ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। বৈশ্বয়িক করোনা মানুষকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে অভাব কাকে বলে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। প্রতিদিনই আসছে কর্মহারানোর দুঃসংবাদ। প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল, মানুষ গৃহবন্দী। নিত্য আয়ের পথ বন্ধ হলেও, সংসার চালাতে হচ্ছে। হিমসিম খাচ্ছে অনেক পরিবার। ছন্দে চলমান অনেক পরিবার হয়ে পড়ছে ছন্দহীন। দেখা দিয়েছে হতাশা, মানসিক রোগ, আত্মহত্যার মতো ঘটনা।
করোনা না আসলে জানাই যেত না, মানুষের জীবন যাত্রা কোন গতিতে চলছিল। অধিকাংশ পরিবারই নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। অথচ করোনার আগেও তাদের দেখে বোঝাই যায়নি। মানুষ আসলে নিজেদের শো-পিস হিসাবে রাখে। ব্যাংক ব্যালান্স রাখার সময় কোথায়? যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খাওয়ার চিন্তাই করেনি। অধিকাংশ পরিবারই মাসের প্রথমে মাইনে পেয়ে বেশ উচ্চবিত্ত চিন্তাভাবনা নিয়ে চলাফেরা করে। তারপর ১৫ তারিখ আসতেই মাইনে শেষ। বাকি ১৫ দিন ধার, বাকি করেই দিন কাটায়। পরের মাসে মাইনে পেয়ে প্রথমেই সেই ধার, বাকি পরিশোধ করা আর সাংসারিক কেনাকাটা করতেই আবার সেই ধার, বাকির দিকে চলে যায়।
মানুষ তার দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই সঞ্চয় করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ তার চাহিদার সাথেই পেরে ওঠে না। তাই সঞ্চয় এখন তাদের কাছে বিলাসিতা। আর হবে না-ই বা কেন? নব্বই দশকে যেটা ছিল ঠাটবাট পরবর্তীতে সেটা হয়েছে মৌলিক চাহিদা। যেমন ফ্রিজ, ডিস, মোবাইল ফোন, ইংরেজি মিডিয়ামে বাচ্চা পড়ানো। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন দিবস পালন। যেমন ফাদার’স ডে, মাদার’স ডে, ভ্যালেন্টাইন’স ডে, বার্থডে, ফ্রেন্ডস ডে, ম্যারেজ ডে। শুধু ডে করেই তো বাঙালী বসে নেই। এই ডে উদযাপন করতে কতো খরচ করতে হয়, সে খোঁজ তো কেউ রাখে না। প্রত্যেক ডে উপলক্ষ্যে অবশ্যই নতুন পোশাক শুধু তা-ই নয়। পোশাকের রং পর্যন্ত নির্ধারন করা হয়ে থাকে।
বাঙালীর পহেলা বৈশাখ ছিল যথারীতি ঘরোয়া পার্বন। এখন হয়ে গেছে জাতীয় উৎসব। তাতে নতুন পোশাক, দামি ইলিশ না খেলে সোসাইটিতে মাথা কাটা যাবে যে।
আগে ডিম রান্না করে বাড়ির সদস্যরা মিলে অর্ধেক করে ডিম খাওয়া হতো। কিন্তু এখন অর্ধেক ডিম রান্না করাটা যেন লজ্জার বিষয়। আগে মুরগী খাওয়া হতো মাসে অন্তত ২/১ বার। অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বা ঘরে কোন অতিথি এলে। আর এখন বিকাল হলে ছেলে মেয়ে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে খাওয়া যেন নিত্য রুটিন। আগে রিচফুড খেলে একটু আধটু কোল্ডড্রিংস খেতো। এখন এগুলো ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন ঘরের বাজার করতে গেলে তেল, লবন, হলুদের মতো এটা একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হয়ে গেছে। আগে বাচ্চাদের পোশাক চাহিদা ছিল খুবই কম। বর্তমানে সে চাহিদা এসে ঠেকেছে ট্রেন্ড হিসাবে। টেলিভিশনের সিরিয়াল ঠিক করে দেয় কোন ড্রেসটা এখন ট্রেন্ড, কোন সানগ্লাস, ঘড়ি, ব্যাগ, গয়না, শাড়ি পর্যন্ত। সময়ের সাথে এসব না বদলানো যেন মান্ধাতা আমলে বাস করার সামিল। শুধু তাই নয়, রোগের চিকিৎসক বা হাসপাতালও বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ ক্রেডিট নিয়ে বলে, আমি ব্যাংককে, সিঙ্গাপুরে নিদানপক্ষে চেন্নাই ব্যঙ্গালুরু না বললে যেন সমাজে সম্মানই থাকে না।
ওই সময়ে যে সরকারী কর্মচারির বেতন ছিল ২৫০০ টাকা আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০/২৫ হাজার টাকা। চালের দাম বেড়ে ১০ টাকা থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। কিন্তু চাহিদা বেড়েছে ১০ গুন। দৈনন্দিন জীবনে শুধু চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে। চাহিদা হয়েছে বহুমুখী কিন্তু ইনকামের পথ একমুখি হয়ে আছে। যার কারণে মানুষ আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে হিমসিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই আগ্রাসন চাহিদা মানুষকে অনৈতিক কাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের সকলের সুখের কথা চিন্তা করে কেউ কেই রাত দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কেউ কেউ অল্প সময়ে বেশি আয়ের রাস্তা খুঁজতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে অসৎ কাজে। সংসারে চাহিদা যত বাড়বে, অফিসে ঘুষ বাণিজ্য তত বেড়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। সকলে সমান না।
অনেকে সংসারের কর্তা অন্য সদস্যদের কাছে নিজেকে বড় করতে বা নিজের সম্মান ধরে রাখতে একটু একটু করে খারাপের পথে পা বাড়াতে থাকে। আবার অনেক পরিবারের কর্তা অনৈকিক কাজে রাজি না হয়ে সৎ পথে চলার চেষ্টা করে। এতে প্রবলেম হচ্ছে অনেক। কত্রী যদি উচ্চবিলাসী হয়ে থাকেন, তাহলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন বিবাহ বিচ্ছেদ করে। কখনো কখনো সন্তানরা তাদের প্রয়োজন না মিটাতে পেরে বেছে নিচ্ছে অন্ধকার জগৎ। কেউ কেউ মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ দেহব্যবসা বা অনৈতিক আরো অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে নিজের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছে। মোট কথা নীতি বিসর্জন যাক, তবু চাহিদা মেটাতে হবে।
প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তান অনেক আদরের। প্রত্যেকেই তাদের সন্তানের স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করতে চায়। একটা কথা চিন্তা করুন, কোন দিন যদি আপনার অপকর্ম আপনার সন্তানের সামনে ফাঁস হয়ে যায়। সেদিন আপনার সন্তানের সামনে আপনি কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবেন। তাই আপনার সন্তানকে ছোট বেলা থেকে আপনার সামর্থ্য বোঝানোর চেষ্টা করুন। অযথা মিথ্যা সাম্রাজ্যে তাকে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাবেন না। একজন সৎ বাবা-মায়ের সন্তান সব সময় সৎ হয়। আপনাকে দেখেই আপনার সন্তান সৎ হতে উৎসাহী হবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours