প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
স্মৃতি যখন বিষাদময়, তখন দেহমন ভার হয় ; কিন্তু যুগান্তরের ঘুম ভাঙলে আবৃত পাহাড়ে উঁকি দিতে স্বাদ হয় বৈকি!  অভিজ্ঞতা আমাদের মূল্যবোধের অঙ্কটা বুঝিয়ে দেয় ; জলভেজা অতীত, তবু আঁকড়ে নিতে স্বাদ হয় ; ঠোঁট কামড়ে সিক্ত উষ্ণতা অনুভব,  অতীত প্রেম আমার।  

এক বৈচিত্র‍্যহীন গ্রামের কথা বলবো আজ। যতটুকু সুখ আর আয়োজনের প্রীতি, তা ঘিরেই আছে বিশ্বাস" বাড়ির উত্তরধিকার পুরাবৃত্ত। ক্রিয়াকর্ম, যজ্ঞ যাগে জড়িয়ে রয়েছে লোকহিতকর উত্তরাধিকার সম্পদ। জানি না, পূর্বাপেক্ষা বৃহৎ করে নিজেকে ভাবতে পারবে না এই দশঘরা, কিন্তু বঙ্গসংস্কৃতি যদি লেখা হয়, তবে এই বিশ্বাস বংশের সগৌরব কীর্তি ফলকে ফলকে লেখা হবে, এটা বলাই যায়৷ বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসে, বিলুপ্তি আঁকা হলে, সেদিনও কীর্তি জয়রথ সাজিয়ে দেবে প্রতি কল্পে। 

দশঘরা হুগলী জেলার আর পাঁচটি গ্রামের মতোই এক প্রাকৃতিক সংসর্গে গড়ে ওঠা এক গ্রাম৷ কিন্তু কেন উঠে এলো এই নাম!  ইতিহাসে কি আছে, যে প্রাঞ্জল শ্বাসে ব্যক্ত হলো উত্তরাধকার পুরাবৃত্ত! আসলে "বিশ্বাস " বাড়ির "কুলপঞ্জি " বলছে এই বাড়ির বংশের জগমোহন ছিলেন পরম ধার্মিক। পূর্ব রাজধানী দশঘরার  রাজা মহাত্মা রামনারায়ণ পালচৌধুরী তাঁকে মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করেন এবং কুলোপুরোহিত সহ দশঘরায় বাস করান। রাজা রাজ্যচ্যুত হলে তাঁর সুত রামমোহন দেব বিশ্বাস বর্ধমান রাজার নিকট ইজারা গ্রহণের সময় বেশ কিছু দেবসেবা, ভূমিদান, ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হন। 

তাঁর পুত্র সহস্ররাম, ভৃগুরাম, আনন্দীরাম, নিধিরাম দেবতার উপর বিশ্বাসে, চার ভাই বহু গ্রামের ইজারা নিয়ে কনিষ্ঠের লোকান্তে, তিন ভাইয়ে শ্রীবৃন্দাবনধামে হতে তিনটি শ্রীবিগ্রহ  মূর্তি এনে, নিজেদের বাড়িতে একটি ও ব্রাহ্মণের ঘরে অন্নভোগ দিয়ে বাকি দুটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। আনন্দীরামের আত্মজ শ্যামসুন্দর দেব বিশ্বাস, দিনাজপুর জেলার ক্যালেক্টরীর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন৷ তাঁর পুত্র রাইকিশোর, রাজকিশোর, যুগলকিশোর দেব বিশ্বাস দশসালা বন্দোবস্তের  পর ধর্ম কর্মাদি শুরু করেন৷ এছাড়া সমাজ রক্ষা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন ও নানা তীর্থ পর্যটন করেন৷ রাজকিশোর ও যুগলকিশোর ১৭৪৯ শকাব্দে এক বৃহৎ রথ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই রথ পুরাতন হওয়ায় ১৭৮৫ শকাব্দে অতি সুরম্য রথ গঠন করেন। এই রথই " দশঘরা " প্রসিদ্ধ রথ নামে খ্যাত। 

১৯৪৭ সালে যাবতীয় জমিদারি হাতছাড়া হওয়ার পর, বিশ্বাস পরিবারের মমত্বে রথ পুনরায় গঠন করা হয়। এই জমিদার বংশ ১৮৫৮ সালে দশঘরা উচ্চ ইংরাজি স্কুল স্থাপন করে।কিন্তু কেবল প্রতিষ্ঠা নয়, তারই সাথে পরিচালনার বিষয়েও তারা সক্রিয় ছিলো। সহস্ররাম, ভৃগুরাম, আনন্দীরামের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গৃহ দেবতার মন্দিরটি বর্তমানে আলোচ্যের বিষয়। আসলে বিশ্বাসরা ছিলো পরম বৈষ্ণব। গৃহদেবতার নাম রাধাগোপীনাথজীউ। মন্দিরটি তখনকার আকৃতিতে উচ্চতায় আনুমানিক ত্রিশ ফুট। কৃষ্ণমূর্তিটি  কষ্টিপাথরের ও রাধিকা মূর্তিটি ধাতুনির্মিত।  আজ থেকে প্রায় ২৪৩ বৎসর পূর্বে ১৬৫১ শকাব্দে এই দেবালয়টি নির্মিত হয়েছিলো। এই বংশ শ্রীচৈতন্যদেবের প্রিয় শ্রী জগদীশ মোহন্ত - এর শিষ্য। মহাপ্রভুর অবতারাবধি বিষ্ণুমন্ত্রাস্থিত। এদের বৈষ্ণবে অচলা ভক্তি ও অন্য উপাসকে স্থান নেই। এখানে ত্রিসন্ধ্যা নাম, কীর্তন অতিথিসেবা প্রকটভাবে পালন করা হতো৷ 
বিশ্বাস পরিবারের ভদ্রাসনের দেউড়ি পার হতেই বহুস্তম্ভশোভিত প্রশস্ত চন্ডী মন্ডপ বিদ্যমান। এখানে প্রায় ১৮০ বছর ধরে শারদীয়া দুর্গাপুজো হয়ে আসছে৷ এখানেও কুমোরটুলির এক কুম্ভকার পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসদের বহুদিনের বন্দোবস্ত। সে পরিবারের শ্রী তারাপাল নিজে এসে প্রতিমা তৈরি করে দিয়ে যান৷  ১৯৩৭ - ৩৮ সালে এই তারাপাল প্রস্তাব আনে যে, রাধাগোপীনাথপজীউর মন্দিরটির দক্ষিণ ও  পশ্চিম দেওয়ালে যে  পোড়ামাটির নকাশি টালিতে আবৃত তা তিনি মূর্তিখচিত নতুন টালিতে নির্মাণ করতে চান৷ আর একপ্রকার নতুন অভিজ্ঞতায়, নতুন পন্থায় এই জীর্ণ কায়া অভিনবত্ব পায়। পরে তা আবার মন্দিরের গায়ে লাগানো হয়।

শ্রীপাল "চৌরাশি থাক" এর কুম্ভকার। মধ্যযুগে ও উত্তর মধ্যযুগে বঙ্গদেশে মন্দির নির্মাণ ও অলংকরণে শিল্পীরা গিল্ড প্রথায় কাজ করতেন। এক এক অঞ্চলের এক এক গোষ্ঠীকে মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে "থাক " নামে অভিহিত করা হয়। ইংরাজীতে "স্কুল " বলতে যা বোঝায়, "থাক " বলতেও তাই বোঝায়। শতাব্দীকাল পূর্বেও বঙ্গদেশে " বর্ধনান থাক ", "অষ্টকুল থাক "," চৌরাশি থাক "প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন " স্কুল " ছিলো। কৃতিত্বের হেরফের হিসাবে বেশ কিছু শিল্পসৃষ্টির ইতরবিশেষ হতো।  তারাপদ, "চৌরাশি থাক " এর কুম্ভকার হলেও, পূর্ব আচরিত মন্দির ভাস্কর্যকলার সাথে তাঁর কোনো পরিচয়ই ছিলো না৷ 

শ্রীপালের বসত ভূমি বলতে নদীয়া জেলার গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরের নামই শোনা যায়৷ পিতা দুখীরামচন্দ্র পাল কুমোরটুলিতে এসে বসবাস করেন। শোনা যায় নাকি, "টেরাকোটা " টালি নির্মাণে তিনি যে কয়জন সাহায্যকারী বেছেছিলেন, তাঁরা সবাই এই গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরের বাসিন্দার। বর্তমান তাঁর পরিবার পুতুলও বেচে আবার কাঁচা মাটির মূর্তিও তৈরি করেন। পিতা তৎকালীন সমাজে মন্দির অলংকরণে কাজ করেছিলেন, কিন্তু টেরাকোটা " উপর তাঁর দক্ষতা ছিলো কিনা একথা তিনি জানতেন না৷ তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি দশঘরা মন্দিরের সব পুতুল হাতে কলমে তৈরি করেছেন। দুর্গাপ্রতিমার গড়ার সময় তিনি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন, হাতিয়ার নয়। ছাঁচেফেলা পুতুলগুলি তিনি সিমেন্ট অথবা প্লাস্টার দিয়ে তৈরি করেছিলেন। ছাঁচ থেকে বার করে কাঁচা অবস্থায় বাঁশের চাঁচাড়ির সাহায্যে মডেলগুলির উপর তিনি নকাশি কাজ করতেন। 

কুলকাঠের আগুনে অল্প আঁচে পোড়ানো যে প্রথা তা বহু প্রাচীন৷ সাধারণ ভাবে শ্রীপাল পুতুলের জন্য কেবল পোয়ান ব্যবহার করতেন। অন্য কোনো বিশেষ প্রকার চুলা ব্যবহার করা হয়ে ওঠে নি। প্রথমের দিকে তাঁর এই অভাবনীয় নতুন প্রয়াস অনেক স্থানেই বাদ হয়ে গেছে, পরে পরিপক্কতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং তৎকালীন বীরেশ্বর বিশ্বাসের সহায়তায় উচ্চতর ভাবে সাফল্য এসেছে। আসলে তৎকালীন সমাজে মন্দির প্রতিষ্ঠা, জলাশয় উৎসর্গ, অতিথিশালা নির্মাণ প্রভৃতি মহৎকর্ম হিসাবে চিহ্নিত ছিলো। ভূস্বামীরা প্রধানত এই সকল উপায়েতেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা দিতেন। তাই ১৯৩১ সালে "ধামতোড়" নিবন্ধে জানা যায় যে, পশ্চিমবাংলায় আরো কিছু টেরাকোটা মন্দির নির্মিত হয়েছে।কিন্তু পরবর্তীতে অর্থনৈতিক বদান্যতা এবং যুগস্রোতের বদান্যতা অনেকটাই এই সংস্কৃতির চিহ্ন পাল্টে দিয়েছে৷ তবুও আজও আত্মাভিমান, আত্মকেন্দ্রিকতা ভুলে সংস্কার হয়েছে;  কিন্তু উপযুক্ত শিল্পীর অভাবে অপূর্ণতা যেন গ্রাস করেছে। 

বর্তমান সাবেক ও একালের মূর্তিগুলির মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।কারণ নবীনদের সাথে সাবেকী দুঃসাহসী প্রভেদ তো থাকবারই কথা। তবে শ্রীপালের মতো সম উৎসাহের বক্তিপ্রাণ আবারো হাত ধরে, তবে আবারো " স্কুল " পত্তন হতেই পারে। আসলে চর্চা যদি অব্যাহত থাকে, তবে সাবলীল শৈলী তো রূপ পরিগ্রহ করবেই। তবে  দূরবর্তী  গ্রামের বুকে অনুসৃত টেরাকোটা হয়তো আশার আকাশে আরো যৌববতী করবে শিল্পীকে, এটাই যাপন আমাদের। এখানেই তো সার্থকতা।।

তীব্র সুখে মৃদুস্বর স্ফুরিত কম্পন  দেখা যায় ; তবু বাস্তব মানতে হয়। ভিত্তিকে বুকে নিয়েই অনাঘ্রাত কৌমার্য, স্নিগ্ধ ভেজা অতীত কথা বলে যায়।। 

তথ্যসূত্র - 'দেখা হয় নাই',   
অমিয়কুমার_বন্দ্যোপাধ্যায়

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours