প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

দূর্গম নদী, টিলা, শাল - পিয়ালের আকুতি নিয়েই বাঁকুড়া। এই ভৌগোলিক অবস্থান বহুবার বাঁকুড়াকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছে ; ব্রিটিশ শাসনের সূচনা বললে, অষ্টাদশ শতকেই ধরা হয়। আর এই সহস্রাধিক বছরে বাঁকুড়া - বিষ্ণুপুরে  যে রাজবংশের  রাজত্বের নাম পাওয়া যায়, তা হলো মল্লরাজবংশ। এখন প্রশ্ন আসে যে,মুসলিম রাজশক্তির যে ক্রমশ বিস্তার তা কি এই মল্লদের ঠেকাতে পেরেছিল!  উত্তরটা অনায়াসেই বলে দেয় যে, " না,  কোনো প্রভাব পড়ে নি। " মোগল আমলে আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় মোগলদের কোনো প্রভাবই খাটে নি। অষ্টাদশ শতকে রাজা কীর্তিচাঁদ, বিষ্ণুপুর রাজশক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধেয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, একসময় কীর্তিচাঁদ যদিও বা বিষ্ণুপুরাধিপতিকে পরাজিত করেছিলেন, কিন্তু রাজ্য গ্রহণে অসমর্থ হন;  

আদিমল্ল ছিলেন মল্লবংশের প্রতিষ্ঠাতা ; কিংবদন্তি আদিবল্লকে বাগদিরাজা বললেও, তাঁর পুত্র জয়মল্ল রাজধানী লাউগ্রাম থেকে সরিয়ে বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করে। মল্লরাজবংশের ঊনপঞ্চাশতম রাজা বীর হম্বির। তিনি মোগলসম্রাট আকবরের সমসাময়িক।  প্রাথমিক জীবনে বীর হাম্বির আগ্রাসী মনোভাব তাকে সাম্রাজ্যবাদী শাসক রূপে আখ্যা দেয়। কিন্তু প্রখ্যাত বৈষ্ণবসাধক শ্রীনিবাসের সংস্পর্শে তাঁর জীবনে আকুল পরিবর্তন হয়। ষড়গোস্বামীদের অন্যতম  শ্রীজীব গোস্বামী তাঁর নতুন নামকরণ করেন চৈতন্যদাস।  উল্লেখ্য এই যে,  বাঁকুড়ার রাজপরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ফলে বাঁকুড়াতে বৈষ্ণব মন্দির প্রতিষ্ঠার জোয়ার আসে ; আর সেই সময়েই গড়ানহাটি কীর্তন প্রচার শুরু হয়। শোনা যায় যে,  বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর মিলে মোট তৎকালীন সমাজে কয়েক হাজার কৃষ্ণমন্দির তৈরি হয়। আজও বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে বিষ্ণুপুর " গুপ্ত বৃন্দাবন " হিসাবে পরিচিত। 

বীর হাম্বির পুত্র ছিলেন রঘুনাথ। একবার বাংলার শাসককে কর দিতে না পারায় রঘুনাথকে অবরুদ্ধ করা হয়। এদিকে একদিন একটি বুনো ঘোড়াকে পনেরো জন সামাল দিতে না পারায়, রঘুনাথ জানায় যে, " কেমন করে বুনো ঘোড়াকে সামাল দিতে হয় তা তার জানা।! " নবাবের  কানে সে কথা যাওয়া মাত্র, নবাব তাঁকে মুক্তি দেন এবং রঘুনাথের ওস্তাদি খেলায় বুনো ঘোড়া তখন পোষা কুকুরে পরিণত হয়৷ নবাব খুশি হয়ে তাঁকে "সিংহ " পদবি  দেন। এই প্রথম কোনো মল্লরাজা "সিংহ " পদবি পান। তাঁর বীরত্ব দেখে নবাব তাঁর রাজত্ব ফিরিয়ে দেন৷ বিষ্ণুপুরের রজইতিহাসে তিনিই প্রথম বড়ো দুর্গ নির্মাণ করেন। 

১৬৫৮ সালে তিনি লালাজি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহ  ছিলেন পিতার বিপরীত।  তাঁর আমলেই মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠা পায়। বরোদার   চেতুয়ার রাজা শোভা সিংহের সুন্দরী কন্যা চন্দ্রপ্রভার সাথে তাঁর বিবাহ হয়। যৌতুকে তিনি সোনার  বিশালাক্ষ্মী মূর্তি পান৷ রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভার সাথে আসে একমাত্র অপূর্বা নারীদাসী  লীলাবাঈ। আর এই লীলাবাঈ চন্দ্রপ্রভার জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসে। 

রঘুনাথ সিং, লীলাবাঈ এর সৌন্দর্যে মেতে ওঠেন। রাজকাজ ছেড়ে তিনি উদ্দাম ভালোবাসার মোহে কামার্ত হয়ে লালবাঁধের গহীনে নৌকা ভাসায়৷ জোছনার ধার বেয়ে যখন চুঁইয়ে পড়তো পরতে পরতে প্রেম তুফান, তখন নৌকায় মেহফিল ছিলেন লালবাঈ৷ এদিকে চন্দ্রপ্রভা স্বামী পা জড়িয়ে বলতে থাকেন, "ওগো তুমি আমায় ছেড়ে যেও না, যেও না!  তুমি ফিরে এসো! " রঘুনাথ দীপ্ত কন্ঠে জানায় যে, সব কিছু ছেড়ে দিলেও, সে কখনও লালবাঈকে ছাড়তে পারবে না। কিন্তু যেখানে তীব্র আকর্ষণ সেখানেই বিকর্ষণ।  চন্দ্রপ্রভা অপমানে প্রতিশোধ প্রিয় হয়ে ওঠে৷ নিজের স্বামী ও লালবাঈকে গুপ্ত হত্যা করবে বলে মেতে ওঠেন। রাজা রঘুনাথকে হত্যা করে ও পিয়ারিকে লালবাঁধের গভীর জলে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে ; লালবাঁধে ৩০ হেক্টর জলাভূমি আজও কাঁদে ; রঘুনাথের চিতায় চন্দ্রপ্রভা সতীরূপে আত্মবিসর্জন দেয়৷ 
একই বংশে ভাই গোপাল সিংহ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব৷ তিনি  ছিলো ধার্মিক ও মদনমোহনের ধ্যানে ডুবে থাকা মানুষ। হরিনাম যে বড়ো মধুর, তাই ইহকাল, পরকাল জুড়ে জীবনদেবতাকে আঁকড়ে ধরেই তিনি দিনাতিপাত করেন। তাঁর সন্ন্যাস জীবন, প্রজাদের মধ্যেও দাগ কেটে যায়৷ জেলা গেজেটিয়ায় বলা হয়েছে "It was characteristic of this Raja that he issued an edict that all the people of Mallabhum should count their beads and repeat the name of God every evening at sunset..." 

সময়টা ১৭৪২; খতরনাক বর্গি সেনারা পুজোর  নিতোল আনন্দে আত্মহারা ; বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ির দিকে পা বাড়ায় হিংস্র দল। বিষ্ণুপুরের দুর্ভেদ্য গড়খাত বাধ সাধে৷ দলমাদলের দাগ কাটলেন দলমাদলের কামান। কামানটি ৩.৮ মিটার লম্বা। চওড়া ৩০ ইঞ্চি ; ওজন প্রায় কয়েক কুইন্টাল। আর দাগ কেটেছিলেন স্বয়ং মদনমোহন৷ প্রচলিত মত বলে, বর্গিরা যখন আক্রমণ করে,  রাজা গোপাল সিংহ নাকি বলেছিলেন, " এসো!  হরিনাম করি!  প্রতিরোধ করার দরকার নেই। লড়াই করবেন স্বয়ং মদনমোহন। কথিত আছে প্রজারা হরিনামে মত্ত হয়ে উঠলে মদনমোহন নিজে কামানের দাগ ধরেন৷ যুক্তিবাদীরা বলে, "The Maratha cavalry were unable to pierce the strong fortification and retired, leaving the Rajas lcvies to plunder their abandoned camp." তবে বনবিষ্ণুপুরের  মদনমোহনের মাহাত্ম্যগাথা বলে, 
"আমার সহায় কেবল মদনমোহন। 
অন্তর্যামী মদনমোহন অন্তরে জানিল।। 
বর্গি তাড়াইতে দেখি আমায় যেতে হলো। 
দলমাদল কামান লালবাঁধের ধারে ছিলো।
আশীমান বারুদ ঠাকুর তার ভিতরে দিলো।" 

তবে গোপালের পুত্র চৈতন্য সিংহ এর সময়েও বর্গিহানা হয়৷ চৈতন্য সিংহের খুড়তুতো ভাই, দামোদর সিংহ এর ষড়যন্ত্রেই বিষ্ণুপুর পুনর্বার আক্রান্ত হয়৷ পরে অবশ্য চৈতন্য সিংহ সপরিবারে  পলায়ন করে। শোনা যায় তিনি মদনমোহনকে তৎকালীন কোন্নগরের লবণ ব্যাবসায়ী গোকুল মিত্রের কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন৷ গোকুল মিত্র,  মদনমোহন কে সৌভাগ্যের প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। চৈতন্য সিংহ,  রর্বাট ক্লাইভের সহযোগিতায় পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করলেও মদনমোহনকে আর ফিরে পান নি। গোকুল মিত্র,  তাঁকে  আইনের ভয়ে নকল মূর্তি গড়ে দেন৷ ধার করা সব টাকা মেটালেও  গোকুল মিত্র ফেরত দেয় নি। পরে এই মদনমোহন শোভাবাজার রাজবাড়িতে ঠাঁই পায়। চৈতন্য সিংহ আসল ভেবে নকল মদনমোহন বিষ্ণুপুরে প্রতিষ্ঠা করে৷ আর কলকাতায় আসলটি রয়ে যায়৷ হান্টারসাহেবের কথায়..  "Gakul received the money but refused to restore the idol. Gakul caused a second idol to be made, exactly resembling the original, and presented it to the Raja." 

ইতিহাস কথক হয় ; স্মৃতি মধুর তবু কাল স্বাক্ষর রেখে যায়। (ক্রমশঃ) 

#ঋণস্বীকার -
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) কৃতজ্ঞতা স্বীকার " ব্লগ " অদিতি ভট্টাচার্য
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/aditibhattacharya/a-story-of-forgotten-history/
৩) ভক্তিরত্নাকর " শ্রী নরহরি চক্রবর্তী "
৪) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৫)  ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৬) বর্ধমান সহায়িকা 
৭) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৮)  প্রচলিত লোকগাথা 
৯) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
১০) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
১১) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১২) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১৩) ইতিহাস অভিধান 
১৪) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি
১৫) "বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা" 
১৬)  bengali koulal.com
১৭) অন্যান্য 
১৮) আইন-ই- আকবরী
১৯) গড়পঞ্চকোট ( ajanapathe.com) 
২০) ebela.in  ও  sobBanglay.com

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours