সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আমাদের পৃথিবীতো রূপ ও গুণে সমৃদ্ধ। তাই এই সাজানো গোছানো পৃথিবীর প্রাকৃতিক রূপ যে আমাদের কেবল মুগ্ধই করে তা নয় বরং আমাদের মনে নানান কৌতুহলও সৃষ্টি করে।সারা বিশ্ব জুড়ে এমন অনেক জায়গা আছে যা সত্যিই এখনো মানুষের কাছে অজানা। আর অজানা জিনিসকে নতুন করে জানতে কার না ভালো লাগে বলুন দেখি। এ পৃথিবীতে কি, জানার কোন শেষ আছে? আমার তো মনে হয় না তা আছে। আমি জানি, সব সৃষ্টির পিছনেই কিছু না কিছু রহস্য তো রয়েই থাকে। তবে রহস্যটা যদি প্রকৃতি প্রদত্ত হয় তা হলে তো কোন কথাই নেই।

এই প্রকৃতিতে তার সৃষ্টি এমন কিছু জায়গা আছে যেদিকে তাকিয়ে আমাদের শুধু বিস্মিত হয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আচ্ছা ভাবুন তো, এরকমই যদি কোন এক বিস্ময়কর নদীর কথা আজ আমরা জানি তবে কেমন হয়! নদীও যে একটা বিস্ময়ের জিনিস হতে পারে তা কি আপনারা আগে কখনো শুনেছেন?  

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী-নালা। প্রতিটি নদীই তার বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছু না কিছুতে বিখ্যাত। এরকমই একটি নদী দক্ষিণ আমেরিকায় কলম্বিয়ার ঠিক বুকের মাঝে 'সেরেনিয়া দে লা ম্যাকারেনা' প্রদেশে অবস্থিত। এই নদীটি একটি পাহাড়ি নদী।যার নাম "ক্রিস্টালস" বা "রামধনু নদী"। তবে এর সরকারি নাম 'কানো ক্রিস্টালস'। এই 'কানো' কথার অর্থ হলো 'চ্যানেল' আর ক্রিস্টাল কথার অর্থ হলো 'স্ফটিকো'। আশা করি এই নামটা হয়তো খুব কম লোকই শুনেছেন।

এই নদীটি পুরোটাই যেন রামধনুর মতো নানা রঙে আঁকা। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো এই পাঁচ রঙেই সমৃদ্ধ এই নদীটি। তাকে দেখলে মনে হয় প্রকৃতি যেন আপন খেয়ালে রঙ তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে নদীটির প্রতিটি স্রোতকে। এখানকার স্থানীয়রা বলেন এই নদী নাকি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। তাই কেউ কেউ তাকে আবার রাণী বলেও ডাকেন । এই নদীটির উৎপত্তি গুয়াবেরো নদী থেকে। তবে নানান রঙের বৈশিষ্ট্যটা কেবল ক্রিস্টালেরই।

এই নদীটির চারপাশে রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা। বোগটা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিনে মধ্য কলম্বিয়ার ঘন জঙ্গলের ভিতরে এই নদীটির অবস্থান। এই নদীটির দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ২০ মিটার।

এই নদীটি জুড়ে রয়েছে নানান রকমের পাথর আর তার উপর দিয়েই লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কানো ক্রিস্টালস। মাঝে মধ্যে এই নদীর চরায় গোলাকার গর্তও দেখা যায়। মূলত জুন মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই নদীতে নানা রঙের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। বসন্তের  শুরু থেকে এই নদীতে লাল রঙ ধরতে শুরু করে। পরে, এর ঢেউ ধীরে ধীরে গোলাপি আভায় ভরে যায়। বৃষ্টি নামলে এই নদীর জল আবার হালকা সবুজ বা হলুদ হয়ে পরে। পরে তা গোলাপি, বেগুনি ও হাল্কা নীল রঙে মিলে মিশে একাকার হয়। এ হেন নদীতে দাঁড়িয়ে একটা সেল্ফি না তুললে তো জীবনটাই বৃথা কি বলেন......

সেরেনিয়া দে লা ম্যাকারেনার অবস্থান গত বৈচিত্র অনেক। প্রায় বারো কোটি বছর আগে কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে এই স্থানটি সৃষ্টি হয়েছিল। এখানে মূলত তিন ধরনের ইকোসিস্টেম প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত: নদীর জলে ফ্লোরা ও ফেনার উপস্থিতি। দ্বিতীয়ত: আন্দিজ পার্বত্য এলাকার কঠিন পাললিক শিলা। তৃতীয়ত: আমাজন বৃষ্টিঅরণ্যের  জলবায়ুর বৈচিত্র। ম্যাকারেনার এই এলাকাকে মূলত হাইড্রোফাইটিক রেনফরেস্টও বলা হয়।

নদীর জলের এই রঙিন বৈচিত্রকে  নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন "ম্যাকারেনিয়া ক্ল্যাভিগেরা" নামে এক গুল্ম এর জন্য দায়ী। এই গুল্ম গুলি মূলত লাল রঙের হয়। নদীর তলদেশে পাথরের ফাঁকে জমে থাকা থোকা থোকা উদ্ভিদ সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে কখনো গাঢ় লাল, কখনো হলুদ, কখনো নীল, আবার  কখন বেগুনি রঙ ধারণ করে। নদীর পাদদেশে জন্মানো সবুজ গুল্ম ও শ্যাওলা থাকার কারণে অনেক জায়গায় সবুজ রঙও ধরে থাকে এই নদী। আর নদীর যে অংশে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সেখানে কালো শিলার কারণে জল অনেক বেশী নীল দেখায়। আবার, এই নদীর জলে ভাসমান বালুকণার কারণেও এর রঙের তারতম্য হয়ে থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

এই নদীকে ঘিরে প্রায় ১৬ মিলিয়ন হেক্টর পাহাড়ি এলাকায় নানা ধরনের বিপন্ন প্রাণীদের বাস। ৪২০ রকম প্রজাতির পাখি, ১০ রকমের উভচর, ৬৯ রকমের স্তন্যপায়ী ও ৪৩ রকমের সরীসৃপদের এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এই নদীটি 'সিয়েরা ডি লা ম্যাকারেনা ন্যাশনাল ন্যাচারাল' পার্কের একটি অংশ। এটা ১৯৭১ সালে গঠিত হয়। সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এখানকার সংরক্ষিত এলাকা। এই সময় নদীর জলে সাঁতার কাটার সুযোগ দেওয়া হয় পর্যটকদের, তবে কোন কীটনাশক স্প্রে বা সানস্ক্রিন লোশন লাগিয়ে এই নদীতে নামা যায় না। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কলম্বিয়ার সরকার ২০০ জনের বেশি পর্যটকদের একসাথে এখানে ঢুকতে অনুমতি দেন না, তাও আবার একসাথে ৭ জনের দল করে। সবসময় পর্যটকদের পদচারণায় যাতে বন ও নদীর পরিবেশ বিপর্যস্ত না হয় তাই এই ব্যবস্থা। তবে কেউ যদি চান এখানে রাত্রিবাস করতে, তারা করতেই পারেন ।কারণ তাদের জন্য রাত্রিযাপনের সুবন্দোবস্ত করে রেখেছে এখানকার সরকার ।

সম্ভবত স্বচ্ছ জল, চমৎকার স্রোত, পাথরের আঁকাবাঁকা ফাটলের প্রেমপূর্ণতা, নানান রঙের সমাহার ও আমাজনের ঘন সবুজ অরণ্য, সব মিলিয়েই পর্যটকরা ক্রিস্টালকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নদী বলে আখ্যা দিতে ভুল করেন নি।সারা বিশ্বে এই ক্রিস্টালের অপর নাম 'রিভার অফ ফাইব কালারস' বা 'লিকুইড রেইনবো'।

কোন সাধারণ মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে আপনার প্রিয় নদী কোনটি ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকেরই উত্তর হবে তার জন্মভূমির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির কথা। কারণ জন্মভূমির শিকড়ের টানটা যে সবার থেকে সবসময়ই আলাদা হয়ে থাকে । তাই তো আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবিকে, লেখককে তাদের বইতে কোন না কোন নদী উল্লেখ করতে দেখেছি।

আপনারা যারা পাঠক, তারা প্রত্যেকেই এই নদীটি সম্পর্কে জানার পর কি ভাবছেন! এমন এক মায়াবী নদীকে একবার চোখের দেখা দেখলে মন্দ  হয় না, কি তাই তো..........?? তবে আর দেরি কেন। ঝটপট প্লান করে ফেলুন যে যার মতো সময় বার করে। আমি বলে দিচ্ছি কি ভাবে যেতে হবে আপনাদের এই স্থানটিতে।

আপনারা কেউ যদি এই স্থানটিতে পৌঁছতে চান তাহলে প্রথমে আপনাদেরকে লা ম্যাকারেনার মেটা বিভাগে পৌঁছাতে হবে। সেখানে যেতে গেলে প্রথমে দিল্লি থেকে লন্ডন, তারপর লন্ডন থেকে ম্যাকারেনা যেতে পারেন। অথবা ব্রাজিল হয়েও বিমানে এখানে আসতে পারেন। সেখান থেকে ভিলাভিসেসিও থেকে ডিসি-৩ কার্গো ধরে অথবা বোগোটা থেকে প্রতি সপ্তাহে সোমবার, বৃহস্পতিবার ও শনিবার সরাসরি বিমানে করে ঐ জায়গায় যেতে পারবেন। এবার আপনারা ভাবুন আর ঠিক করুন কে কোন পথ দিয়ে যাবেন। তবে জীবনে একবার হলেও যদি এখানে না যেতে পারেন তাহলে আপনার জীবনের সার্থকতা কতটা পূর্ণ হবে তা বলা বড় মুশকিল।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours