সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে আদিম মানুষের একমাত্র নিরাপদ আস্তানা বা ঠাঁই বলতে ছিল গুহা। গুহায় বসবাসকারীরা বন্য প্রাণীকে মেরে প্রথম গুহায় বসবাস শুরু করেছিল। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে গুহা মানব হয়ে ওঠে। দেখতে গেলে প্রথম লেখার শুরু হয়েছিল এই গুহা থেকেই। অর্থাৎ এই গুহা কথাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট বড় বহু গুহা। এর মধ্যে কিছু কিছু উন্মুক্ত প্রকৃতির আবার কিছু কিছু বদ্ধ প্রকৃতির। পর্বতাবিষ্ট এই সকল গুহা গুলো এক একটি বহু প্রাচীন। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সব গুহা গুলো আবার ভয়ংকরও হয়। আজ ঠিক এইরকমই এক ভয়ংকর গুহা নিয়ে আমরা আলোচনা করব, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা হিসাবে পরিচিত।

কিছু বছর আগে পর্যন্তও মানুষ জানতেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুহার নাম হলো মালয়েশিয়ার ‘সারাওয়াক চেম্বার’। যে গুহাটি প্রায় ১০ লক্ষ ঘন ফুট এলাকা জুড়ে অবস্থিত রয়েছে। আবার পরবর্তীকালে এও জানা গিয়েছিল যে "মিয়াও রুম চেম্বার" নামে বিশ্বের বৃহত্তম গুহাটি যার আয়তন প্রায় এক কোটি ঘন মিটার সেটি চিনে অবস্থিত। কিন্তু সম্প্রতি সব জানাকেই নস্যাৎ করে পৃথিবীর বৃহত্তম গুহা হিসেবে যেটা সামনে এসেছে সেটির অবস্থান ভিয়েতনামে। যার আয়তন ৪ কোটি ১ লক্ষ ঘন মিটার। এখনো পর্যন্ত এটিকেই বিশ্বের বৃহত্তম গুহা হিসেবে মনে করা হচ্ছে । যার নাম ‘হ্যাং সন ডুং‘। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় "পাহাড়ি নদীর গুহা"। 

আনুমানিক কুড়ি থেকে পঞ্চাশ লাখ বছর আগে এই গুহার সৃষ্টি। সৃষ্টির সময় কালে ৩৫ লাখ বছরের তফাৎ থাকার কারণেই এই ধরনের গুহার সৃষ্টি প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে "সলিউশনাল কেভ" বলা হয়। এর কারণ জলে পাহাড়ের লাইম স্টোন বা  চুনা পাথর দ্রবীভূত হওয়ার ফলেই নাকি এ ধরনের গুহার সৃষ্টি হয়। সাধারণত বৃষ্টির জল বা নদীর জলের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। ভূপৃষ্ঠের মাটি চুইয়ে ভূগর্ভস্থ চুনা পাথরের স্তরে পৌঁছানোর আগে সেই জলে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড মিশ্রিত হওয়ায় সেই জলে তখন অম্লতার পরিমান বেড়ে যায়। যার ফলে চুনা পাথর সহজেই দ্রবীভূত হয়ে পাহাড়ের  অভ্যন্তরে এ ধরণের গুহার সৃষ্টি হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে লক্ষ লক্ষ বছর কেটে যায়।

১৯৯১ সালে ‘হো খানহ’ নামের এক ব্যক্তি এই গুহাটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। শোনা যায় হো খানহ নামক এই ব্যাক্তিটি জঙ্গল থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বৃষ্টির কবলে পরেন। তখন তিনি সেই বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে এই গুহার ভেতর আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু গুহার ভেতর থেকে বিভিন্ন শব্দ ও মেঘ বেরতে দেখে তিনি ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান।   ভিয়েতনামের ‘কোং বিন’ প্রদেশের, ‘বো টাচ’ জেলায় এই "হ্যাং সন ডুং" গুহার ভৌগলিক অবস্থান। তবে এই গুহাকে ঘিরে বেশ কিছু রহস্য আছে। এই গুহাটির মূলত ২টি প্রবেশ পথ রয়েছে। হ্যাং সন ডুং-এর সর্ব বৃহৎ কক্ষের উচ্চতা ২০০ মিটার এবং চওড়ায় ১৫০ মিটার, এর মোট আয়তন প্রায় ৫ কিলোমিটার। এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম গুহা রূপে পরিচিত। গবেষণায় দেখা গেছে এই গুহাটি আনুমানিক ৩৬০ মিলিয়ন বছর প্রাচীন কার্বোনিফেরাস যুগে সৃষ্ট। এই বৃহৎ গুহাটির দেওয়াল তৈরী হয়েছে চুনাপাথর থেকে। যার ভিতরে রয়েছে স্ট্যালাগমেইট নামক এক বিশেষ খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরী বহু প্রকান্ড স্তম্ভ যা গুহার ছাদ ও মেঝেকে সংযুক্ত করেছে।

২০০৯ সালে ব্রিটিশ গুহা গবেষণা সংগঠনের গুহাবিদরা হ্যাং সন ডুং গুহার গবেষণার ক্ষেত্রে পরিমাপ করতে পারলেও তারা এই গুহাটির শেষ খুঁজে পায়নি। আরো রহস্যের বিষয় হলো যে, এই গুহাটি মোট ১৫০টি গুহার সমন্বয়ে গঠিত। গবেষনার সময় এখানে বিষধর সাপ, বিছে, পোকা, বড় মাকড়সা সহ দেখা মেলে বহু বিচিত্র প্রানীর। যা স্বভাবতই গবেষকদের বিপদে ফেলে। এখানেই শেষ নয়, এই গুহার ভিতরে রয়েছে ছোট ছোট জলের ফোয়ারা। রয়েছে বহু সুরঙ্গ পথ যা অনুসরণ করলে সহজেই ভিয়েতনামের এক স্থান থেকে অন্যত্র যাওয়া সম্ভব। হ্যাং সন ডুং –র ভিতরে গেলে নীচের দিকে দেখতে পাওয়া যায় দীর্ঘ নদী যা থেকে গুহার ভিতরে তৈরী হয় মেঘ, আরও দেখা যায় একাধিক ঘন জঙ্গল ঘেরা পরিবেশ। যেখানে রয়েছে চেনা অচেনা বহু বৃক্ষাদি। সব মিলিয়ে এখানে থাকে গুহার নিজস্ব জলবায়ু যা বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ রূপে ভিন্ন। ২০০ ফুট উঁচু একটি ফ্লোস্টোন দেওয়ালের কাছে পৌঁছে তাঁদের রিসার্চ বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে গঠিত এই দেওয়াল বরাবর জল ২০০ ফুট নীচের দিকে নামছিল। পরে অবশ্য ২০১০ সালে ওই গুহাবিদরা আড়াআড়ি ভাবে এই গুহাটির শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন।

বিশালাকার এই গুহার দেওয়ালকে ‘গ্রেট ওয়াল অব ভিয়েতনাম’ বলা হয়।এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গুহা। যার দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার, উচ্চতা ৬৬০ ফুট এবং চওড়া ৪৯০ ফুট।

একে আড়াআড়ি ভাবে ভাগ করে দেখা গেছে যে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গুহা মালয়েশিয়ার "ডিয়ার কেভ"-এর চেয়েও আকারে বড়।

এই গুহার আকার এতটাই বড় যে, ৪০ তলা স্কাইস্ক্র্যাপার-সহ নিউ ইয়র্ক শহরের একটা ব্লককে এই গুহার মধ্য ফিট করা যাবে। বা কোনওরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান উড়ে যেতে পারে।

এত বড় গুহা হওয়া স্বত্বেও এই হ্যাং সন ডুং বিশ্বের সবচেয়ে বড় হওয়ার খেতাবটা হয়তো আর বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না বলেই মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বড় বড় গুহার খোঁজ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই কাজের সাথে জড়িতদের ধারনা অনুযায়ী দক্ষিণ আমেরিকার  আমাজন জঙ্গলের মধ্যে এই হ্যাং সন ডুং এর থেকেও বড় গুহা থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সারা বিশ্বের কাছে এই আবিষ্কার এখন শুধু  সময়ের অপেক্ষা।

তবে হ্যাং সন ডুং আবিষ্কারের চার বছর পর অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে এই গুহাটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ভিয়েতনামের আইন অনুযায়ী প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চলা পর্যটন মরসুমে, সর্বোচ্চ এক হাজার পর্যটক এই গুহাতে প্রবেশ করতে পারে। এখানকার অনন্য পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যই এ রকম সময় সীমা বেঁধে দিয়েছে ওখানকার সরকার। তবে, এই গুহা পরিদর্শনে মাথাপিছু তিন হাজার ডলারের মতো খরচ হয়। ইচ্ছে হলে সবাইমিলে একবার ঘুরে আসতে পারেন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours