ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বর্তমান সময়ে মানুষের চিন্তাধারা, চেতনা, আদর্শ পূর্বের চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে। ঘরে ঘরে মেয়েরা অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছে। পূর্বে নারী নির্যাতন ছিল কি না আমি জানি না। তবে এখন প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতন। কর্মক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত হয়রানিসহ নানান ধরনের নেতিবাচক খবর ভেসে আসে । বিশ্বজুড়ে নারীর অগ্রগতি ও মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে অনেক সভা সেমিনার চলছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা-নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি এখন সার্বজনীন। 
আমার জন্ম বাংলাদেশের এক অজগ্রামে। সে সময়ে গ্রামে কোন রাস্তা ছিল না। বিদ্যুৎ তো স্বপ্নের মতো। বছরের ৫ মাস শুকনা মৌসুম। আর বাকি ছিল বর্ষাকাল। শুকনা মৌসুমে মাঠে সবুজ ফসলের হুল্লোড় দেখে কেটে যেত। আর বর্ষা মৌসুমে মাঠ-ঘাট জলে তলিয়ে এক বিরাট সাগরে পরিনত হতো। সেখানে ছিল মাছেদের অবাধ বিচরণ। ফসল আর মাছ নিয়ে আমার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা। সময় পেরিয়ে একসময়  আমার মধ্যে লেখক সত্ত্বার জন্ম হলো। চারিদিকে শুধু নারী আন্দোলন। নারী অধিকার, নারী নির্যাতন এস নিয়ে সারাবছর কিছু মানুষ পত্রিকা-টিভিতে কথা বলেই যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে আমি খুব ভাবতে ভালবাসতাম। সব সময় উল্টো দিক থেকে ভাবনাটা শুরু হতো আমার। এটা আমি পেয়েছি আমার স্কুল শিক্ষক বাবার কাছ থেকে। মানুষ যা দেখে, আমি যেন সবসময় অন্য কিছু দেখি। নারী অধিকার নিয়ে এক প্রোগ্রাম দেখতে বসে প্রথম আমার মনে হলো, সংসারে তো সব অধিকার একজন নারীর হাতে। তাহলে বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার নিয়ে এত হৈচৈ কেন, কিসের জন্য? বিষয়টি আমাকে খুব ভাবনায় ফেলে দিলো। 
আমি নারীবাদী বা ফেমিনিযমে বিশ্বাসী নই। আমি আধুনিক নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। আমার অনেক মেয়ে বন্ধু আছে। যারা নিজেদের নারীবাদী বলে। তাই চলনে বলনে পুরুষের মতো হতে চায়। কথায় কথায় বলে তারা যদি এটা পারে তো আমি কেন পারবো না! এই কথার সাথে আমি একদম ভিন্নমত। আমি নারী হয়ে জন্মেছি বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেই। সাত জন্ম পূন্য করলে তবেই নারী জন্ম পাওয়া যায়। ঈশ্বর জন্ম থেকেই ছেলে এবং মেয়ে আলাদা দৈহিক গঠন দিয়েছেন। মেয়ে অর্থাৎ সৌন্দর্য্য। যদি ধর্মের কথা বলি, তাহলে বলতে হয়, দেবতারা নারীর শক্তি এবং সৌন্দর্য্যরে কাছে পরাজিত হয়েছে। বিশ্ব জগতেও এর উদাহরণ কম নেই। 
আমি বিশ্বের দিকে নয়, আমি আমার নিজের সংসারের দিকে তাকালাম। আমার ঠাকুরমা, আমার মা, আমি, আমার মেয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সবই নারী। আমার বাবা যখন কোন গুরুত্বপূর্ন কাজ করতেন, আমার ঠাকুর মা’কে জিজ্ঞেস করতেন। আমার ভাই কোন কিছু করতে হলে আমার মা’কে জিজ্ঞেস করে সিদ্ধান্ত নেয়। আমার ছেলে থাকলে নিশ্চয়ই একই ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করে কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। আমার মেয়ে যখন কোন ছেলে সন্তানের মা হবে, তখন নিশ্চয়ই ধারাবাহিকতা বজায় ধাকবে। অথবা আমার ঠাকুর দাদা ও নিশ্চয়ই তার মা’কে জিজ্ঞেস করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন! তাহলে সংসারে তো নারীই অধিকর্তা। যে সংসারের পুরুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন নারীর সিদ্ধান্তছাড়া। সেখানে সেই নারীই কিনা পুরুষের কাছে নিজের অধিকার চাইছে? বিষয়টি সত্যি আমার কাছে হাস্যকর মনে হলো। 
মানব সন্তানের জন্মহয় নারীর গর্ভে। সন্তান গর্ভে ধারন, জন্মদান এবং জন্মের পর সেই সন্তান প্রতিপালন করেন একজন নারী। একই নারীর গর্ভে একজন ছেলে সন্তান এবং একজন মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহন করে। কিন্তু জন্মের পর থেকে প্রথম দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে যায় মায়ের। তিনি জন্মের পর থেকে মেয়েকে মেয়ের মতো এবং ছেলেকে ছেলের মতো দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে বড় করে তোলেন। মেয়ে সন্তান হলে মা তার চুলটা একটু বড় করেন। মার্কেট থেকে দুটি ছোট্ট ক্লিপ নিয়ে আসেন। অথবা আরো একটু বড় হলে একটা পুতুল এনে তার হাতে দেন। আবার ছেলের জন্য একটা বল, গাড়ি, ব্যাট এসব কিনে এনে দেন। ছেলে এবং মেয়ের মূল বিভাজন শুরু হয় সংসারে মায়ের হাত ধরেই।
প্রায় পাশাপাশি বয়সে বেড়ে ওঠা একজন ছেলে এবং একজন মেয়ের মধ্যে মা পার্থক্য তৈরি করে দেন। ছেলে সন্তান যদি বড় হয় তাহলে সব সময় মা ছোট মেয়েকে বলে দেন, ও তোমার বড় ভাই। ও যা বলবে তা-ই শুনবে। আবার ছেলে যদি ছোট হয়, তাহলে মেয়েকে বলবে, ও তোমার ছোট ভাই ও একটু পাগলামী করবে, তোমাকে সহ্য করতে হবে। তাছাড়া কথায় আছে ছেলেরা মা ভক্ত হয়, আর মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। আমার যতদুর মনে হয়, মায়ের ভালবাসায় ছেলেরা একটু বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যুগে যুগে মানুষ শক্তিময়ী দেবী আরাধনা করেছেন। অর্থাৎ মা হচ্ছে জগত সংসারের শক্তির আধার। ছেলের যতরকম অন্যায় আবদার একমাত্র মা-ই পূরন করেন। সংসারে বাবাকে না জানিয়ে ছেলে সন্তানের জন্য মা যত অন্যায় আবদার মিটিয়েছেন, বোধ করি কোন মা তার মেয়ের জন্য তার এক বিন্দুও করেছেন কি না সন্দেহ।
ছেলে বড় হয়েছে, বিয়ে করায়ে একটি মেয়ে ঘরে তুলেছেন একজন মা। কোন ছেলের কি সাহস হবে, তার মাকে বলবে, মা আমি তোমার চেয়ে বউকে বেশি ভালবাসি। তাহলে আর রক্ষে নেই। হয় বিবাহ বিচ্ছেদ, না হয় অন্যত্র বসবাস। আবার একই দৃশ্যের ভিন্নচিত্র দেখতে পাই মেয়ের বিয়ে হলে। মেয়ের জামাই যদি তার মাকে ভালবাসে সেটা মোটেই সহ্য করবেন না মেয়ের মা। তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? একজন নারীর কাছে শুধুমাত্র তার নিজের ছেলে এবং মেয়ে ভাল, পৃথিবীর বাকি সবাই খারাপ। অর্থাৎ সমস্ত ঘটনার মূল চালিকা শক্তি সংসারের নারী। সংসারের সব রকম নিয়ম-কানুন, আচার-প্রথা মেয়েরাই যুগে যুগে তৈরি করে এসেছে। ছেলেরা না খেলে মেয়েদের খেতে নেই। এটা নিয়ম নিশ্চয়ই কোন ছেলে তৈরি করেনি। বা যত অন্ধ কুসংস্কার রয়েছে আমাদের মানব সমাজে তার কোনটাই কিন্তু ছেলেরা প্রনয়ন করেনি। যদি ধওে নেই ছেলের বউ প্রথম সংসারে পা রাখার পর সংসারের ছেলেরা আসে না স্ত্রী আচার করতে। এই বধূপ্রবেশের সাথে সাথে শাশুড়ি-ননদ-জা মিলে তাকে নিয়মের শিকল পরিয়ে দেয়। পরবর্তীতে এই নিয়মের বাইরে বাইরে পা রাখতে পারে না। ইতিহাস দেখলে আমারা সব বুঝতে পারবো। প্রতি পদে পদে একটি নারীর প্রথম এবং প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে নারী। সংসার যদি সমাজ হয় তাহলে চিত্র কি হতে পারে। আবার সমাজ, দেশ, বিশ্ব একই নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছে। আজকে পার্লামেন্টে যে ছেলেটি নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলছে। বা যে ছেলেটি নারী অধিকারের বিপক্ষে কথা বলছে। তারা প্রত্যেকেই একজন নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। পার্থক্য শুধু মায়ের শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রতিদিন সমাজে ধর্ষনের মতো ভয়াবহতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর পিছনেও কি একজন নারী নেই? অবশ্যই আছে। কোন মা যদি ছোটবেলা থেকে ছেলে সন্তানকে শিক্ষা দেন, মেয়েদের কি চোখে দেখতে হবে। সংসারে ছেলে সন্তান বড় হলে, মা তার মেয়ের ভাল-মন্দ অর্থাৎ শাসনের ভার দেন ছেলেটির উপর। সেই থেকে ছেলেটি জেনেই আসছে মেয়ে মানে হচ্ছে ছেলেদের উপর নির্ভরশীল। এটা আমাদের দেশের ৮০% পারিবারের চিত্র। আবার অনেক মা তার নিজের রাগ, জেদ বজায় রাখতে ছেলেকে হুকুম দেন, যে ভাবে হোক ওই মেয়েকে আমার বাড়ির বউ করে আনবি। এটা কি নারীর প্রতি নারীর সহিংসতা নয়?
পরিবার হচেছ সন্তানের প্রথম এবং প্রধান স্কুল। যেখান থেকে সে মগজ নয় মননে শিক্ষাগ্রহণ করে। স্কুল-কলেজে কাগজে কলমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আর পরিবারে মা তাকে শিক্ষা দেন, বড়দের সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার করতে হবে। ভাত খাবার আগে হাত ধুতে হয়। টয়লেট থেকে এসে হাত পরিস্কার করতে হয়। কথা কিভাবে বলতে হয়। সন্তানের বাচন ভঙ্গি, সৌজন্যতা, মাধুর্যতা এ সবই একজন মায়ের কাছ থেকে সন্তান শিক্ষা গ্রহন করে। পৃথিবীর কোথাও এসব শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নেই। এ জন্যই নেপলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেবো’। এখানে শিক্ষিত বলতে বড় বড় ডিগ্রি নয়। শিক্ষিত বলতে একজন আদর্শ মা কে বলা হয়েছে। যে মা তার সন্তানকে সু-নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলবে সুন্দর পৃথিবীর জন্য।
পৃথিবীতে হয়তো এখন এই আদর্শ মায়ের বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই দেখে, মা নিজের কাজের সুবিধার্থে ৬ মাসের বাচ্চার সামনে ইউটিউব থেকে কার্টুন বের করে দিচ্ছে! তিনি নিজেই জানেন না, জেনে শুনে এই মা তার সন্তানের হাতে ড্রাগ তুলে দিচ্ছেন। একবার ড্রাগ গ্রহনে যে পরিমান ব্রেইনে ইফেক্ট হয়, তার চেয়ে দ্বিগুন বেশি ইফেক্ট হয় একটি কার্টুন দেখলে। প্রায় সব মা-ই এখন তাদের বাচ্চাদের হাতে ইউটিউব তুলে দিচ্ছেন। অনেকে নিজের সন্তানের জন্য গর্ব করছেন। কারন তার সন্তান এখনো অক্ষর চেনে না অথচ ইউটিউব থেকে পছন্দের ভিডিও বের করতে পারে। এটা কতোটা যুক্তযুক্ত আমি ঠিক বুঝি না। তবে এতক্ষন যা লিখেছি এর কোথাও কি একজন পুরুষের ভুমিকা আছে? তাহলে নারী নিজেই নিজের অধিকার ক্ষুন্ন করছে প্রতিমূহুর্তে। আমি চাইবো পৃথিবীর সকল মা আদর্শ মা হোক তাহলে সকল নারীর মুক্তি মিলবে। আপনি একজন ভাল মা হোন, সমাজ পাল্টে যেতে বাধ্য।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours