রূপন সরকার, লেখক ও অধ্যাপক, জলপাইগুড়ি:

প্রতিষ্ঠিত সত্য এই যে, গণতন্ত্রে বিরোধী শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর শাসক দলের ঠিকে থাকা অথবা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে। বর্তমানের এত অপদার্থ বিরোধী রাজনৈতিক শিবির ভারতবাসী ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। বর্তমান বিরোধী শিবিরের অন্যতম মুখ রাহুল গান্ধী নিজের সম্পর্কে প্রচারিত 'পাপ্পু' নামের যথার্থতা প্রমাণ করেই ছাড়বেন। গত লোকসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল না হওয়ায় যেভাবে মাঝ পথে বলে বসলেন 'খেলবো না' অর্থাৎ আমি 'আর সভাপতি থাকছি না' তাতে ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে গেলো। আমরা ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে হারতে বসলেই 'খেলবো না', 'খেলবো না' বলে কেঁদে উঠতাম। নির্বাচনে পরাজয়ের দায় স্বীকার করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পদত্যাগের ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে দলের হারের দায় নিয়ে একটি সর্বভারতীয় দলের সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধী যেভাবে সরে দাঁড়ালেন তাকে 'হারের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করা' না বলে 'দায় সারা' পদক্ষেপ বলা চলে। বাচ্চাদের তথাকথিত 'খেলবো না' আচরণের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। ঠিক একই রকম আচরণের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন লোকসভা নির্বচনের পূর্বে পাঁচ রাজ্যে বিধান সভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর। পাঁচ রাজ্যে বিধান সভার অপ্রত্যাশিত সাফল্য তাঁকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। আত্মবিশ্বাস এতটাই তুঙ্গে ছিল যে কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাজের হিসাব না চেয়ে, কালো টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতির কথা না মনে করিয়ে দিয়ে, বেকারদের চাকরির প্রতিশ্রুতির কথা সামনে না নিয়ে এসে, নোটবন্দী, জি. এস. টি. নিয়ে মানুষের যন্ত্রণাকে সঠিকভাবে নির্বাচনী প্রচারে তুলে না ধরে শুধুমাত্র 'চৌকিদার হি চোর হ্যায়' স্লোগান তুলে যথেষ্ট অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ চোরের সংখ্যা কংগ্রেস পরিচালিত মন্ত্রী সভাতেও নেহাত কম ছিল না। "চৌকিদার হি চোর হ্যায়" স্লোগানের পাল্টা কংগ্রেসের ভুরি ভুরি দুর্নিতির কথা তুলে ধরে পাল্টা আক্রমন শানালেন বিজেপি। সেই জায়গায় কংগ্রেসের প্রয়োজন ছিল প্রশ্ন করা যে পাঁচ বছর আগে অর্থনীতি নিয়ে মোদী যে সব প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছিলেন, সেগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তা না করে রাহুল গান্ধী বিজেপির তৈরি করা উগ্র হিন্দুত্যের জায়গায় নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটলেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের জীগিরের পেছনে হেঁটে নিজেকেও চরম জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করতে উঠে পরে লাগলেন। পুলওয়মা ঘটনায় যখন এতজন সেনা শহিদ হলেন তখন দেশের বিরোধী দলের সর্বাধিনায়ক হয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদত্যাগ না দাবী করে, সংসদে প্রধান মন্ত্রীর বিবৃতি দাবী না করে জাতীয়তাবাদী জিগিরের কাছে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন, গুটিয়ে গেলেন। সাম্প্রতিক চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষে শহীদ জওয়াদের হয়েও পথে নামতে দেখা গেলো না। এতকাল দেখে এসেছি দেশে কোনো অঘটন ঘটলেই বিরোধীরা নির্দিষ্ট বিভাগের মন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে, সংসদে প্রধান মন্ত্রীর বিবৃতি চেয়ে সংসদ প্রায় অচল করে দিতো। রাহুল গান্ধী এই চেনা পথটাকেই চিনতে ভুল করে চলেছেন। এটাকে রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও বিচক্ষণতার অভাব বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর সেই সুযোগে এই জাতীয়তাবাদের নৌকায় ভর করেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিগত পাঁচ বছরের কাজের কোনো হিসেব না দিয়েই হই হই করে নির্বাচনী বৈতরনী পার করে দিলেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেও একের পর এক বিতর্কিত বিষয়কে সংসদে নাম মাত্র বিরোধীতায় পাশ করিয়ে নিলেন মোদী সরকার। পাঁচ রাজ্যের বিধান সভা নির্বাচনের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যে রাজ্যে জোট প্রক্রিয়ায় আরো বেশি গুরুত্ব আরোপ করে নিজেকে সঠিক বিরোধী মুখ হিসেবে তুল ধরার রাহুল গান্ধীর ব্যর্থতা মোদীর নেতৃত্বে বিজেপিকে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে। বিরোধী মুখের শূন্যতাকেই বিজেপি প্রচারের হাতিয়ার করে বলতে শুরু করে 'মোদী নয় তো কে?'। রাহুল গান্ধীজীর হয়তো ধারনা নেই যে, এখনও পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। যে জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিক হাত চিহ্ন অখন্ড ভারতবর্ষের প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি মহল্লার প্রতিটি মানুষের কাছে সুপরিচিত। এটা এমন নয় যে জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীন ভারতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ভারতবর্ষে গান্ধীজীর 'রাম রাজ্য' প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বরং বলা ভালো উল্টোটাই হয়েছে। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও ভারতের কমবেশী ৮০% মানুষের গড় আয় কমবেশী ১০ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের একাধিক রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে,কর্ম-সংস্থানের মতো জরুরী পরিষেবা গুলিও আশানুরুপ উন্নতি ঘটে নি। কৃষকের অবস্থার উন্নতি থেকে শুরু করে শ্রমিকের  ন্যুনতম মজুরির প্রশ্নগুলি অধরাই থেকে গেছে। যার ফলে স্বাধীনতা লাভের এতো বছর পরেও 'food security act', 'right to work' - এর মতো বিল পার্লামেন্টে আনতে হয়। যার বেশির ভাগটাই হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের শাসনকালে। আর এখান থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। সেই অনাস্থার ছিদ্র দিয়েই বিজেপির মতো এক চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী দল তার ডাল পালা ছড়িয়ে বসেছে। বিজেপির আর. এস. এস- এর মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো পরিষেবা পৌঁছে দেবার আড়ালে এক বিশেষ ধর্মীয় জনভিত্তি গড়ে তুলেছে। এই জনভিত্তিই একের পর এক নির্বাচনে বিজেপিকে সাফল্য এনে দিয়েছে। রাহুল গান্ধীজীর বোঝা উচিত তিনি যে পদে আসীন হয়েছেন সেটা পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের বিরোধী দলের সর্বোচ্চ পদ। যে পদের সাথে সরকার বিরোধী অগনিত মানুষের আশা-আকাঙ্খা জড়িয়ে আছে। যে পদ ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবজ। বিরোধী দল দুর্বল হলে গণতন্ত্রের চরিত্র দুর্বল হয়ে পরে। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা শাসক দলের। বিরোধী দলের ভূমিকার ওপরেই শাসক দলের স্থায়িত্ব বা ভেঙে পড়া নির্ভর করে। গঠনমূলক বিরোধীতা না থাকলে গণতান্ত্রিক পরিসরেও শাসক একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠে যার কিছুটা হলেও বহিঃপ্রকাশ বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের কাজকর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। বিজেপির সুপ্ত এজেন্ডা "এক রাষ্ট্র এক ট্যাক্স থেকে এক দেশ এক নির্বাচনের মাধ্যমে এক দেশ এক দলে পৌঁছানো", তা ক্রমশ গতি পাচ্ছে।
তাই ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রক্ষা করার জন্য, ভারতীয় বহুত্ববাদের ধারক ও বাহক জাতীয় কংগ্রেসের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং সর্বোপরি অগনিত কংগ্রেস প্রেমী ভারতবাসীর স্বার্থে অতিদ্রুত রাহুল গান্ধী এন্ড কোং- কে পদত্যাগ ও তাকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাথে এটাও বুঝতে হবে নির্বাচনে আসন সংখ্যার নিরিখে নগন্য হলেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে আপামর ভারতবাসীর মনে এক ধরনের আবেগ বিরাজ করে। আর সেই আবেগ তৈরি হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে। ঠিক অনুরূপ আবেগ তৈরি হয়েছে গান্ধী পদবি সর্বোপরি গান্ধী-নেহেরু পরিবারকে কেন্দ্র করে। রাজ্যে রাজ্যে জাতীয় কংগ্রেসের একাধিক গোষ্ঠী স্বার্থ, আঞ্চলিক স্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ, আঞ্চলিক স্বার্থের সাথে কেন্দ্রীয় স্বার্থ ইত্যাদি বহুমুখি স্বার্থকে একত্রিত করে রাখতে পারে একমাত্র গান্ধী-নেহেরু পরিবার সুযোগ্য নেতৃত্ব। গান্ধী- নেহেরু পরিবারের বাইরে নরসিংহ রাও, মনমোহন সিং, প্রনব মুখার্জ্জীর উত্থানের পেছনেও গান্ধী- নেহেরু পরিবারের সম্মতি সাপেক্ষ ছিল সেটা কোনো গোপন বিষয় নয়। সাম্প্রতিক কালে সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল তার নিজের একটি লেখাতে এই 'পারিবারিক ফ্যাক্টার'-কে 'সিমেন্টিং ফ্যাক্টর' বলে উল্লেখ করেছেন। এই সিমেন্টিং ফ্যাক্টর সরে গেলেই দলের অনৈক্যের চেহারাটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এটা ঠিক আপাত দৃষ্টিতে রাহুল গান্ধীকে একজন ভালো মানুষ বলে অনেকের মতো আমারও মনে হয়। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই রাহুল গান্ধী নিজেকে প্রমাণ করার যথেষ্ট চেষ্টাও করেছেন এতে কোনো সন্দহ নেই। রাহুল গান্ধীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তিনি মোটেই ভালো 'কমিউনিকেটর' বা সুবক্তা নন। রাজনীতিতে সুবক্তা হওয়া ভীষণ জরুরি। নরেন্দ্র মোদী যেখানে সাধারণ থেকে সাধারণতর বিষয়ে মানুষের মাঝে নিয়ে গিয়ে ঝড় তুলে দিতে সক্ষম সেখান রাহুল গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকেও মানু্ষের মাঝে নিয়ে যেতে ব্যর্থ। সুতারাং জাতীয় নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী যথেষ্ট সময় সুযোগ পাওয়া স্বত্ত্বেও নিজেকে প্রমাণকরতে ব্যার্থ হয়েছেন। পাশাপাশি গান্ধী পরিবারের অন্য আরেক সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি পরিণত রাজনীতিবিদ বলে মনে হয়। আর এটাও ঠিক রাহুল গান্ধী নিজে উদ্যোগী না হয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে এগিয়ে না দিলে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিজে থেকে এগিয়ে আসবেন না। তাই রাহুল গান্ধীর উচিত সমস্ত নাটকের যবনিকা ঘটিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নেতৃত্বে এগিয়ে দিয়ে নতুন উদ্যোমে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বিরোধী শূন্য রাজনৈতিক অরাজগতা থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours