পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ক্যালেন্ডার থেকে ঝুপ করে একটা দিন খসে গেল। বিদায় নিল ৩১ জুলাই ২০২০। সঙ্গে পঁচিশ বছরের একটি কালজয়ী স্মৃতিকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে প্রায় নীরবেই প্রবেশ করল অনাদিকালের  ব্ল্যাকহোল ভবিষ্যতে। 
 
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৫ সালের গতকালকের দিনেই দেশে প্রথম মোবাইল কল হয়েছিল। কথা বলেছিলেন জ্যোতি বসু এবং তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী সুখরাম। খবরের কাগজে এই ছোট্ট খবরটি আমায় নিয়ে গেল এক গৌরবময় অতীতে। ঘটনার ঠিক বছর চারেক পরে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে আমি মোবাইল ফোন হাতে পাই। বেশ বড়সর গাবদা গোছের মিৎশুবিসির একটা সেট। খানিকটা থান ইটের মতই ভারি। একটা এন্টেনা বের করা যেত সেই ফোনের থেকে। এখনকার নিরিখে অতি হাস্যকর একটি চেহারা। এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে ওই বয়সে, ওই সময়ে মোবাইল ব্যবহার করবার সৌভাগ্য হয়েছিল দুটি কারনে। প্রথমটি আমার সাংবাদিকতার পেশা, দ্বিতীয়টি দুর্গাপুর শহরে বদলি। কারন কলকাতা ছাড়া মোবাইল কেবল তখন দুর্গাপুর এবং শিলিগুড়ি শহরের কিছু অংশে চলত। সেই মোবাইল ফোনের খরচ ছিল সেই আমলে বেশ বেয়াড়া গোছের। কারও ফোন এলে অর্থাৎ ইনকামিং-এ এক মিনিটে সাত টাকা চল্লিশ পয়সা কাটত। আউটগোয়িং? এক মিনিটে প্রায় ১৬ টাকা। বুঝতেই পারছেন সেই ফোন ব্যবহার করা সাধারণের সাধ্য ছিল না। আমরাও কারও কল এলে তার নামটি দেখে নিয়ে ফোন কেটে দিতাম, পরে ল্যান্ডলাইন থেকে তাকে কল করে নেওয়া হত। 
তবে ওই ফোন হাতে পেয়ে আমার র‍্যালা ছিল দেখার মত। একে তো অতি কম বয়স, তার উপরে হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে সেই সময় মোবাইল। এমনকি আমার ইটিভিতেও তখন অন্যদের হাতে মোবাইল ফোন আসেনি। সে এক ভারি গৌরবময় ব্যাপার।  মোবাইল ফোন থাকায় অন্যদের কাছেও রীতিমত খাতির যত্ন পেতাম আমি। মনে আছে কয়েকজনের অনুরোধে মোবাইল দেখাতে আমায় বাঁকুড়ায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। রাজ্যের অন্য জেলাগুলিতে তখন সিংহভাগ মানুষ মোবাইল ফোনের নামই শোনেননি। আমার দেশের বাড়ি গোবরডাঙ্গাতেও মোবাইল সেটটি নিয়ে যেতে হয়েছিল সকলকে দেখাতে। 

এর পরে অবশ্য বদলেছে সময়, ধীরে ধীরে বদল হয়েছে মোবাইল সেটেরও। আমার সেই গৌরব অবশ্য খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। বছর দেড়েক পরে বিএসএনএল অন্য শহরেও মোবাইল পরিষেবা চালু করে। প্রথম কয়েক মাস বিনা পয়সায় এসএমএস পরিষেবা দিয়েছিল তারা। আমরা তা চুটিয়ে উপভোগও করেছিলাম।  মোবাইল সেট যখন রঙিন হল, তখনও  একটা স্যামসাং এর সেট কিনেছিলাম। বছর কুড়ির মধ্যেই আজ কোটি কোটি মোবাইল চারিদিকে। এক একজনের হাতে দুটি তিনটি করে সেট। কি বিপুল পরিবর্তন। মোবাইলও সেদিনের সেই সীমিত পরিসর ছেড়ে আজ প্রায় স্বয়ং সপূর্ণ একটি গ্যাজেট। 

জ্যোতি বসু আজ নেই, থাকলে দেখে যেতে পারতেন তার হাত ধরে তৈরি হওয়া একটা ইতিহাস কত দ্রুত পরিবর্তনশীল। খবরটি বেশ নস্টালজিক করে তুলল আমাকে। এত দিন ধরে মোবাইল ব্যবহার করছি সেটা ভেবেই অবাক হলাম। কখন যে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছে মোবাইল ফোন সেটা বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম বছর পঁচিশ পার।
এরপর শুধুই ইতিহাসের স্মৃতিচারণা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours