সুরঞ্জন কর, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

বিনুর সময়টা মোটেই ভালো চলছে না I অবশ্য তার দায় ওকে নিজেকেই নিতে হবে I নিজের হঠকারিতায় আজ ওর এই অবস্থা I ঘটনাটা তাহলে একটু খুলেই বলি I বিনু, মানে বিনয় বিশ্বাস, আরে ওই গলির মোড়ে যে ওষুধের দোকান, ওই দোকানের মালিক চিত্তদার মেজো ছেলে I চিনতে পেরেছো ? আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই যে রোগা করে, পাতলা চেহারার ছেলেটা, চোখে চশমা, থুতনির কাছে একটু ছাগল দাড়ি, ওর কথাই বলছিI 

তোমরা ওকে কতটা চেনো ? কলেজ পাশ করে বাপের সাথে দোকান সামলাচ্ছে, একেবারে নির্ভেজাল খাঁটি ভদ্র ছেলে, কোনো সাতে পাঁচে নেই, তাইতো ? ঠিক বলেছো, ছেলেটা সত্যিই ভালো I তবে ওর যে আরও একটা পরিচয় আছে, সেটা জানো কি ? হুঁ হুঁ বাবা, যতই লুকিয়ে রাখো, এই শর্মার চোখে ঠিক পড়বে I আর পড়েছেও I শোনো তোমরা যারা জানোনা, তাদের বলে রাখি, বিনুর লেখা ছোট গল্প, তোমরা ফী হপ্তা মণিমেলা পত্রিকায় পড়ছো I ওখানে অবশ্য ও ছদ্মনাম ব্যবহার করে... মাকড়শা ছদ্মনামে আমাদের বিনুই লেখে I ভারী মিষ্টি লেখার হাত, ছোট ছোট গল্পগুলো যেন এক একটা ছবি I পত্রিকার সম্পাদক বেণীমাধব বাবু নিজে আমাকে বলেছেন বিনুর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল I ভালো কথা, এই ফাঁকে বোলে নি, একটু আধটু লেখালেখি আমিও করি আর সেই সূত্রেই বেণীমাধব বাবুর সাথে আলাপ আর ওখান  থেকেই  মাকড়সার রহস্য ফাঁসI

বেণীমাধব বাবু কড়া লোক I এ লাইনে বহু বছর হলো I একটা চাল টিপেই বুঝে ফেলেন হাঁড়ির হাল I আমার মতো নতুন লেখক ওনার আশেপাশে সহজে ঘেঁষতে পারেনা I সব লেখা আগে নিজে পড়েন, তারপর লেখা নির্বাচন I ওনার পছন্দ হওয়া বড্ডো কঠিন I এই আমারইতো একটা তেরো কিস্তির গল্প, ‘ ভয়ঙ্কর আফ্রিকা ‘, জমা পড়ে আছে ওনার কাছে I বললেন তো লেখা পড়ে ওনার ভালো লেগেছে, কিন্তু তবু ...কি যেন একটা নেই আমার লেখায় I উনি সরাসরি বাতিল করেননি, আবার ছাপবেন যে, সে আশাও দেননি I  বিনুর লেখার মধ্যে কিছু একটা উনি ঠিকই দেখেছিলেন। আর তার প্রমান তো মণিমেলার শেষ চোদ্দটা সংখ্যায় ছড়িয়ে আছে I মাকড়শা নামটাও নাকি ওনার মাথাতেই প্রথম এসেছিলো I সব ভালোই চলছিল বিনুর, কাল হলো কাজলদার সাথে ওর দেখা হয়েI

এই কাজলদা যে ঠিক কি করে কেউ জানে না I লেখার জগতের সাথে যোগাযোগ আছে বোঝা যায় আর এই সূত্রেই বেণীমাধব বাবুর অফিসে ওর অবাধ গতি I কানাঘুষোয় শুনেছি বাপের বিস্তর টাকা, সেই টাকা বই প্রকাশনার কাজে খাটায় I সেদিন মণিমেলার অফিস থেকে বেরোনোর মুখে বিনুর সাথে দেখা I পাকড়াও করে পাশের চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো I তখন দুপুর দো।কান প্রায় খালি I কাজলদা চায়ের কাপে একটা তৃপ্তি করে চুমুক দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিলো I খানিকক্ষণ চোখ বুজে কি যেন ভাবলো, তারপর মুখ খুললো …

'বুঝলে বিনয়, মানছি তোমার লেখার হাত ভালো, ছোট গল্পগুলো হচ্ছেও চমৎকার, কিন্তু ভায়া, এই ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকতে গেলে কিন্তু শুধু ছোট গল্পে পোষাবে না I আহা তুমিই বলোনা, কতজন লেখককে চেনো যাঁরা শুধু ছোট গল্পই লিখেছেন ? মাথায় আসছে না তো ? আছে, আছে, একেবারে যে নেই তা নয়, তবে তাঁরা সব বড়ো বড়ো লেখক I তাঁরাও দেখবে ছোট গল্পের পাশাপাশি অন্যন্য লেখাও লিখেছেন I তোমাকেও ভাবতে হবে কি করলে তোমার লেখার বৈচিত্র বাড়ে I'

'কিন্তু কাজলদা, আমি তো ছোট গল্পই লিখি I অন্য কিছু তো কখনো চেষ্টা করিনি, ভাবিওনি কখনো I'

' আরে ভাই ছোট গল্প কেমন জানো ? রাস্তায় তেলেভাজার দোকানে চপ ভাজে... কখনো দেখেছো খেয়াল করে ? বেসন মাখিয়ে গরম তেলে যেই না ছাড়লে, অমনি ছ্যাঁক করে একটা আওয়াজ, একটু তেল ছিটকে আসা, একটু বুড়বুড়ি কাটা ...ব্যাস শেষ...এবার বেসনের রং হলুদ থেকে লালচে হলেই তেল থেকে তুলে নিলে, গল্প শেষ I তোমার ছোট গল্প হলো এই রকমই I যখন পড়লে, তখন তখন একটা ভালোলাগার ভাব...ব্যাস ওই টুকুই....এক দিন পরে মনেই পড়বেনা কি পড়েছো আগের দিন I অথচ দেখো, ঢিমে আঁচে রান্না দেখেছো ? রান্না হচ্ছে তো হচ্ছেই, শেষ হওয়ার নাম নেই, অথচ কারো কিন্তু তার জন্য কোনো অভিযোগও নেই, সবাই ব্যগ্র হয়ে বসে আছে রান্না শেষ হওয়ার জন্য I ধারাবাহিক ডিটেকটিভ গল্প হল এই শ্রেণীর রান্নার সাথে তুলনীয় I  একটা করে কিস্তি শেষ হবে আর পাঠকের উৎকণ্ঠা বাড়বে I  পর্ব গুলো শেষ করাটা কিন্তু একটা আর্ট I এমন জায়গায় ছাড়বে, দেখবে লোকে অধৈর্য হয়ে পড়বে পরের পর্ব পড়ার জন্য I গল্পে টান থাকলে, তোমাকে আর খেই ধরিয়ে দিতে হবে না, পাঠক নিজের গরজেই আগের ঘটনা মনে রাখবে 'I

বিনুর চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা সরে যাচ্ছে I সত্যিই তো, ছোট গল্প কজনই বা মনে রাখবে I কিন্তু ও কি পারবে ডিটেকটিভ গল্প লিখতে?

কাজলদা যেন ওর মনের কথা শুনতে পেলেন I ' আরে কি ভাবছো এতো ? ডিটেকটিভ গল্পে আছে টা কি বোলো দেখি ? একটা বা দুটো খুন বা চুরি, তা তুমি লেখক, আগে থেকেই জেনে বসে আছো কে অপরাধী, তাকে তুরুপের তাসের মতো সারাক্ষন লুকিয়ে রাখা, গল্পের শেষে তোমার গোয়েন্দার হাত দিয়ে রহস্য উন্মোচন I ভেবে দেখো, যেটা তোমার কাছে কোনো রহস্যই না...হবে কি করে ? সে যে তোমারি সৃষ্টি...তাকে রসিয়ে রসিয়ে পেয়াঁজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে উদ্ঘাটন করা I এর বেশি আর কি আছে ডিটেকটিভ গল্পে ? প্রথমে ঠিক করে নাও রহস্য কি নিয়ে, গোয়েন্দার একটা লাগসই নাম দাও, ঘটনার পটভূমি ঠিক করো আর বেশ কিছু চরিত্র একসাথে জোগাড় করে পাঠককে প্রথম থেকেই ঘুলিয়ে দাও I আরো যদি সহজ করে ভাব, একটা সাদা পাতায় ঠিক মধ্যিখানে গোল চিহ্ন দিয়ে যে খুন হবে তার নাম লেখো I লিখলে? এবার তার চারিদিকে তোমার তৈরী করা চরিত্রগুলোর নাম লেখো, এবার তীর চিহ্ন দিয়ে নিহতের সাথে কার কি সম্পর্ক লিখে ফেলো I এবার তোমার কাজ হবে এক জন বাদে সবার স্বপক্ষে শক্তপোক্ত প্রমান জোগাড় করা যে তারা সব নিরপরাধ I বাকি রইলো অপরাধী, তাকে কেমন করে বেআব্রু করবে, সে তোমার ব্যাপার, মানে লেখার মুন্সিয়ানাI নাও নাও, শুরু করে দাও I একবার শুরু করো, দেখবে গল্প তরতর করে কেমন এগিয়ে যাবে '।  

চায়ের দোকান থেকে যে বিনু বেরোলো, সে এক অন্য বিনু I মনে মনে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তার গল্প ফাঁদা I এই কিছুদিন আগেই গোয়া ঘুরে এসেছে, গল্পটা ওখানেই ফেলবে ঠিক করেছে I গোয়েন্দার নাম ভেবেছে প্রলয়...বেশ একটা তেজিয়ান ভাব আছে নামের মধ্যে I প্রথম গল্পেই খুনোখুনি না করে চুরির কথাই ভেবেছে I বেশ কোনো এক বিজ্ঞান  সমাবেশ থেকে এক বৈজ্ঞানিকের ফর্মুলা চুরির কেস I সন্দেহ ভাজন সবাই প্রায় বিদেশী, আর শেষে চোর সাব্যস্ত হবে এক ধনকুবের মার্কিন নাগরিক, যার সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, সে শুধু চুরির উদ্দেশেই এসেছে I নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র, প্রথম গল্পেই কোনো বৈজ্ঞানিককে চোর সাজাতে বিনুর মন চাইলো না I

বাড়ি ফিরে বিনু প্রবল উৎসাহে খাতা নিয়ে বসলো I কাজলদার শেখানো ফর্মুলা মতো একটা সাদা পাতার মাঝখানে গোল দাগ দিয়ে তার মধ্যে লিখলো ' ফর্মুলা '। এর পর আটজন কাল্পনিক বৈজ্ঞনিকের নাম আর কাল্পনিক চোরের নাম ফর্মুলার চারদিকে লিখলো I হোটেলের ম্যানেজার, বেয়ারা, লোকাল থানার ওসি, এক জন রিপোর্টার...এই চরিত্রগুলো বাড়তি যোগ হলোI পাতার একদম ওপরে থাকলো প্রলয়ের নাম, অনেকটা দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে মা দুর্গার মূর্তির মাথায় মহাদেবের ছবির মতো। 

চুরির ঘটনাটা সুন্দর ভাবে লেখা হয়ে গেলো এক দিনের মধ্যেই, এই মুহূর্তে সবাই অপরাধী...এবার এক এক করে বাদ দেওয়ার পালা আর এখানে এসেই ঠোক্কর খেলো লেখা I অপরাধ ঘটিয়ে ফেলা এক জিনিস আর তার থেকে এক দল লোককে নিরপরাধ প্রমান করা...এ যেন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার I চুরির সময় আটজনকে আটরকম কাজে আটকে রাখতে হচ্ছে, তবেই না তারা নিরপরাধ প্রমান হবে! এর পর আছে হোটেলের লোকের উপস্থিতি আর শেষে যে চোর সাব্যস্ত হবে, সেই মার্কিন চোরের ভূমিকা I বিনু  একটা করে পাতা লেখে, পরমুহূর্তে সেটা ছিঁড়ে ফেলে ... না, না ..বড্ডো সহজ হয়ে যাচ্ছে সব কিছু...এ যেন প্রথম দানেই তুরুপের তাস বের করে ফেলার মতো I চোর যেন গল্পের প্রথমেই চোখের সামনে এসে পড়েছে I নাঃ, এ ভাবে হবে না, সব আবার নতুন করে ভাবতে হবে ...উফফ ..কাজলদা, তুমি যে কোথায় এনে ফেললে ..I 

বিনুর গল্প ধীর গতিতে এগোচ্ছে, মাকড়শা যেন তার জাল ধীরে ধীরে বিস্তার করছে I এখন বিনু একবেলা দোকান করে, বাকি সময় ঘর বন্ধ করে লেখে I এ সপ্তাহের ছোট গল্প জমা পড়েনি I বেণীমাধব বাবু খবর নিয়ে জেনেছেন বিনুর নতুন প্রচেষ্টার কথা I উনি ব্যবসায়ী মানুষ, বুঝেছেন যা তৈরী হচ্ছে তা আখেরে লাভ দেবে, বিনুকে ছোট গল্প নিয়ে আর তাগাদা করেননিI 

ভালো কথা, এ সপ্তাহ থেকে আমার গল্প 'ভয়ংকর আফ্রিকা' ছাপা শুরু হচ্ছে  মণিমেলায় I ওই বিনুর ছেড়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটা ভর্তি করতে হলো যে I  আফ্রিকার দুর্ভেদ্য জঙ্গলে অভিযান, পড়ে দেখো,  মনে হয় খারাপ লাগবে না।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours