'শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' সারাটি রাত্রি এই সুরেলা তন্দ্রায় নিমগ্ন হইয়াছিলাম, রাত্রিদেবীর কন্দর্পকান্তিসম আশীষে। নিদ্রাসাগরের অতল হইতে দিনমণির সুগম্ভীর আগমন তাই কিঞ্চিৎ বিলম্বেই হইয়াছিল।
অতঃপর আধো ঘুম-আধো জাগরণের মধ্যেই তাহার একটানা সুর-লহরীর কদাপি ধীর, কদাপি দ্রুত লয়ে বর্ষণ-শব্দ কর্ণগোচর হইতেছিল। আলস্যজড়িত চক্ষু মেলিতে না মেলিতেই তাহার জলজস্বর স্নিগ্ধতার মোড়কে আবৃত হইয়া কর্ণে মধুবর্ষণ করিলো।
-"বর্ষণসিক্ত সু-সকাল"!
জানালার পানে চাহিয়া তাহার অবয়ব ক্রমে দৃষ্টিগোচর হইল। সমস্ত রজনী-ভোর অবিশ্রান্ত ধারায় ঝরিয়াও ক্ষান্ত হয় নাই। সারাদিনের ভারী প্রস্তুতির অঙ্গীকার লইয়া বৃষ্টি আমার জানালার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার বারিসিক্ত চোখে বার্তালাপের ইচ্ছা ব্যক্ত হইতেছে। পুরাতন সুহৃদকে দেখিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইলাম। প্রত্যুত্তর সম্ভাষণ করিয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলাম। সে মাথা নাড়িয়া মেঘগম্ভীর স্বরে জানাইলো তাহার মনঃকষ্টের কথা। সমব্যথী হইয়া কারণ জানিতে আগ্রহী হইলাম। সে কহিতে লাগিলো,
"সময় অপেক্ষা শক্তিশালী আর কি আছে? মানুষ বিশেষ এক সময়ই আমার প্রত্যাশা করে আবার বিশেষ এক সময়ই আমার আগমন তাহাদের কাছে অযাচিত। প্রাক শারোদৎসব লগ্নে এরূপ বর্ষিত হইতে আমারও কি ইচ্ছা হয়? ইহাতে না মেলে বর্ষার স্নিগ্ধ-স্নাত অভিব্যক্তি না শারদীয়ার কাঙ্খিত আমেজ অনুভূত হয়। কিন্তু আমি মানুষ নহি। প্রকৃতির বিধান লঙ্ঘন আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই মুহূর্তেই বিশেষ আবার মুহূর্তেই অপাংক্তেয় হইয়া পড়িয়াছি।"
বৃষ্টির এরূপ উপলদ্ধি অভিপ্রেত বটে। তাহা স্বীকার করিলাম। সে আমার আর একটু নিকটে আসিয়া নিম্ন-কোমল স্বরে কহিল , "তুমি ও তো এই মুহূর্তেরই স্বাদ আস্বাদন করো। ইহার জন্যই অন্তরের নিভৃতে যে প্রেম উদ্ভুত বেদনা-মাধুরীর রস নিঃশব্দে নিঃসৃত হইতেছে সে কি আমি জানি না?"
চমকিত হইলাম। বৃষ্টি কেমন করিয়া জানিলো?
সে অল্প হাসিয়া কহিল, "আশ্চর্যান্বিত হও কেন? তুমি তাহার জন্য বিশ্বসংসার ভুলিলেই কি বিশ্বসংসারও তোমায় ভুলিয়া যাইবে? তোমার যে নিভৃতচারী অনুভূতি সকলের অগোচর, তাহা যে আমার সম্পূর্ণরূপেই গোচর হয় তাহা কি ভুলিয়া যাইলে?"
নিজের ভুল বুঝিয়া নীরব হইয়া রহিলাম।
বৃষ্টি আমায় স্পর্শ করিয়া উদাসীন কন্ঠে বলিতে লাগিল, "ভালোবাসায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিচার আসে না। আসা অনুচিতও। তুমি তাহা বিশ্বাস করো। আমি ও করি। তুমি মুহূর্তাকাঙ্খী। তোমার হৃদয়ের অন্তঃপুরের নিভৃত প্রকোষ্ঠে যে অনুরণন হইয়া থাকে তাহার প্রতিফলন আমায় ও স্পর্শ করে। যে মুহূর্ত তাহার অন্যসঙ্গে নির্মিত হইয়াছে সেইসকল মুহূর্তরা তোমার স্বপ্নে বিচরণ করে। সেই মুহূর্তরা যখন তোমার শ্রুত হয় তুমি তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় অনিঃশেষ দৃষ্টিতে তাহাদের অবলোকন করো। হিংসা তুমি করো না। কারণ তাহা তোমার স্বভাববিরুদ্ধ।"
একটানা এতটা বলিয়া বৃষ্টি নীরব হইলো। অনন্য হইয়া শুনিতেছিলাম তাহার শব্দচারণ। কিছু একটা প্রত্যুত্তর করিতে গেলাম। কিন্তু শব্দ খুঁজিয়া পাইলাম না। নীরবতা সংক্রামক। বৃষ্টি পুনরায় বলিলো, "ইহা তো অস্বাভাবিক নহে। সংবেদনশীল মননে ইহাই স্বাভাবিক। প্রিয়ে, তাহার প্রতি তোমার অনুভূতি ব্যক্ত হইতে হইতে অব্যক্ত হইয়া উঠে। তুমি স্তব্ধ বিহ্বল হইয়া পড়ো। কিন্তু তোমার সেই অব্যক্ত অনুভূতি আমাদের নিকট আসিয়া স্পন্দিত হয়।"
ব্যাকুল হইয়া বলিলাম, "কিন্তু তাহাকে কি সত্যই ভালোবাসিতে পারিয়াছি ? আমার ক্ষুদ্র মননে তাহার সেই নিখাদ, অতলস্পর্শী সত্ত্বাকে কি সবটুকু দিয়া উপলদ্ধির সাধনা করিতে পারিয়াছি? পারিয়াছি কি তাহার সেই অতলান্তিক মহাসাগরতুল্য চক্ষুর সন্মুখে নিজেকে নিঃশর্ত সমর্পণ করিতে? বলিয়া দাও আমায়। তোমার অগোচর তো কিছুই নাই।"
বৃষ্টি আমার ওপর স্নিগ্ধ বারিসিঞ্চন করিয়া বলিলো, "নিজের অন্তরাত্মাকে প্রশ্ন করো। তোমার প্রশ্নই তোমার অনুভূতির সারবত্ত্বা প্রমাণ করিতেছে। তাহার সন্মুখে তোমার সমগ্র সত্ত্বা যে সলজ্জ ভঙ্গিমায় আত্মসমর্পণ করে তাহা আমা অপেক্ষা আর কে জানে? প্রিয়ে, তাহার ছায়া তোমার মনের প্রাচীরে পড়িয়া প্রতি প্রহরে, পলে, ক্ষণে, অনুক্ষণে যে সত্যের আশ্বাস, যে সুন্দরের প্রতিমূর্তি, যে সমর্পণের মাধুর্য, সর্বোপরি যে ভালোবাসার প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করিয়াছে তাহা যে একান্তই তোমার। পৃথিবী বক্ষে ঈশ্বরের আশীর্বাদতুল্য এর সুঘ্রাণ। তাহারও তোমার প্রতি ভালোবাসা অনাস্বাদিত, অনাঘ্রাত অমৃতকণার মতো। ইহা পরম প্রাপ্তি তোমার। একান্তভাবেই। এই সত্য উপলব্ধি করো। দেখিবে মন শান্ত হইবে।"
বৃষ্টির প্রস্থানের সময় হইয়াছে বুঝিলাম। যদিও জানি, সে সর্বদাই আমায় ঘিরিয়া অবস্থান করে। অদূর ভবিষ্যতেও করিবে। তথাপি আজ তাহাকে যাইতে দিতে ইচ্ছা করিতেছিল না। ইহা আমার নূতন অসুখ। মনের মানুষদের চোখের আড়াল করিতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু বৃষ্টি যে তাহার কর্ত্তব্য বন্ধনে বাঁধা। এইটুকু সময় পাইয়াছি ইহাকে এই অনেক। জিজ্ঞাসা করিলাম, "আবার কবে আলাপচারিতা হইবে?"
সে যাইতে যাইতে পিছন ফিরিয়া রহস্য মাখা কন্ঠে কহিয়া গেল,
"তোমার নিভৃত প্রকোষ্ঠের বেদনা-মাধুরী যেদিন অভিমানে মাখামাখি হইয়া উঠিবে, যেদিন সে তোমার সবটুকু জুড়িয়া আসিয়া অভিমানগাত্রে তাহার সুশিল্পিত অঙ্গুলি স্পর্শে তোমায় সলাজ বীণায় পরিণত করিবে, সেদিন আমাদের নিকট সঞ্চিত তোমার অব্যক্ত অনুভূতিকে অজানা সৌরভে কুসুমিত করিয়া তোমার নয়নে ব্যক্ত করিব। বিশ্বসংসারে শুধু সেই তখন তাহা দেখিতে পাইবে। আমি তখন তোমাদের আচ্ছাদন হইয়া থাকিব। আকাশ হইতে রামধনুর আলো আসিয়ে পড়িবে তোমার উপর। সে তখন ধীরে ধীরে তোমার চিবুক স্পর্শ করিয়া সেই শুভ আলোকে নিরীক্ষণ করিবে তোমার লজ্জিত স্মিত মুখ।"
চাহিয়া রহিলাম। আমার সমগ্র সত্ত্বা সেই প্রস্থান পথ জুড়িয়া চাহিয়া থাকিলো। আমার সর্ব অঙ্গ সেই স্বপ্নীল চিরাকাঙ্খিত দৃশ্যপটের কাল্পনিক অঙ্কণের মাধুর্যে পূর্ণতাকাঙ্খী হইয়া বরষার শেষতম বারি সিঞ্চনে সজল অধীর হইয়া রহিলো।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours