রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আজ বিশ্বকর্মা পূজো, দুর্গাপুর বিশ্বকর্মা নগরীর এক বিশেষ ঐতিহ্য ছিল এই দিনটাতে| আমরা যারা দুর্গাপুরের বিশ্বকর্মানগরীর বাসিন্দা তারা এই শহরটার কত পরিবর্তন দেখলাম| যারা ৪০-৬০এর দশকের মানুষ তারা তো দেখলেনই আবার আমরা যারা ৭০-৮০ এর দশকে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা তারাও দেখলাম একসময়ের ঝকঝকে বিশ্বকর্মা নগরী আজ মজা নদী বারোমাস| আমরা যখন ছোটো ছিলাম এই বিশ্বকর্মা পূজো ছিল দুর্গাপুর শিল্প তালুকের উৎসব মুখর দিন|

আমরা এম.এ.এম.সি (মাইনিং এন্ড মেসিনারি কর্পোরেশন) এর বাসিন্দা| আজকের এই দিনটাতে সকালে স্নান করে বাবার সাথে বাবার Deparment এর পূজোতে যেতাম| বাবা আমাকে বসিয়ে রেখে পূজোর কাজে লেগে যেতো| আবার পূজো হয়ে গেলে পাশাপাশি কয়েকটি Department ঘুরিয়ে নিয়ে আসতো| কত বড় বড় বিশ্বকর্মা ঠাকুর পূজো হতো| সেই সময় ঐ দিন কারখানা সকলের দর্শনের জন্য খোলা রাখা হতো বলে আমাদের অনেক আত্মীয়রা প্রত্যেক বছর কেউ না কেউ আসতো কারখানার ভিতরে ঢুকে দেখবে বলে|

ঐ দিনটাতে টাউনসিপ এবং তার বাইরেও সবাই বিকেল 3 টে থেকেই কারখানায় ঢুকতো, পূজো দেখতো,মেসিনগুলোর দিকে চেয়ে থাকতো| কত বড় বড় অটোমেটিক মেশিন যা রাশিয়ান প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরী হয়েছিল|

সেই সময় দেখেছি আমাদের বাসস্ট্যান্ডে যে রিক্সাওয়ালারা থাকত তারাও কত বড় করে পূজো করতো|

আমি তখন বেশ ছোটো ভগৎ সিং মোড়টা এখনকার মতো ছিল না, শুধু ৩-৪ টি দোকান ছিল-- একটা চা-এর দোকান, একটা মুরগী মাংসের দোকান,একটা সব্জি দোকান| C-Zone এর একটি Quarter এর ছাদে দাঁড়ালে দেখা যেত আমাদের M.A.M.C ছোট্ট টাউনসিপটা কী সুন্দর আলো ঝলমল করছে|

আমাদের B-1 Quarter এর ছাদ থেকে দেখা যেত ডিগ্রী (Govt College) কলেজের সামনে দিয়ে 8B, M.A.M.C র বাস আসছে-যাচ্ছে, এতটাই সব ফাঁকা ছিলো| আমি খুব ছোটো থাকতে দেখেছি 8B রুটের ডবল-ডেকার লাল রঙের বাসটা|

তারপর সেটা বন্ধ হয়ে গেলো|আমরা ২৫ পয়সা ভাড়া দিয়ে মিনি বাসে করে বিধান ইনস্টিটিউট যেতাম আর ১৫ পয়সা দিতাম  এমনি লাল S.B.S.T.C বাসে| সেটাও ধীরে ধীরে ১৯৯৬-৯৭ এর শেষের দিকে বন্ধ হয়ে গেলো|

এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপানউতোরে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের জৌলুস কমতে লাগলো| ২০০১-২০০৩ এর মধ্যে M.A.M.C, B.O.G.L, F.C.I প্রভৃতি আরও করখানা বন্ধ হয়ে গেলো| দুর্গাপুর শিল্পনগরী অন্ধকার পুরীতে পরিণত হয়ে গেলো| কত বড় বড় স্কুলগুলো সব বন্ধ হয়ে  গেলো| 

কিন্তু হ্যাঁ এরপর বিভিন্ন Private School,College,BigBazar,Shopping Mall,Hospital গড়ে উঠেছে কিন্তু আমাদের ছোটোবেলার সেই জৌলুস আর নেই| বর্তমানে DSP,ASP ও সবাই বেসরকারী করনের তালিকায় নাম উঠে গেছে|

বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার আবাসনগুলিতে কিছু কারখানার প্রাক্তন কর্মচারীরা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন,আর কিছু বাইরের থেকে লোকজন (বিভিন্ন ভাবে) এসে বসবাস করছে ফলে টাউনসিপের পুরোনো পরিবেশ, সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে|

আসলে শুকিয়ে যাওয়া গাছের গোড়ায় জল দিলেও কি সে আর জীবিত হয়? পাতা,ফুল হয়?---হয় না|

ঠিক তেমনই যে শহর একবার ঘুমিয়ে পরে তাকে আর জাগানো যায় না|


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours