শাহনাজ পলি, সাংবাদিক, বাংলাদেশ:

ঘরে আর বন্দি থাকতে চাইছে না কোন শিশুই। বড্ড বিরক্ত। একে একে চারটি মাস শেষ হয়ে গেলেও করোনার প্রকোপ কমছে না।
মহামারী থেকে সুরক্ষা দিতে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে তাদের অভিভাবকরা।  
এই হাঁসফাঁশ জীবন তাদের আর সহ্য হচ্ছে না। বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করে ঠিকমতো খেতেও চায় না। নানান ধরনের খেলনাতেও তাদের মন টানে না। ঠিকমতো ঘুমাতে চায় না, খিনখিনে স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে পরিবারের এসব ক্ষুদে সদস্যরা।
রাজধানী ঢাকার এ চিত্র ঘরে ঘরেই। একেতো ঢাকার বাসাগুলো প্রায় একটার সঙ্গে একটা লাগানো। ছড়ানো ছিটানো কোন স্পেস নেই যে বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি বা ছুটোছুটি করবে। শিশুদের পুরো জগৎটাই চার দেয়ালে ঘেরা। ঘরবন্দি শিশুদের স্কুলের চেনা গণ্ডি, বন্ধু, শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। এই পরিস্থিতি ওদের মনোজগতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করছে।
মিরপুরের বাসিন্দা তাহমিনার ছেলে ফারহানকে নিয়ে প্রতিদিনই এমন অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। 
সারাদিন কোনও রকম ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিকেলে ছাদে নিয়ে ঘুরে আসেন। সেখানেও মানতে হয় সাবধানতা।
নিজেও মাস্ক ব্যবহার করেন, পরিবারের সকলেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। ৩ বছরের ছোট্ট ফারহানও এর ব্যতিক্রম নয়। মাস্ক অথবা টিস্যু দিয়ে নিজের মুখটা আটকে রাখার কায়দা শিখে ফেলেছে।
প্রতিদিন ছাদে যাওয়া তার জন্য মোটেও  আনন্দের না। বায়না ধরে ফুপির বাসায় যাবে, নানু বাড়ি যাবে নয়ত পার্কে।
একান্তই এসব না হলে বাড়ির মোড়ে দোকানে চিপস বা কোক কিনতে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। 
ফারহানের মত আয়ানও আর বন্দি থাকতে চায় না। 
জেলা শহর ঝিনাইদহে স্কুল শিক্ষক সাদিয়ার ৪ বছরের ছেলে আয়ান সবে স্কুল আসা যাওয়া শুরু করেছিল। নতুন স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, নতুন বই খাতা, পানির পট নিয়ে স্কুল তার প্রিয় হয়ে ওঠে অল্প দিনেই। তিন মাসেই তার বন্ধুও কয় গড়েনি। স্কুল বন্ধুর জন্য তার পরাণ পোড়ে। খুব ভোরে উঠে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সাদিয়া তার নিজের স্কুল ডিউটিতে যায়। আয়ানকে তার বাবা বা দাদাভাই ছুটির পর বাসায় নিয়ে আসে। ফেরার পথে আয়ান স্কুলের অনেক গল্প করে। বন্ধুদের সাথে টিফিন শেয়ার করে খায়। দোলনা চড়ে, স্লিপারে চড়ে। ভোরে স্কুলে যেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। এ কয়দিনে গানের বেশ কয়েক লাইন মুখস্ত করে ফেলেছে। মায়ের অবর্তমানে স্কুলেই তার প্রিয় জায়গা। কিন্তু হায়! সে সব আর তার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘুরে ফিরে দাদুর কাছে বায়নার অভাব নেই। বন্ধুকে দেখবে, খেলবে, আঁকা ঝাকা করবে। নানা কৌশল করে আয়ানকে বোঝাতে হয়। এ সময় ঘরের বাইওে বেরুনো যাবে না, মনমরা হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে আয়ান তাকিয়ে থাকে।
রাজধানীর কলাবাগানের রিদ্ধ আর স্নিদ্ধ, ওদের আচরণও ঠিক এমনটায়। তারা জমজ দুই ভাই। বয়স ৭ বছর। ইংলিশ মিডিয়াম একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র। তাদের বছর তিনেক স্কুল জীবনে এরকম লম্বা ছুটি ছিল না। স্কুল, পরীক্ষা, বাসায় টিচারের কাছে পড়তে বসা এসব নিয়ে দিনের সবটুকু সময় কেটে যেত। তখন একটু ফুরসতের জন্য আকুপাকু করত। কিন্তু ব্যস্ত জীবনটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে দুই ভাই দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছিল। কিন্তু হঠাৎই সব কিছু পাল্টে গেল। স্কুলের চেনা গণ্ডি ভুলতে বসেছে, বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে এক আধটু কথা হলেও শিক্ষকদের সাথে দেখা নেই অনেকদিন। এই পরিস্থিতি ওদের মনোজগতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করছে। ওদের মা রিনাও জমজ দুই ছেলেকে ঘরবন্দি করে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। ভিন্ন স্বাদের রান্না, ঠাকুরমার ঝুলির গল্প, আর মুভি দেখিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে তিনিও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। সংসার আর সন্তানদের আগলে রাখতে নিজের প্রতি অবহেলাটা দিন দিন বেড়েই যায়। তবু সন্তানদের বিষন্ন দিনগুলো নিয়ে চিন্তা করেন। তাদের হাসি খুশি রাখতে নানা কৌশলে পরিবেশ ভাল রাখার চেষ্টা করেন। 
কল্যানপুরের রিজভি হাসান ওহি এবং সুমাইয়া আমিনার শিশু উমাইনা। মাত্র ৭ মাস বয়স। বাবা মা দুজনেই চাকরিজীবী। দাদুর কোলে বড় হচ্ছে। শিশুর জন্মের তিন মাস পর থেকেই করোনার লকডাউনে তারা ঘরে বন্দি। ছোট্ট সোনামনিটাকে নিয়ে আদর আহ্লাদ ঘরের চার দেয়ালেই। উমাইনার জন্য তার দাদু অনলাইনে কেনাকাটা করে। এবারের ঈদের পোশাকও কেনা হয়েছে অনলাইনে। 
দুদিন পরই ঈদ। এ উপলক্ষে বাড়তি কোন আয়োজন নেই। কোনও বাড়িতে নেই ঈদের নতুন পোশাক কেনাকাটার ধুম বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া। যার যার ঘরে নিজেদের মতো উৎসব করবে।  
কোভিড-১৯ মহামারীতে সারা বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক দিনযাপনের যে বদল ঘটেছে, তার অন্যতম ভুক্তভোগী শিশুরাও। শিশুদের নিজস্ব জগৎ তৈরিতে পরিবারের পর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহজেই খুলছে বলে মনে হয় না। কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনভ্যস্ততায় শিশুদের কোলাহল থমকে গেছে। তাদের চেনা জগতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এই ধাক্কা কত বড় তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় অভিভাবকরা। তাদের আশঙ্কা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা নিজ থেকেই কেটে যাবে নাকি এর দীর্ঘমেয়াদি ছাপ তাদের উপর প্রভাব ফেলবে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর ২১ জুলাইয়ের হিসাব অনুসারে, কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের ১০৭টি দেশের স্কুল বন্ধ রয়েছে। এ মহামারীর প্রভাব পড়েছে ১০৬ কোটি ৬৮ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৫ জন শিক্ষার্থীর ওপর। এটা বিশ্বজুড়ে ঘরবন্দি থাকার নজিরবিহীন উদাহরণ হিসেবে দেখছে শিশু তহবিল ইউনিসেফ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours