সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

"বাচ্চা থেকে বুড়ো, যদি একবার হাতে পায়, রাংতা মোড়ানো জিনিসটি খুলে, প্রথমেই মুখে পুরতে চায়" আপনারা আমার এই লেখাটি পড়ে নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে আমি কোন জিনিসের কথা বলছি।

হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ওই জিনিসটির নাম "চকলেট" যা আমরা প্রত্যেকেই  কমবেশি সবাই-ই পছন্দ করি। তবে আর কি, চলুন, আজ আমরা এই চকলেটের মূল উপাদান ও তার পিছনে জড়িয়ে থাকা কিছু ইতিহাস সম্পর্কে কিছু কথা জানি।

আমরা সবাই জানি যে চকলেট তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে কোকো পাউডার। আর এই কোকো পাউডারটি আসে কোকো বা কফি থেকে।

দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন উপত্যকার এক বিশেষ উদ্ভিদ এই কোকো। যার বীজ থেকে তৈরী করা হয় এই চকলেট। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার আরও কয়েকটা দেশে প্রথম কোকোর চাষ শুরু হয়। এর পর এর বীজ আসে আফ্রিকায়। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্ট আর ঘানা অঞ্চলে বর্তমানে পৃথিবীর মোট কোকো চাহিদার ৭০% চাষ করে ওখানকার মানুষ জন। প্রায় ১.৮ মিলিয়ন আফ্রিকান শিশু যাদের শৈশবকে নষ্ট করে আপনার আমার সবার মুখেই তুলে দিচ্ছে এই চকলেট।

যেখানে শিশুশ্রম নিয়ে আজ গোটা বিশ্ব তোলপাড় সেখানে এই অঞ্চলে ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল কে যেন কার্যকর করাই হয়নি। তাই ছোট ছোট শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে তাদেরকে দিয়ে এই চাষের কাজটা চালানো হয়।

এই শিশু শ্রমিকদের মধ্যে এরকমই এক শিশু শ্রমিক আছে যার নাম "অ্যালি"। চলুন একটু দেখে নি তার জীবনযাত্রা কেমন ছিল। একমাথা কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো চুল আর মায়াবী চোখ দুটি নিয়ে রাতের অন্ধকারে আগুনের পাশে বসে  তার ঠাকুর্দার কাছে গল্প শুনতো এই ছোট্ট মেয়েটি। গল্পে তার ঠাকুর্দা তাকে একটা দৈত্যের কথা শোনাত যে নাকি উত্তরের জঙ্গলে থাকে।সে নাকি কোন বাচ্চাকে দেখলেই তার শরীরের রক্ত চুষে পুতুল বানিয়ে দেয়। ছোট্ট অ্যালি প্রতিদিনই এই গল্প শুনে ভয় পেতো। তার এই ভয় একদিন বাস্তবের রূপ নেয়। মাত্র ৮০ ডলারের বিনিময়ে সেদিন ছোট্ট অ্যালি বিক্রি হয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫ বছর।

প্রতিদিনই এভাবে হাজার হাজার বাচ্চা পাচার হয়ে যাচ্ছে মালি, বুরকিনা ফাসো ও অন্যান্য  প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ঘানা ও আইভরির কোকো ফার্মগুলিতে।এখানে স্কুল, কাজ, আর ডলারের লোভ দেখিয়ে ছোট ছোট শিশুদের তুলে আনা হয় রাস্তা থেকে।তারপর সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তাদেরকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয়। খিদে পেলে তাদের মুখের সামনে তুলে ধরা হয়, কেবল ভুট্টা সেদ্ধ আর কয়েকটা কলা। তাদের রাতে শোয়ার জন্য বন্দোবস্ত করা হয় একটা দরজা জানালা হীন কাঠের আস্তাবলে। শুধু তাই নয়,তাঁরা যাতে কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য তাদেরকে জানোয়ারের মতো পায়ে শেকল দিয়েও বেঁধে রাখা হতো। এর মধ্যে থেকে যারা ওই শেকল খুলে পালানোর চেষ্টা করতো তাদের ভাগ্যে জুটতো বেধড়ক মার। আর উপরি পাওনা হিসেবে জুটত গণধর্ষণ। মার খেয়ে বা ধর্ষণের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি মারা যায় তাহলে তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় নদীতে, নয়তো কুকুরের মুখের সামনে। ওখানকার ওই পশুর মতো মানুষ গুলোর শরীরে মায়া,মমতা ভালোবাসা বলতে কিছুই ছিল না। যা ছিল তা হ'লো শুধু নৃশংসতা আর রক্ত। যে রক্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে আপনার আমার ঘরের দামী ফ্রিজটাতে।

ভয় পেলেন? ঘেন্না লাগছে আমার এই কথাগুলো শুনে? ভাবছেন আমি আজেবাজে বকছি? হ্যাঁ, আপনাদের এই ভাবনাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা আপনারা কখনো ভেবেছেন আপনি শখ করে অথবা ছেলেমেয়েদের বায়নার জন্য বাজার থেকে যে চকলেট কিনে এনে তাদের মুখে তুলে দিচ্ছেন সেই চকলেটেরই গায়ে লেগে আছে ঐ সব নিরীহ ছোট ছোট শিশুদের গায়ের রক্ত! কখনো আপনার বাচ্চাটির মুখে লেগে থাকা ঐ বাদামি রং টাতে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন সত্যিই  ওই রংটাতে রক্ত লেগে আছে কিনা! তবে আমি নিশ্চিত আজকের পর থেকে আপনারা হয়তো কেউ কেউ আমার কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য একবার হলেও এই  কাজটি করে দেখবেন। কি ঠিক বললাম?

বিশ্ববিখ্যাত চকলেট কম্পানি গুলো যেমন  নেসলে, হার্সের্স, মার্স এখান থেকেই কোকো কেনে। প্রতিযোগিতার বাজারে কোকোর দাম কম রাখতে গেলে দরকার উৎপাদন খরচটাকে কমানো। তাই এখানে ওই সব ছোট ছোট শিশুদেরকে দিয়েই সেই কাজটা করানো হয়। তাছাড়া ৫ থেকে ১২ বছর বয়সের শ্রমিকদের মজুরিও দিতে হয় না।তার উপর তারা কোকো ফিল্ডের দূর্গম জায়গায় অনায়াসে যেতে পারে ।যেখানে একটু বড়রা ঢুকতে ভয় পায় পোকা, সাপ আর বিছের কামড়ের ভয়ে। সেখানে ওরা খুব সহজেই চলে যায়। তাতে অবশ্য মারাও যায় তারা। তাতে অবশ্য কার কি আসে যায় বলুন।সব মালিকই তো চায় বেশি বেশি মুনাফা অর্জন করতে। তাই তাদের মানবিকতার কোন প্রয়োজন হয় না। যে দেশে দারিদ্র্যতা থাকবে শিশু শ্রমিক থাকবে সে দেশের বড় বড় কম্পানি গুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে সস্তায় কোকো পাওয়ার জন্য। আর আমরাও মজে থাকবো বিদেশী চকলেটের স্বাদ আস্বাদন করার অপেক্ষায়।

আপনারা জানেন কিনা জানি না তবে আফ্রিকার কোকো ফার্ম গুলির শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৪০ শতাংশই হচ্ছে মেয়ে। যাদের বয়সন্ধি থেকে শুরু করে যৌবন, সবটাই কেটে যায় ওই কোকো বাগান গুলোতে।তারা কখনো তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কারণ এখানে ওরা সহজেই আসতে পারে কিন্তু বেরোনোটা ওদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। এখানকার কম্পানি গুলোর মালিক থেকে শুরু করে ঠিকাদার,সুপারভাইজার এমন কি পুলিশ ও তাদের যৌনতৃপ্তি খুঁজে নেয় ওই সব ছোট ছোট মেয়েদের শরীরে। যার ফলে কেউ কেউ মাত্র ১১ বছর বয়সেই গর্ভবতী হয়ে যায় আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে যৌনরোগও। ওই সব ছোট ছোট মেয়েদের শৈশবটা পচে গলে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তারা প্রত্যেকেই রাতে যে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্নে ভেসে আসে বিষাক্ত ও ভয়ঙ্কর সব পোকারা। যারা তাদের ওই চকলেটি হৃদয়টাকে খুবলে খুবলে খায় সারা রাত ধরে।

আর সকাল হলেই তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় মেছেট। এই মেছেট হলো এমনই একটা ছুঁড়ি যা চালালে একটি শিশুকে কয়েক মিনিটেই কিমা বানিয়ে দেয়া যেতে পারে। এখানকার কম্পানি গুলো এই মেছেট তুলে দেয় ওই সব ছোট ছোট শিশুদের হাতে।যাতে তারা কোকো বিন কেটে সেটাকে ঝাড়াই বাছাই করে বস্তায় পুড়ে আনতে পারে। এই কাজ করতে গিয়ে অবশ্য অনেক সময় শিশুরা তাদের হাতের আঙুল থেকে শুরু করে গা পর্যন্ত চিরে ফেলে। 

কি ভাবছেন এ আমরা কোন যুগে বাস করি!  এটা কোন যুগ? মধ্যযুগ? নাকি ঘোর কলি? 

আরে মশাই, এখন সব যুগ বদলে, এই হোয়াটস্অ্যাপ আর ফেসবুকের যুগে এই ক্রীতদাস প্রথা চলে আসছে। আর এই অন্ধকার থেকেই বেরিযে আসছে আপনার আমার সবার প্রিয় সেই ডার্ক চকলেট।

আমি জানি না ওই অ্যালি এখনো ওখান থেকে পালাতে পেরেছে কিনা! তবে বিশ্বাস করি হয়তো একদিন ঠিক পালিয়ে যাবে ওই অ্যালি।পালিয়ে যাবে সে অনেক দূরে যেখানে গিয়ে সে একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে। সব শেকল ভেঙে দিয়ে ছুটে বেড়াতে পারবে পেলের মতো বিখ্যাত ফুটবলার হয়ে। অথবা উন্মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে পারবে রঙ বেরঙের প্রজাপতি হয়ে। 

ও, ভালো কথা, আপনাদের আরো একটা কথা বলা হয়নি। ছোট থেকে অ্যালি যদিও এই কোকো সংগ্রহের কাজ করতো তবুও সেই কোকোর যে কি স্বাদ তা কিন্তু সে একবারও মুখে তুলে দেখে নি।তাই সে জানেও না চকলেটের স্বাদ কেমন হয়। তাঁর জীবনে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো কখনো কোন সান্তা এসে গিফ্ট বা চকলেট রেখে যায় নি। যা আপনার আমার ছেলে মেয়েদের জন্য আজও রেখে যায় ২৪শে ডিসেম্বরের রাতে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. প্রতিদিনই চুরি যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ আর চাপা পড়ছে শৈশব। দানবীয় এই অবিচারের প্রেক্ষিতে এই লেখা সময়ের সভ্যতার উপর চাবুক।
    সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর।

    ReplyDelete