীরত্বের দরুন তাঁদের সৈন্যরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। মোগল শাসকেরা মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল প্রতাপাদিত্যের বীরত্বের কাছে। সেসময় বাংলায় চরম অরাজক অবস্থা। পাঠানদের দৌরাত্ম্যে নাগরিকদের জীবন ওষ্ঠাগত। জাহাঙ্গীর পাঠানদের দৌরাত্ম্যের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে এবং প্রতাপাদিত্যের দমনের জন্য মানসিংহকে বাংলায় প্রেরণ করলেন। উত্তর চব্বিশ পরগণার  বসিরহাট ও মাতলা প্রভৃতি স্থানে এই ভয়াবহ যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। শংকর ও প্রধান সেনাপতি সূর্যকান্ত গুহ লড়াইয়ের ময়দানে বীরের মত যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু প্রতাপাদিত্য তার নিজের লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় রাজপুত সেনাপতি মানসিংহের হাতে পরাজিত হন। লোহার পিঞ্জরে বন্দি অবস্থায় প্রতাপাদিত্যকে দিল্লির পথে নিয়ে যাওয়ার সময় বারাণসীধামে  ১৬০৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

               যুদ্ধক্ষেত্রে শংকরকে মোগল সৈন্যরা  বন্দী করতে সক্ষম হয়নি। তিনি আত্মগোপন  করেছিলেন। প্রিয়তম বন্ধু  প্রতাপাদিত্যের  মৃত্যুর সংবাদে পরবর্তী সময়ে  তিনি ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়েন। বিবাগী অবস্থায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ও অর্থ দরিদ্র মানুষদের দান করে তিনি বারাসাতে চলে আসেন। এই বীর বাঙালী সন্তান বাকি জীবনটা সেখানেই অতিবাহিত করেন। এই বীর যোদ্ধার স্মৃতি আজ আমাদের অনেকেরই কাছে অজানা। মোগলদের বিরূদ্ধে তাঁর ও  প্রতাপাদিত্যের লড়াইয়ের কাহিনী বাঙালীর শৌর্য- বীর্য-কে এক অন্য মাত্রায় ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। শংকরের পূণ্যস্মৃতি বাঙালীর মনে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে কলকাতা কর্পোরেশনের উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার  কালীঘাটে একটি রাস্তার নামকরণ ‘সর্দার  শংকর’ রোড রাখা হয়েছে। স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রোথিত প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে – :

               The Councillors of the Corporation of Calcutta have been pleased to name this road to perpetuate the memory of Chakravarty Sankar (of Chattopadhyay family of Prosadpur, Hooghly, subsequently settled at Barasat) who was the comrade and Chief Commander to the last glorious and mighty king of Bengal, Maharaja Pratapaditya Rai of Jessore (Dhoomghat) in the 16th Century.     

তথ্যসূত্র:                                                            

১) হুগলী জেলার ইতিহাস ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ -- সুধীরকুমার মিত্র।                          

২) গৌড়ের ইতিহাস – রজনীকান্ত চক্রবর্তী।        

৩) প্রতাপাদিত্য চরিত - রামরাম বসু



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours