সুরঞ্জন কর, লেখক, দুর্গাপুর:

আজ ঘুম ভাঙলো দেরিতে,মন ভাল নেই, শরীর ঠিক লাগছে না,কাল সন্ধে থেকে কানের যন্ত্রনাটা খুব ভোগাচ্ছে, রাতে আরো বাড়লো… সে যে কি অসম্ভব কষ্ট...শেষরাতে ব্যাথাটা আপনা  থেকেই হঠাৎ কমে গেলো… তার পর কখন ঘুম এসেছে মনে নেই I জানলাটা খুলে বাইরে তাকাতে মনে হলো সব যেন বড়ো বেশি রকম চুপচাপ...বনধ নাকি আজ? নাঃ ঐতো গাড়ি চলছে....কোনো আওয়াজ নেই কেন? ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম...পাশের টেবিলে রাখা স্টিলের গ্লাস টা ঠুকলাম...আস্তে ...জোরে….নাঃ কোনো আওয়াজ নেই..I হাত মুঠো করে মাথায় ঠুকে দেখলাম…..কোথাও কিচ্ছু নেই.....সব আওয়াজ থেমে গ্যাছে I টেবিল এ গ্লাস ঠোকার আওয়াজে শিবুকাকা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ....ও কি বলছে ? আমি শুনতে পাচ্ছিনা কেন ?  চিৎকার করে উঠলাম ' কাকা আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না ...'I বড্ডো অবসন্ন লাগছে...আমি আবার শুয়ে পড়ি ...ভাবি আর কত ...আর কেন...বার বার আমিই কেন...I  
দিন গড়িয়ে বেলা হলো...শিবুকাকা বারকয়েক এসে ডেকে গ্যাছে, বুঝতে পারছি কি বলতে চায়, অনিচ্ছা নিয়ে উঠি...নিজের বাড়ি আজ যেন কত অন্যরকম লাগছে ...কাজের মাসি বাইরের গেট বন্ধ করে চলে যাচ্ছে....ওই দরজাটা বন্ধ হওয়ার একটা বিশেষ আওয়াজ আছে….আজও হচ্ছে....খালি আমিই শুনতে পাচ্ছি না I পাখি দেকছি কিন্তু আওয়াজ করছে না কেন ………
আস্তে আস্তে মন খারাপের ভাবটা কমতে থাকে..…উল্টে একটা জেদ ....চলো আরেকবার হয়ে যাক...দেখি কে জেতে....I
দিন কয়েক লাগলো এই নতুন অবস্থা মেনে নিতে, বাড়ি থেকে বেরোনো আগেই কমে গেছিলো, এবার ছেড়েই দেব ঠিক করলাম I শিবুকাকা বুদ্ধি করে কাল্যানদা খবর দিতেই সন্ধেবেলা সে হাজির I ভারী ভালো ছেলে এই কাল্যান, সুন্দর চেহারা, হাসিখুশি, মিশুকে....এক কথায় চমৎকার ছেলে...ব্যাংকে উঁচু পোস্টে চাকরি করে...সেখানেই আলাপ I আমার কাছে প্রায়ই আসে ...কতটা আমার জন্য আর কতটা জাহ্নবীর জন্য...জানি না....জাহ্নবী একতলার ভাড়াটের মেয়ে, ভারী মিষ্টি, এক মাথা কোঁকড়া চুল, টানা টানা চোখ...অমিয়র পাশে মানায় ভালো I
আমার অসুস্থতা ওদের আরেকটু কাছাকাছি এনে দিলো, দিনের বেলা জাহ্নবী বেশ কয়েকবার খবর নিয়ে যায় আর সারাদিন অফিস সামলে সন্ধের পর কাল্যান আসে...নিজেরাই  ডাক্তার বদ্দি এনে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে ....এর ভেতরে তিন তিন জন ডাক্তার দেখানো হয়ে গ্যাছে, গাদাখানেক ওষুধ, বেশ কিছু পরীক্ষা ...সব হলো...কিন্তু এখনো কিছু শুনতে পাচ্ছি না...I  
নাঃ এভাবে হবে না..আমাকেই কিছু করতে হবে...লিপ রিডিং শিখবো...আমি কথা তো বলতেই পারি, ঠোঁট নাড়া দেখে কি বলছে বুঝতে পারলেই হলো....আর সমস্যা থাকবে না I  জাহ্নবী কে বলতেই একটা বই জোগাড় করে আনলো....শুরু হলো আমার টিভিতে খবর 'দেখা'...ঘন্টার পর ঘন্টা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকা...ছেলেমেয়ে গুলো সারাদিন কত কথা বলে যাচ্ছে....আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি অন্তত একটু হলেও বুঝতে....মাঝে মাঝে মনে হয় যেন কিছু কথা ধরতে পারি....বেশিরভাগই অজানা অশ্রুত থেকে যায় I
বইটা আবার ভালো করে পড়ি ....সামনের বক্তার শুধু ঠোঁট নাড়া না....তার ভ্রু ভঙ্গি...চোখের অভিব্যক্তি....সব..সব দেখতে হবে I শিবুকাকা কাগজ পড়ে নিয়মিত কিন্তু তাকে জোরেজোরে এক ঘন্টা পড়তে বলাটা বড্ডো বাড়াবাড়ি হয়ে যায়....আমি সে চেষ্টাও করলাম ...বৃদ্ধ থেমে থেমে কষ্ট করে পড়ে যাচ্ছে ....আমার চোখের সামনে তোবড়ানো গাল, পাকা দাঁড়িগোঁফ ....না না এভাবে না ... আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না ...I জাহ্নবী ব্যাপারটা খেয়াল করে...ও কি বুঝলো জানি না...পাঠকের কাজটা নিজের হাতে তুলে নিলো.....I  
জাহ্নবী একমনে আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে...আমি তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে...ওর ঠোঁট ..নাক ...কপালের ওপর ঝুরো ঝুরো চুল....একদৃষ্টে চেয়ে আছি...মনে মনে চলে গেছি অনেক দূর...সেই শিলং পাহাড়ে....লাবণ্য বাগানে বসে পড়ছে, সামনে অমিত ....আমি আস্তে আস্তে ঠোঁটের ভাষা বুঝতে পারছি...I 
দিন কাটে, আমার নিস্তব্ধ জগৎ আস্তে আস্তে আবার শব্দে ভোরে ওঠে...এ শব্দ শুধু আমিই শুনতে পাই....টের পাই বড্ডো দুর্বল হয়ে পড়ছি...I 
আজও জাহ্নবী পড়ছে ...আমি শুনছি....সত্যি..মনে মনে শুনতে পাচ্ছি ওর কথা...বলে উঠি…. 'আর না' ....ভীষণ ইচ্ছে করে ওর ঠোঁট দুটো একটু ছুঁয়ে দেখতে...মনের মধ্যে শুনতে পাই ...' দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর...'I
কাল হাসপাতালে ভর্তি হবো… একটা অপারেশন হবে..…দেখা যাক তার পর কি হয় I আমি নিশ্চয়ই এসে শুনতে পাব...

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours