সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

কিছু কিছু সৃষ্টি এমন হয়ে থাকে যে কখনো কখনো স্রষ্টাকেও তা ছাড়িয়ে যায়।এতে অবশ্য স্রষ্টারই সার্থকতা।শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা ও গুণের কদর করে না এমন মানুষ এই পৃথিবীতে মেলা ভার। এক এক শিল্পী তার নিজ নিজ গুণে এক এক ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তবে আমার মনে হয় যে শিল্পীরা তাদের মনের ভাবকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিখুঁত তুলির টান এঁকে দেন সাদা ক্যানভাসে, তারাই হচ্ছে আসল শিল্পী। আমি কিন্তু  কোনো শিল্পীকেই ছোট নজরে দেখছি না। প্রত্যেক শিল্পীকেই আমি সম্নান করি।

আমি কিন্তু ভালো আঁকতে পারি না। তবে কারো ভালো আঁকা দেখলেই জানি না আমি যেন কেমন থমকে দাঁড়াই। হয়তো আপনাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন যাদের ভাবনার সাথে আমার ভাবনার কিছুটা মিল খুঁজে পেলেও পেতে পারেন। আবার না ও পেতে পারেন।

তবে, এই আঁকার কথা বলতেই আজ এমন একজন ব্যক্তিত্বের নাম মনে পড়ে গেল, যে সেটা আপনাদের কাছে না প্রকাশ করে থাকতে পারছি না।

চলুন, আজ আমরা ওই বিখ্যাত শিল্পীর সম্পর্কে কিছু কথা জানি...

আমি যে শিল্পীর কথা আপনাদের বলতে যাচ্ছি তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গখ (উচ্চারণ গত ভাবে গখ কে আবার গগ ও বলা হয়)। ৩০শে মার্চ,১৮৫৩ সালে নেদারল্যান্ডের বেরাইড শহরের কাছে গ্রুট জুন্ডার্থ নামে একটি ছোট্ট শহরে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর ঠাকুরদার নামে তার নাম রাখা হয় ভিনসেন্ট ভ্যান গগ । ওই সময়ে শিশুর জন্মের পর এ ভাবেই তাদের ঠাকুরদার নামে নাম রাখা হতো। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোট থেকে আর পাঁচটা ছেলের মতোই তার বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকে তার যে আঁকার প্রতি আকর্ষণ ছিল তা কিন্তু নয়। যখন তার বয়স ২৭ বছর, তখন থেকে তার ছবি আঁকার পথ চলা শুরু। ছবি আঁকার জন্য তিনি অবশ্য কারো কাছে কখনো হাতেখড়ি নেন নি। তার কাছে যেন পুরো ব্যাপারটাই খুব সহজাত ছিল, তাই তিনি এই শিল্পকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। শুরুর দিকের ছবি গুলোতে তিনি এতটা রঙ ব্যবহার করতেন না যতটা রঙ তিনি তার পরবর্তী ছবিগুলোতে ব্যবহার করেছেন। সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা ও কঠিন বিষয়বস্তু উপস্থাপন করাই ছিল তার আঁকার উদ্দেশ্য। দারিদ্র্য ও গরিব জীবনযাপন এর কথাই ভ্যান গগের প্রতিটি ছবিতে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছিল। মূলত নিজের জীবনের বিভিন্ন দিককে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তার ক্যানভাসে। যদিও তার এই শিল্পকর্মের মেয়াদ খুব অল্প সময়ের (মাত্র দশ বছরের) তবুও তিনি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় নয়শো ছবি এবং এগারোশো স্কেচ ও লিথোগ্রাফ এঁকেছন। এই সময়কার ছবি গুলোতে তিনি খুব বেশী রঙ ব্যবহার করতেন।আর সেই কারণের জন্যই তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

অসংখ্য বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি তার জীবনের শেষ দু-বছরে তিনি এঁকেছিলেন। শোনা যায় গগের আঁকা ছবিতে নাকি কোন না কোন রহস্য লুকিয়ে থাকতো। সম্প্রতি তারই আঁকা একটি ছবির রহস্য উদঘাটন হয়েছে। এই রহস্যের ব্যাপারটা হয়তো স্বয়ং ভ্যান গগও জানতে পারেননি ওই ছবিটি আঁকতে গিয়ে। ফলে রহস্যটা রহস্যই রয়ে গেছে দীর্ঘ ১৩১ বছর ধরে।

ভাবছেন কি সেই রহস্য?

তাহলে আর দেরি কেন, চলুন আমরাও আজ জেনে নি তার এই রহস্যের কথা।

আসলে তার এই রহস্যের ব্যপারটা উদঘাটন করেছেন একজন পেইন্টিং কনজারভেটর (অঙ্কন তত্ত্বাবধায়ক), যার নাম "মেরি স্যাফার"। ১৮৮৯ সালে ভ্যান গগ অলিভ গাছের একটি সিরিজ এঁকেছিলেন। সেই সিরিজের একটি ছবিতেই প্রথম রহস্যের খোঁজ পান মেরি স্যাফার। আমেরিকার মিসৌরির নেলসন অ্যাটকিন্স মিউজিয়াম অব আর্ট এ রাখা "অলিভ ট্রি" ছবিগুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎই তিনি দেখতে পান ওই সিরিজের একটি ছবির মধ্যে পাতার মতো কিছু একটা জিনিস লেগে আছে। লাইভ সায়েন্স-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেরি জানান, প্রথমদিকে তিনি ভেবেছিলেন যেহেতু ওটা একটা গাছের ছবি তাই আটকে থাকা বস্তুটি হয়তো ওই গাছটির পাতা-ই হবে। কিন্তু তার সেই ভুলটা তখনই ভাঙে, যখন তিনি ওই ছবিটি মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখেন।

মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখতেই তিনি চমকে ওঠেন।তিনি মনে মনে ভাবলেন, তিনি যে ভাবনাটা ভাবছিলেন সেটি সম্পূর্ণ ভুল। ওটা আসলে কোনো পাতা নয়, ওটা হলো একটা ছোট্ট গঙ্গাফড়িং। যার মাথা ও পেটের নিচের অংশটি ছিল গায়েব। এবার প্রশ্ন হলো ওই পতঙ্গটি তাহলে ওখানে এল কি করে? যদিও বা গঙ্গাফড়িংটি উড়ে এসে ওই ক্যানভাসে বসেই থাকে তাহলে সেটা কেন শিল্পীর চোখে ধরা পড়ল না!? আর যদি চটচটে রঙের মধ্যে পতঙ্গটি আটকেই থাকে তাহলে কেন পতঙ্গটির বাঁচার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি ওই ছবিটিতে? এই সব নানান প্রশ্নই ভাবাচ্ছে ওই পেইন্টিং বিশেষজ্ঞকে।

১৮৫৫ সালে ভ্যান গগের লেখা একটি চিঠিকে উদ্ধৃত করে নেলসন-অ্যাটকিনসন মিউজিয়াম এর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তিনি নাকি প্রায় আউটডোরে যেতেন ছবি আঁকতে। হতে পারে সেরকমই কোন একটি জায়গায় ছবিটি আঁকার সময় ওই পতঙ্গটি উড়ে এসে পড়েছে শিল্পীর অলক্ষ্যে। তবে তিনি তার শিল্পীসুলভ মন নিয়ে যে পরবর্তী সময়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তার ও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি মূলত ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম সহ বিভিন্ন শহর গুলিতে ঘুরে বেড়াতেন। 

চিত্রকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে তিনি অবশ্য নানান কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বলা বাহুল্য কোনোটিতেই তিনি তার নিজের প্রতিভাকে সে ভাবে মেলে ধরতে পারেন নি। শোনা যায় তিনি নাকি স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে ধর্ম যাজক পর্যন্ত ছিলেন। 

গগের আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি ছবিটি হচ্ছে 'পোরট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট' যা তিনি ১৮৯০ সালে এঁকেছিলেন। এই ছবিটি  আঁকার ঠিক একশো বছর পর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে এই ছবিটিকে নিলামে তোলা হয়। তখন নিলামে এই ছবিটি বিক্রি হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে। যেটি কিনা পৃথিবীর সকল দামি ছবিগুলির মধ্যে  একটি। এত বিপুল পরিমাণ অর্থে ছবিটি বিক্রি হলেও ভিনসেন্টের জীবন কেটেছে অতি দরিদ্রতার মধ্যে দিয়েই। তার জীবদ্দশায় 'রেড ভাইনইয়ার্ড' নামে একটি ছবিই বিক্রি করতে পেরেছিলেন এই ভ্যান গগ।

জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে ভ্যান গগ মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি ও  ছিলেন। দীর্ঘস্থায়ী বিষন্নতা ও মানসিক অবসাদ কখনোই পিছু ছাড়েনি এই ভ্যান গগকে। আধুনিক মনোবিদরা মনে করেন যে তিনি স্কিৎজোফ্লেনিয়া, সিফিলিস, মৃগী রোগ ছাড়াও বাইপোলার ডিসঅর্ডারেও আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া অর্থাভাবে খাদ্যাভাবের জন্য বেশ দুর্বলও হয়ে পড়েছিলেন। মূলত শারীরিক ও মানসিক এই দুই ভাবেই বেশ অসুস্থ ছিলেন এই চিত্রশিল্পী। শোনা যায় অবসাদে তিনি নাকি তার একটি কান কেটে ফেলেছিলেন। পরে সেই কাটা কানটিকে একটা কাগজে মুড়ে তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এক পতিতা মহিলার কাছে। যার কাছে তিনি মাঝে মধ্যে যেতেন।

তার এই কুৎসিত মুখাকৃতি ও জীবনের প্রতি প্রবল অবসাদে তিনি ১৮৯০ সালের ২৭শে জুলাই নিজেই নিজের বুকে রিভলবার দিয়ে গুলি করে বসেন। যদিও সেই সময় এই ঘটনার কোন সাক্ষী ছিল না। শোনা যায় তিনি নাকি এক গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে এই গুলিটি চালান। গুলি চালানোর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ওই ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন। গুলি করার পর তিনি নিজেই হেঁটে হেঁটে বাড়ি পৌঁছেছিলেন। এমনকি তিনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময়েও  হেঁটে গিয়েছিলেন। মনে করা হয় ওই গুলিটি অভ্যন্তরীণ কোন অঙ্গকে ক্ষতি না করে পাঁজর ভেদ করে সম্ভবত মেরুদণ্ডতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। 

আবার্গ রাভাক্স হাসপাতালে দুজন চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু কোনো শল্যচিকিৎসক না থাকায় তার শরীর থেকে ওই গুলিটি বের করা সম্ভব হয়নি। পরদিন তার ভাই থিও ভ্যান গগ হাসপাতালে এসে তাকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হন। এদিকে ভ্যান গগের তখন  শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার দুদিন পর অর্থাৎ ২৯শে জুলাই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তখন তার বয়স মাত্র ৩৭ বছর। এত অল্প বয়সেই এমন একজন প্রতিভাবান শিল্পীর জীবন শেষ হয়ে গেল। সত্যিই... মানসিক অবসাদ ও বিষন্নতা একটা সুস্থ মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে ভাবুন।

ভ্যান গগের এর ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের মতে, ভ্যান গগের জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল 'ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস' যার ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'This sadness will last forever'।

যাই হোক, ভ্যান গগের সৃষ্টি 'অলিভ ট্রি' সিরিজের ছবিতে ওই গঙ্গাফড়িংকে নিয়ে যত জল্পনাই চলুক না কেন, মেরি স্যামের মতে ১৩১ বছর ধরে সেই রহস্যটা রহস্য হিসেবে থাকাটাই নাকি এখন দর্শকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বিষয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours